পোস্টস

প্রবন্ধ

হাল আমলের লাইফস্টাইল সংকট

১৪ জুন ২০২৪

ড. মো. আব্দুল হামিদ

মূল লেখক ড. মো. আব্দুল হামিদ

আচ্ছা, গত রাতে কয় ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন? ৮ ঘণ্টা বা তার বেশি কি? একটু ঝামেলায় ছিলেন সেজন্য পারেননি, তাই তো? ঠিক আছে, তাহলে এবার বলুন সর্বশেষ কবে টানা ৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছেন? আমার ধারণা, বহু চেষ্টা করেও অনেকেই সেটা মনে করতে পারবেন না। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য আমাদের প্রতিদিন অবশ্যই ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। তাহলে আমরা সেটা করছি না কেন? 

 

বিশেষ প্রয়োজনে ইদানীং ‘ঘুম’ বিষয়ে পড়াশোনা করছি। যতই পড়ছি, বিস্ময়ের সীমা থাকছে না। আমরা তথাকথিত ‘আধুনিক’ হওয়ার নামে নিজেদের যে কী ভয়ংকর ক্ষতি করছি, তা বোঝার জন্য পরিবারের সদস্যদের ঘুমের প্রবণতা খেয়াল করুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিতভাবে প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুমানো আত্মহত্যার শামিল! তাহলে আমরা কী দল বেঁধে আত্মাহুতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি? 

 

গবেষণা বলছে, মানুষই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা ইচ্ছা করে ঘুমাতে দেরি করে! অর্থাৎ ঘুমের অনুভূতি তীব্র হওয়ার পরও তারা নিজেকে জাগিয়ে রাখে। আবার বর্তমান বিশ্বে টিনএজার গোষ্ঠী সবচেয়ে কম ঘুমাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর পরিণতি মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকিও হতে পারে! কী বুঝতে অসুবিধা হলো? তবে জেনে রাখুন: খাদ্য সংকটের চেয়ে ঘুম সংকটে মানুষ দ্রুত মারা পড়ে! অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও দু-তিন মাস বাঁচার দৃষ্টান্ত থাকলেও ঘুমের ক্ষেত্রে এ মাত্রা ছিল ১১ দিন। 

 

খেয়াল করুন, মানুষ ছাড়া সব প্রাণীই প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা জেগে ওঠে, দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু করে। সূর্যাস্তের আগেই সেগুলো শেষ করে। প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে। হয়তো সে কারণেই তাদের রোগবালাই এত কম হয়। বন্যপ্রাণীর কথা বাদই দিলাম, গৃহপালিত পশুপাখির তো কালেভদ্রে হাসপাতালে যাওয়া লাগে, তাই না? বলতে পারেন, পশুর সঙ্গে কি মানুষের তুলনা চলে? তাহলে আপনার দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কথা ভাবুন। তারা বৃদ্ধ বয়সেও কত স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতেন বা করেন! বয়স ৭০-৮০ হওয়ার পরও তারা নিজেদের কাজকর্ম সবই করতে পারতেন। 

 

অথচ এখন বয়স ৩০ পার হতে না হতেই কত সমস্যা! নিয়মিত নানা রকমের চিকিৎসকের কাছে ধরনা দিতে হয়। কেন এমনটা হচ্ছে? নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে। তবে খুব কমন কারণ পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া। আগে শুধু পরিবারের বৃদ্ধ লোকদের ঘুম কম হতো। কিন্তু এখন আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এ রোগে ভীষণভাবে আক্রান্ত। স্কুলের শিশুরা ক্লাসে বসলে ঘুমে ঢলে পড়ে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালের ক্লাসে উপস্থিতি খুব কম। কর্মক্ষেত্রে অধিকাংশ কর্মী সারাদিনই ক্লান্ত থাকছে। ফলে পূর্ণোদ্যমে কাজকর্মে মনোযোগী লোকের সংখ্যা দ্রুত কমছে। 

 

এটা বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত প্রতি তিনজনে একজন পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারে না। ফলে তাদের ৪০ শতাংশ (কর্মক্ষেত্রে মাসে অন্তত একবার) নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে! অপর্যাপ্ত ঘুমের ফলে উৎপাদনশীলতা কমে। তারা গবেষণা করে দেখেছে বছরে এর পরিমাণ ৪১১ বিলিয়ন ডলারের সমান! হয়তো সে কারণেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ঘুম সহায়ক ওষুধ বিক্রি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। তার পরই রয়েছে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। তবে বিশ্বে সবচেয়ে ঘুম বঞ্চিত দেশ হলো সিঙ্গাপুর। ওপরের তথ্য থেকে কী বোঝা গেল? 

