ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-০৩
সুমন্ত রসিকতা করে বলল- আসবে বাছাধন, সবুর করো হাকিম চত্তর পেরিয়ে তবে আসবে।
সৈকত কিছুটা রাগত কণ্ঠেই বলল- তোদের এভাবে কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। শুনলে আসফি কষ্ট পাবে।
মাকসুদ ও সুমন্ত জবাবে কোন কথা বলল না। শুধু অপরাধীর মতো একজন অন্যজনের দিকে তাকায়।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সৈকত এদিক-ওদিক চোখ রাখে। কিন্তু পারমিতার দেখা মেলেনি। পৌনে এগারোটা নাগাদ অনিক এল। এসেই তাড়া দিল, চল ক্লাসে চল।
সবাই উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সৈকত কেমন যেন একটু গড়িমসি করছে। আসলে পারমিতার দেখা না-পেয়ে সৈকতের মনটা কেমন যেন বিরস হয়ে আছে। এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল; এই বুঝি এলো, এই বুঝি এলো এমনই প্রত্যাশায়। কিন্তু এখনও পারমিতার দেখা মেলেনি। অনিক আবার তাড়া দিতেই সৈকত ওদের সাথে হেঁটে চলল।
পারমিতার বড়দিদি সুদেষ্ণা। স্বামীসহ ধানমন্ডি পনের নম্বর থাকেন। ভাড়া বাসা। স্বামী অভীক মজুমদার ব্যাংক কর্মকর্তা। দিদিদের নতুন সংসার।
দিদির পীড়াপীড়িতেই পারমিতাকে প্রায়ই বাসায় যেতে হয়। দুলাভাইটি বেশ ভালো মানুষ। বাসায় বেড়াতে গেলে বেশ খুশী হন। দিদি বলেছিলেন, নববর্ষের দিন দুপুর বেলায় বান্ধবীদের নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু পারমিতা গতকাল সন্ধা পর্যন্ত টিএসটিতেই বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কাটিয়েছে। তারপর রুচিরাকে নিয়ে বাসায় এলো।
গতরাতটা পারমিতার এক অচেনা আচ্ছন্ন জগতে কেটেছে। সৈকতকে দেখার পর থেকেই প্রতিটি মূহূর্ত কেটেছে ভাবনার অতলে ডুবে ডুবে। এমন তো তার কখনও হয়নি। দেখার পরই পারমিতার মনে হয়েছে সৈকত যেন ওর কাছে যুগ যুগ ধরে চেনা। মাঝখানে কিছুদিন অন্তরাল। আবার দেখা। অথচ সত্যিকার অর্থে সৈকতের চোখ জোড়ায় পারমিতা গতরাত সর্বক্ষণ ডুবেছিল এক অদৃশ্য টানে। আর সবসময় ডুবেছিল এক গভীর ভালো লাগার আচ্ছন্নতায়। সবকিছুই কেমন যেন ভালোলাগায় সর্বক্ষণ ভরপুর থাকে। অথচ মনটা থাকে সর্বদা ব্যকুল আর উদাসীন। পারমিতা ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করছিল। কিন্তু রুচিরাকে তা বুঝতে দেয়নি। যতই রাত বাড়ছিল ততই যেন সৈকতকে দেখার ইচ্ছেটা অবাধ্য হচ্ছিল। পারমিতার ভাবনার জগৎ জুড়ে এখন শুধু সৈকত।
পারমিতা ও রুচিরা যখন বাসার বাইরে পা বাড়াল তখন বেলা সকাল ৯টা কী সাড়ে ৯টা হবে। রিকশা নিয়ে সোজা ক্যাম্পাসে চলে এল।
ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পারমিতা বলল, রুচিদি আপনি সৈকতকে নিয়ে এসে এখানে অপেক্ষা করবেন। আমি ক্লাসটা সেরেই সোজা এখানে চলে আসব।
রুচিরা চলে আসে দর্শন বিভাগের সামনে, তেমন কেউ নেই এখানে। রুচিরা মনে মনে ভাবল, দাঁড়ালে অন্ততপক্ষে একটা ঘন্টা দাঁড়াতে হবে। তাও আবার একা। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। রুটিন বোর্ডটার দিকে রুচিরা এগিয়ে যায়। রুটিন বোর্ড থেকে খুঁজে বের করে নেয় সৈকতের ক্লাসরুমের নম্বরটা। তারপর হেঁটে চলে ওই দিকে।
স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কয়েকবার এপাশ ওপাশ হাঁটল রুচিরা কিন্তু সৈকতকে চোখের সীমানায় আনতে পারেনি । তারপর সৈকতকে দেখা যায় এমন জায়গায় দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই সৈকতের চোখ রুচিরার ওপর পড়ল। রুচিরা সৈকতকে চোখে ইশারা করল বেরিয়ে আসতে।
মিনিট পাঁচেক পরই সৈকত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসেই সৈকত বলল, কী ব্যাপার রুচিদি? হঠাৎ ক্লাস রুমেই ডাক পড়ল।
