পোস্টস

সমালোচনা

গ্রন্থালোচনা: দুপুরের পাড়ে পুকুরের আড়ে

১৫ জুন ২০২৪

সানজিদা সিদ্দিকা

মূল লেখক সানজিদা সিদ্দিকা

যখন কোনো গল্পগ্রন্থ কয়েকটি গল্প মিলে নির্মিত হয় তখন সে বই পড়তে বেশ শঙ্কা অনুভব করি। কারণ আমার ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো বইয়ের শুরুর বা তারপরের গল্পগুলো যদি না টানে সেক্ষত্রে পুরো বইটি পড়তে আর মন টানে না। তাছাড়া কোনো গল্প পড়তে গিয়ে যদি এমনটা না মনে হয় যে,এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে বা মনে মনে  কথোপকথন  চলে এখন হয়তো এটা ঘটতে পারে পারে এ ধরনের আকাঙ্খা তৈরি না হলে সে গল্পও বেশী দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তেমনি এক শংঙ্কা নিয়ে পড়তে বসেছিলাম এবারের বইমেলায় প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক জিয়া হাশান রচিত 'দুপুরের পাড়ে পুকুরের আড়ে' গল্পগ্রন্থটি। 
এতে মোট চারখানা গল্প আছে। প্রথম দুটি গল্প পড়ে মনে হয়েছিল সবগুলো গল্প কলকাতার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের  সিনেমার মতো হতে যাচ্ছে নাকি? কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের  বেশিরভাগ সিনেমা শেষ হয় মৃত্যু দিয়ে। কিন্তু না; আমার এতসব ভাবনার মাঝে পুকুরের পানি ঢুকে গেল। প্রতিটা গল্পেই একটা চমক আছে। আছে ভাবনার খোরাক।

 

এবার গল্পগুলো নিয়ে অল্প অল্প কথা বলি। প্রথম গল্প ' গাড়ি-গণকের গাথা' এই গল্পটি এক অদ্ভুত বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়েছে। পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে তাহের আলী চরিত্রটি কেমন করে গাড়ি দেখে বলে দিচ্ছেন কোন গাড়ি কোথায় গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করবে? মনে মনে অনেক সম্ভাব্য ভাবনা তৈরি হয়েছে।  ভেবেছি হয়তো লেখক এরপর গল্পে দেখাবেন যে,  তাহের আলীর দলের কেউ একজন গাড়িগুলোর পাটর্স বিকল করে বা কিছু একটা করে তাই গাড়িগুলো নির্দিষ্ট স্থানে এসে অ্যাকসিডেন্ট করে। কিন্তু লেখক সে সব না দেখিয়ে দেখালেন অন্যের অসুবিধায় গুটিকয়েক মানুষ কেমন করে নিজেদের সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে। প্রশাসনের লোকেরাও আবার সেই সুযোগ থেকে ভাগ, বাটোয়ারা নিচ্ছে। আর অবশেষে তাহের আলীর পরিণতিতে মনে হলো ইশ! সব রহস্য যেন রহস্যই রয়ে গেল।

দ্বিতীয় গল্প ' দুপুরের পাড়ে পুকুরের আড়ে' এ গল্পের অ্যামোলিয়া হার্ডসন চরিত্রটিও এক অদ্ভুত চরিত্র। বংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন তরুণী বিশ বাইশ বছর পর সুদূর লন্ডন থেকে এসেছেন শৈশবের পুকুরের সাথে কথা বলতে, পুকুরের থেকে পরামর্শ নেবে। কী অদ্ভুত! একজন মানুষ কোনো মানুষের কাছ থেকে নয় একটি পুকুরের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে চায়। এ থেকে বোঝা যায় অত্যাধুনিক শহরে বড় হলেও,  জীবন যাপন করলেও অ্যামোলিয়ার নিজের কথা বলার বা তার কথা শোনার মতো মানুষ তিনি সেই দেশে পায় নাই। তিনি ভেতরে ভেতরে একা।  যে কারণে ফিরে আসতে হয়েছে একটুখানি আশ্রয় আর শান্তির জন্য শৈশবের ফেলে আসা পুকুরের কাছে। সেই পুকুর যখন অ্যামোলিয়া খুঁজেই পেল তাহলে এমন কাণ্ড ঘটালো কেন?  সেই কাণ্ডে হতবাক হয়ে বসে থাকা ছাড়া পাঠকের আর কোনো উপায় থাকে না।

