ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর
( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )
পার্থসারথি
পর্ব-০২
প্লিজ কিছু মনে করিস না। আজকের দিনটা ম্যানেজ করে নে।
তুই আসলেই একটা উদ্ভট প্রকৃতির মানুষ। এই মেঘ, এই রোদ্দুর। সকালে খোশ মেজাজে এক সাথে বের হলাম। আর পরক্ষণ থেকেই দেখি তোর মেজাজ কালো মেঘ হয়ে আছে, ব্যাপারটা কী? তোকে কি কেউ কিছু বলেছে?- অনিক জানতে চায়।
আমাকে কে আবার কী বলবে?- না তাকিয়েই সৈকত জবাব দেয়।
তাহলে অমন গোমরামুখো হয়ে বসে আছিস যে?
সুখে!- কন্ঠে কপট-রাগ ঝরিয়ে সৈকত বলল। আর মনে মনে বলল, তোকে সত্যি কথাটাই বললাম। অনিক আর কথা বলল না। তবে প্রতি পদক্ষেপে অভিমান ঝরে পড়ল। অনিক চলে যেতেই সৈকত আপন মনে হাসল; জানিস না অনিক, আমি আনন্দের দাপটে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
*
পরদিন সকালবেলা। হাঁটার চটাচট শব্দে অনিকের ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে তাকাতেই ব্যস্ত সৈকতকে দেখতে পেল। কোন কথা বলল না অনিক; শুয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিল। আটটা বেজে পঁচিশ। সৈকত ভেজা চুলের উপর গামছা বুলাচ্ছে। অনিক অবাক হয়ে ভাবল, ক্লাস তো সেই এগারোটায় তাহলে এত সকালে স্নান করল কেন? কিন্তু কোন কথা বলল না। শুয়ে থেকেই সৈকতকে চুপচাপ দেখছে। গেঞ্জি ছাড়াই শার্ট পরে প্যান্টটা টেনে নিল। প্যান্ট পরা শেষ হতেই গেঞ্জির ওপর চোখ পড়ল। শার্ট খুলে আবার ঠিক করে পড়ল। মোজা ছাড়া কেডস পড়ে আবার ঠিক করে নিল। অনিক না হেসে পারল না। হাসির শব্দে অনিকের দিকে ফিরে তাকাল সৈকত- হাসছিল কেন?
হাসতে হাসতেই অনিক জবাব দিল- হাসছি তোর কান্ডে দেখে। সৈকত কথার জবাব না দিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হল। আসলে নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত। কারণ অনিকের হাসি কানে পোঁছামাত্র লজ্জায় কিছুটা গুটিয়ে গেছে। ঘটে যাওয়া ভুলগুলো তাহলে অনিক চুপি চুপি দেখেছে? সৈকত জানে, এরকম ভুল সাধারনতঃ সে নিজে খুব একটা করে না। কিন্তু এখন পরপর অনকেগুলো ভুলের পুনরাবৃত্তি হল। আর সবকিছু চুপচাপ অনিক দেখছিল তা' সে একদমই খেয়াল করেনি।
এত সকালে স্নান সেরে ফুলবাবু সেজে যাচ্ছিস কোথায়?- তীর্যক চোখে অনিক সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলে কথাগুলো।
রাতে ভাল ঘুম হয়নি তাই সকাল সকাল স্নানটা সেরে নিলাম। ক্লাসের আগে কিছুটা লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হবে তো তাই একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছি। তুই ক্যাম্পাসে ক’টায় আসবি?- সৈকত খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল।
আমার ক্লাস এগারোটায়।
ঠিক আছে, আমি যাই।- এই বলে ক্লিপ ফাইলটা হাতে তুলে দরজার বাইরে পা বাড়ায় সৈকত। পায়ের ওপর পা তুলে, মাথার নীচে হাত-জোড়া রেখে অনিক ভাবতে লাগল; ব্যাপারটা কী! রাতে ঘুম হয়নি। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে পরপর ভুল। গত দেড় বছরের বন্ধুত্ব কিন্তু এর মাঝে তো এসব চরিত্রগুলোর সাথে সৈকতের মিল খুঁজে পাচ্ছে না অনিক। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করল। ‘খট’ শব্দের পর দরজাটা খুলে গেল। খুব তাড়াহুড়া করে সৈকত ঘরের ভেতর ঢুকল।
কী ব্যাপার, আবার কী হল?- সৈকতকে অনিক জিজ্ঞ্যেস করে।