 

আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে ঘুমের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, তাই না? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তবে আপনি যেটা ভাবছেন বাস্তবতা তার উল্টো। কারণ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয় করা মানুষের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে যারা রাতে ভালো ঘুমান তাদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ বেশি! এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বিশ্বের অতি সফল ১৫ জন প্রধান নির্বাহী বলেছেন, তারা (এক বা দুই শিফটে) ৮ ঘণ্টা ঘুমান। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে বিছানায় যান। ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে উঠে পড়েন! 

 

প্রিয় পাঠক, আমরা কি সারাদিন তাদের থেকেও বেশি ব্যস্ত? গত লেখায় আমাদের নিত্যদিনের আর্থিক টানাপড়েনের কথা বলেছিলাম। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশির চক্রে কীভাবে ক্রমেই যেন আটকে যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে, আমাদের ঘুমের বকেয়াও শোধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই ভাবছি আজ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ব, কয়েক রাতের ঘাটতি পূরণ করে ফেলব। কিন্তু কীভাবে যেন আবারো গভীর রাত হয়ে যাচ্ছে! সকালে স্কুল-অফিস থাকায় নির্ধারিত সময়ে উঠতে হয়। সেখানে দেরি করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু ‘ঘুমাতে যাওয়ার স্বাধীনতা’র ভার বওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

 

স্বল্পমেয়াদে হয়তো এর প্রভাব খুব একটা চোখে পড়ছে না। বিশেষত তরুণ-যুবকরা রাতের পর রাত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বয়স্করা হয়তো বাধ্য হয়ে একপর্যায়ে ঘুমাতে যায়। তবে শরীর বেশিদিন সেই ভার বইতে পারে না। সবসময় ক্লান্তিভাব থাকে। কোনো কাজে গভীরভাবে মনোযোগী হওয়া যায় না। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার মাত্রা বাড়ে। অনেক সময় কথা ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে শরীরের সবচেয়ে ক্ষতি হয় দীর্ঘমেয়াদে। কারণ ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। 

 

সারাদিন শরীরের ওপর যে ঝড় বয়ে যায়, সেগুলো মেরামত করতে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। পরের দিনের জন্য শরীরকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হয়। ঘুমের মাত্রা যত গভীর হয়, মেরামতের কাজটিও তত ভালো হয়। প্রকৃতির এই রিফ্রেশিং সিস্টেমকে আমরা অবজ্ঞা করতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে তার ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে সেটাই হচ্ছে। আজকাল উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিপ্রেশন ও ওবেসিটি খুব কমন সমস্যা। সঙ্গে বাড়ছে হার্টের অসুখ। স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। মেজাজ খিটখিটে থাকা, সামান্যতে রেগে যাওয়া, নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে চালকের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার ফলে। এমনকি পাইলটের নিদ্রাহীনতায় বিমান দুর্ঘটনাও ঘটছে। 

 

আগে এ অঞ্চলে স্মৃতিভ্রমসংক্রান্ত অ্যালঝেইমার বা ডিমেনশিয়া রোগের প্রবণতা বেশ কম ছিল। আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলই নাকি এসব থেকে রক্ষা করত। কিন্তু নগরজীবনে কয়েক দশকে উভয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ফলে আমাদের দেশেও এখন এ-জাতীয় রোগের বিস্তার ঘটছে। অথচ শুধু নির্ধারিত সময়ে পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাসে এসব রোগ থেকে অনেকটা দূরে থাকা সম্ভব। মানসম্মত ঘুমের অভাব আরো অনেক বিষয়ে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। এই যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। হরমোনে ভারসাম্যহীনতা কিংবা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা লোপ পাওয়া। তাছাড়া মানসিক বৈকল্য ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া। 