রুচিরা হাত ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর বলল- চল এক জায়গায় যেতে হবে। কথাগুলো বলেই রুচিরা হাঁটতে শুরু করল।
সৈকত কোন কথা বলল না। রুচিরার পায়ের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছিল পারমিতার কথা জিজ্ঞ্যেস করে। কিন্তু কথাটা বুকের ভেতরই বারবার ঘুরপাক খেল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে এসে রুচিরা বলল- এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। ক্লাস শেষেই পারমিতা চলে আসবে।
পারমিতার কথাটা কানে পোঁছামাত্রই সৈকত যেন বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হল। তন্ময়তার ঘোর ভাবটা কাটিয়ে সৈকত বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। সৈকতের কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন একটু অচেনা মনে হল। আসলে পারমিতা ওর ভাবনার অলিতে-গলিতে বিচরণ করছিল। তাই স্বর ফুটে কথাটুকু সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেনি। আর রুচিরা ভাবল, হয়ত সৈকতের ক্লাসটা করার ইচ্ছে ছিল অথবা অন্যকিছু। তাই রুচিরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- সৈকত কিছু মনে করো না প্লিজ, তোমাকে ডেকে এনে অসুবিধায় ফেলিনি তো?
সৈকত বালকসুলভ অভিমানে বলল- দিদি, আপনি এতদিনে আমাকে এতটুকু চিনলেন?
রুচিরা দুহাতে সৈকতের একটা হাত টেনে ধরে বলল, প্লিজ লক্ষী ভাইটি রাগ করো না। আসলে আমি কথাটি ওভাবে বলিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর সৈকত রুচিরার দিকে তাকায়। রুচিরা সৈকতের হাত ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি হয়ে দেয়ালে কনুই চেপে দাঁড়ায়। সৈকত বলে- রুচিদি, যে কোন কাজে এই ছোট ভাইটিকে স্মরণ করবেন। দেখবেন বান্দা হাজির।
রুচিরা মিষ্টি হেসে বলে- ঠিক আছে, অবশ্যই ডাকব।
চলুন, চা খেয়ে আসি। হাতে এখনও অনেক সময় আছে।- প্রসঙ্গ ঘোরাবার প্রয়াসে সৈকত বলে।
রুচিরা বলে- পারমিতা আসুক। একসঙ্গেই খাওয়া যাবে, কি বলো?
হ্যাঁ, অবশ্যই। রুচিরার কথাটুকু সৈকতের খুবই ভালো লেগেছে। আর সত্যি বলতে কি, সৈকত মনে মনে এটাই চেয়েছিল।
তারপর পারমিতার জন্য অপেক্ষা । সময় পেরিয়ে পারমিতা এসে হাজির হয় যথাসময়ে। সৈকতের কাছাকাছি হতেই পারমিতা কিছুটা অপ্রস্তত হয়ে যায়। সৈকত পারমিতার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। দু'জনার মনের ভেতর হাজার হাজার কথা লুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কাউকে কিছুই বলতে পারছে না। চোখে চোখ রেখে মনের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে অথচ ওরা একজন অন্যজনের দিকে ঠিকভাবে তাকাতেই পারছে না। সর্বদা এক অস্থিরতা চেপে বসছে।
অপ্রস্তুতের ছন্দপতন ঘটিয়ে পারমিতা বলে- আপনাদের অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম দিদি।
রুচিরা বলে- সময়টা খারাপ কাটেনি। সৈকতকে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এসেছি।
সৈকতের দিকে তাকিয়ে পারমিতা হাসে। পারমিতার হাসিতে সৈকতের ভেতর ভুবন কেঁপে ওঠে। প্রকাশ পায় হাসিতে। দিদি, চলুন চা খাওয়া যাক।- এই বলে সৈকত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
হ্যাঁ, চল।- রুচিরা বলে।
তারপর হাঁটতে শুরু করে। চলে আসে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াতে। রুচিরা পার্সে হাত ঢুকাতে যায়। সৈকত বলে- আপনারা গিয়ে বসুন, আমি নিয়ে আসছি।
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে সৈকত কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়। রুচিরা পেছন থেকে ডেকে বলে দেয়- শুধু চা হলেই চলবে।
চলবে…