ঘড়িটা ফেলে রেখে গেছি। ঘড়িটা হাতে লাগাতে লাগাতে দরজার দিকে এগোচ্ছে সৈকত। পেছন থেকে অনকি ডেকে রসিকতা করে বলে, চিন্তা করে দেখ আরও কিছু ফেলে গিয়েছিস কিনা। ঠাট্রটা বুঝতে পেরে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়েই আবার হাঁটতে শুরু করল সৈকত। বালিশটাকে জড়িয়ে ধরে উপুড় হয়ে শুলো অনিক। পেপারওয়ালা দরজার ফাঁক গলে কাগজটা রেখে গেল। আওয়াজ পেয়ে বিছানা ছাড়ল অনিক। কাগজটা হাতে নিয়ে বালিশে আবার মাথা রাখল। প্রতিদিন একই খবর আত্নহত্যা, ধর্ষণ, খুন, সড়ক দুর্ঘটনা! একদিনের দৈনিকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ঘটনা অনিকের মনটাকে বিমর্ষ করে দিল। শিরোনামগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে রেখে দিল কাগজটা।
*
সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কাছাকাছি এসে বারান্দায় তাকাল সৈকত। ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ নেই। তবে বারান্দাটা এক ঝাঁক তরুণ-তরুনীর দখলে আছে। সৈকত ব্যতিক্রম চত্বরের চলে এল। এখনও সার্কেলের কেউ আসেনি। অবশ্য এ সময়ে কারও আসার কথা ছিল না। সে ভালোভাবেই জানে। তবুও মনে মনে আশা করেছিল কেউ হয়ত এসে থাকবে। ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়ে এক কোণে গিয়ে সৈকত বসল। তাড়াহুড়া করে চলে আসাতে নাস্তা খাওয়া হয়নি। পিচ্চিটাকে ডেকে কেক দিতে বলল। সাথে এক কাপ চা-ও নিল। সবশেষে সিগারেট ধরাল। যেভাবে হল থেকে তাড়াহুড়া করে এসেছে আসলে এখন হাতে কোন কাজ নেই। ক্লাস সেই এগারোটায় আর লাইব্রেরিতে যাওয়ার মত ইচ্ছে আপাতত নেই। এক অজানা সম্মোহনে এখানে ছুটে এসছে সৈকত। গতকাল আনন্দের বন্যায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আজ মাত্র কয়েকটি ঘন্টার ব্যবধান কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছে বেশ কয়টি যুগ পেরিয়ে এসেছে। পারমিতাকে এক পলক দেখার জন্য সৈকতের মনটা উদগ্রীব হয়ে আছে। চোখের পলক ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাতক পাখি যেমন এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমিন সৈকত অপেক্ষা করছে এক পলকের দৃষ্টিসীমায় পারমিতার বিচরণ। ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠেছে ওর মন প্রাণ। ছায়া শীতল চোখ জোড়া এখনও হৃদয়ের অন্ধকূপে টিপটিপ করে হাঁটছে। অনুভবে আনন্দের শিহরণ খেলে যায় সারা শরীরে । এক ফাঁকে ঘড়ি দেখল; দশটা বেজে পাঁচ।
কি-রে শালা, কার জন্যে অপেক্ষা করছিস?- সৈকতের পিঠে থাপ্পর দিয়ে সুমন্ত বলে।
সৈকতের ভাবনায় যতি পড়ল। নিজেকে সামলে নিয়ে সৈকত বলল- কই না-তো?
তাহলে বসে বসে ধ্যান করছিস আর সময় দেখছিস কিসের জন্য।
তুই এত দেরি করলি কেন?
তাড়াতাড়ি আসার কথা ছিল না কি?- সুমন্ত বেশ অবাক হয়ে তাকায় সৈকতের দিকে।
না মানে, আশা করেছিলাম।- সৈকত বেশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলে।
শালা, কথা কাটাতে চাচ্ছো না? ডুবে ডুবে কোন ঘাটে জল খাচ্ছো, সেটাই বলো।
আরে ধ্যাৎ সে ভাগ্য কি আর কপালে আছে? আবার ডুব দেব কোথায়?
কথার মাঝখানে মাকসুদ এসে হাজির। কথার মোড় ঘুরে গেল। অনেকক্ষণ এলোমেলো কথা হল। দেশীয় থেকে আন্তজার্তিক পর্যায়ে পৌঁছে গেল সেই আলোচনা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কোনটাই বাদ পড়েনি। মাকসুদ আসফির উদ্দেশে সুমন্তকে বলল- কি-রে শুকনা আসতে এত দেরি করছে কেন?
চলবে…