 

'মাইনাসে মাইনাসে প্লাস প্রোগ্রাম 'গল্পটির প্লট একেবারে অজানা নয়। যারা একটু বোধ সম্পন্ন তারা বাস্তবে ঘটে যাওয়া আশেপাশের ঘটনাগুলো থেকে অল্প হলেও বুঝতে পারেন যে মাঝে মাঝে রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বা হচ্ছে।কিন্তু বুঝতে পারলেও জানেন না কেমন করে, কোন উপায়ে এসব কলকাঠি নাড়া হয়। কারা থাকে সেসবের পেছনে। সেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই লেখক এই গল্পের প্লট সাজিয়েছেন।

 

শেষ গল্প 'প্রাণ প্রোডক্ট '। গল্পের নাম দেখে ভেবেছিলাম হয়তো প্রাণ কোম্পানির কিছু বিষয়-আশয় এতে থাকতে পারে। যতই গল্পের ভেতরে যাচ্ছি তখন মনে পড়লো আব্দুল জব্বারের ওই গানের কথা, 'মুখ দেখে ভুল কোরো না, মুখটা তো নয় মনের আয়না।' তেমনি নাম দেখেই অনুমান সব সময় সঠিক হয় না। এই গল্পটির প্রেক্ষাপট বেশ অভিনব ও চমকপ্রদ। আর এই গল্পের স্থানগুলো  আমার বেশ কাছের লাগছিল। কারন আমার বাড়ি স্বরূপকাঠিতে সম্ভবত লেখকেরও তাই।  আর এই গল্পটির প্লট নির্মিত হয়েছে স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ইট ভাটাকে কেন্দ্র করে। তাই গল্পের চরিত্রগুলোর ভাষাতেও বরিশালের আঞ্চলিকতা পাওয়া যায়। তবে এই গল্পে ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে  একটা খটকাও লেগেছে যেমন; গল্পে বলা হয়েছে ইট ভাটার যিনি কারিগর লতিফ তার বাড়ি কালিয়াকৈরে। তারমানে গাজীপুর উপজেলায়।  আর সেই কারিগরকে ইট ভাটার মালিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের হাজারখানেক ইট ভাটা থেকে সাতদিন ধরে খোঁজা খুঁজির পর সন্ধান পেয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে গল্পে কোথাও এই চরিত্রের অতীত ইতিহাসে বরিশালে কাজ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা দেখানো হয় নাই যেখান থেকে সে এই ভাষা আয়ত্ত করতে পারে। এমনকি কারিগরের আবার যিনি ওস্তাদ তার বাড়িও ওদিকেই তাহলে এই চরিত্র দুটি কেমন করে এত অবলীলায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন? এই বিষয়টিকে ভীষণ বেখাপ্পা লেগেছে। 
আর এই গল্পে ভালো ইট তৈরি না হওয়ার বিষয়ে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ' এই চরের মাটিতে বালুর আধিক্য।  তারা গায়ে গায়ে মেশে না। ছাড়াছাড়া ভাব নিয়া জীবন পার করে দেয়। এ দিয়া জাতের ইট হবে না। তার জন্য চাই আঁঠালো, সদ্য বিয়া করা বউ-জামাইয়ের মতো গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে ধরে থাকা মাটি'। এই উপমাটি দারুণ লেগেছে। এখানে শুধু ইটের কথা না ভেবে যদি মানুষে মানুষের সম্পর্ক কিংবা কোনো  কাজের কথাও ভাবি তাহলেও এ উপমাটি বেশ যায়!

 

সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় গল্পের সমাহারে বইটি এককথায়  সুখপাঠ্য ।  বইটি প্রকাশিত হয়েছে এতিহ্য  থেকে ২০২৪ এর একুশে বই মেলায়। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মুদ্রিত মূল্য মাত্র ১৮০ টাকা।