 

অন্যদিকে বেশি রাত জাগলে ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণ বয়ে আনে। নগরে বাস করা মানুষ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খায়। আরামদায়ক পরিবেশে কাজ করে। সামান্য সমস্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পায়। তার পরও তাদেরই কেন জটিল-কঠিন রোগগুলো আঁকড়ে ধরছে? আমাদের পূর্বপুরুষের ক্ষেত্রে তো তেমনটা হতো না। এমনকি আমাদের চারপাশে কঠোর পরিশ্রমী মানুষও সহসা অসুস্থ হয় না। একজন রিকশাওয়ালার সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর-সর্দিও হয় না। কারণ সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর তারা বিছানায় যাওয়া মাত্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ও গভীর ঘুম তাদের শরীরকে পুনরায় সতেজ ও কর্মক্ষম করে তোলে। আজকাল অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকাকে ‘স্মার্টনেস’ মনে করে। 

 

তাই প্রয়োজন ছাড়াই রাত জাগে। যে মানুষ পেশাগত কারণে সারা রাত জাগতে বাধ্য হন, তাদের কথা আলাদা। তবে তাদেরও উচিত দ্রুত সেই শিডিউল থেকে নিজেকে বের করে আনা। নইলে রাতে পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া বড় অসুখ হলে শারীরিক ও মানসিক কষ্টের তো সীমা-পরিসীমা থাকে না। তবে এ নিবন্ধের মূল লক্ষ্য যারা সুযোগ থাকার পরও দ্রুত ঘুমাতে যান না। রাত জাগলে ক্ষতি হবেই। অপ্রয়োজনে এ ক্ষতি হলে তা মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন। তাছাড়া আমাদের এমন অভ্যাসের কারণে পরিবারের শিশুরাও জেগে থাকছে। তাদের বেশি সময় ঘুমানো দরকার। নইলে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা পাঠে গভীরভাবে মনোযোগী হতে পারবে না। দীর্ঘমেয়াদে এ ক্ষতি হবে অপূরণীয়, তাই না? 

 

ঘুমের গুরুত্ব বোঝার খুব সহজ একটা টেস্ট হলো মাঝেমধ্যে দেখবেন গুছিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে না, সব কিছুতে বিরক্তি। নিজেকে পরিশ্রান্ত মনে হয়, সহজে অন্যের ওপর রাগ হয়। কিংবা অনেক ভেবেও একটা বিষয় স্মরণ করতে পারেন না। এ পরিস্থিতিতে ফোন-টিভি-কম্পিউটার সব বন্ধ করে লম্বা একটা ঘুম দিন। উঠে দেখবেন অনেক কিছুই স্বাভাবিক। শরীরে ছোট্ট সমস্যা হলে সামান্য চেষ্টায় সেটা ঠিক করা যায়। কিন্তু সেটা উপেক্ষা করতে থাকলে একসময় ব্যাপক আকার ধারণ করে। তখন বহু চেষ্টা করেও সারানো যায় না। ঘুমের ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। প্রতিদিন একটু করে ঘুমের ঘাটতি আমাদের বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। সীমাবদ্ধতাগুলো নজরে আসার পরও গতি অব্যাহত রাখছি। হঠাৎ শরীর বিগড়ে গেলে তখন বড্ড দেরি হয়ে যেতে পারে। 

 

তাই সঠিক সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। দেখবেন শরীরের অনেক কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেরামত হয়ে যাবে। শরীর ও মন পূর্ণ হবে আনন্দদায়ক এক অনুভূতিতে। পুনশ্চ: ছোটবেলায় শুনতাম আমরা জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটাই। তখন কেউ ঘুমকাতর হলে তাকে বিল্লি (বিড়াল) বলে খ্যাপাতাম। কারণ বিড়ালরা নাকি জীবনের দুই-তৃতীয়াংশই ঘুমিয়ে কাটায়! কিন্তু বড়বেলায় ক্রমেই যেন আমরা ‘জিরাফ’ হয়ে যাচ্ছি। কথিত আছে, জিরাফের দিনে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমালেই চলে!