ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-০৪
সৈকত কোন জবাব দেয়নি। রুচিরা ও পারমিতা একটা টেবিল দখল করে পাশাপাশি বসে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ট্রে হাতে সৈকত হাজির হয়। তিনটি সমোচা, তিনটি সিঙারা আর তিন কাপ চা। ট্রে-টা টেবিল রাখতে রাখতে সৈকত বলল- আমি পানি নিয়ে আসছি, একটু বসুন।
সৈকত এক দৌঁড়ে গেল আর এল। তারপর পানির দুটো গ্লাস টেবিল রাখল। ট্রে-টা পারমিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে সৈকত বলল- নিন, শুরু করুন।
পারমিতা হাত বাড়িয়ে একটা সমোচা তুলে নেয়। রুচিরা একটা সমোচা হাতে নিতে নিতে বলল- সৈকত, আপনি নয়, তুমি বল, ও তোমার পরের ইয়ারে।
হয়ে যাবে, কিছুক্ষণ আপনি আপনি চলুক, তারপর হয়ে যাব।- কথা শেষ করে সৈকত হাসে।
রুচিরা বলে- আপনি বলার কোন প্রয়োজন নেই।
রুচিদি ঠিকই বলেছেন। আপনি আমার সিনিয়র অতএব এখন থেকেই আমাকে তুমি বলবেন। -পারমিতা খুব সুন্দরভাবে কথাগুলো গুছিয়ে বলে।
এটা-সেটা আলাপ-চারিতায় চা-পর্ব শেষ হয়। তারপর ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওরা বের হয়ে আসে। এক রিকশায় তিনজন চেপে বসে। সৈকত বসল সিট ব্যাকের উঁচুটায়। আর ওরা দু’জন সিটে বসল। রিকশা আসাদ গেটের উদ্দেশে রওনা হল। সৈকত বারবার ভাবছে; পারমিতা এত নিকটে আসবে তা গতকালও ছিল স্বপ্ন। নিজস্ব ভুবনে সৈকত মশগুল। অবশ্য পারমিতাও এই মুহুর্তে সৈকতের সংস্পর্শে এসে সিজেকে সুখী জগতের একজন বাসিন্দাই ভাবছে।
আড়ংয়ের সামনে এসে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে শেষে রুচিরা বলল- তোমরা নিচেই অপেক্ষা কর। আমি কাজটা সেরে আসি। কী বল পারমিতা?
মাথা কাত করে পারমিতা বলে- হ্যাঁ, ঠিক আছে।
রুচিরা সিঁড়িতে পা রাখে। অদৃশ্য হয়ে যায় ওদের চোখের সীমানা থেকে।
সৈকত পারমিতাকে বলে- চলো, আমরা মার্কেটটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।
হ্যাঁ, মন্দ হয় না, চলুন।- মুক্তা ঝরানো হাসি ছড়িয়ে পারমিতা বলে।
সৈকত ও পারমিতা এদিক-ওদিক কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। দু’জনার মাঝে কথাবার্তা খুবই কম হচ্ছে। সৈকতের ইচ্ছে হচ্ছে পারমিতার সাথে কথা বলার। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে তেমন কোনো ধারাবাহিকতা পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল। রুচিরা আসেনি এখনও। ওরা আবার হাঁটতে থাকে। দু’জন পাশাপাশি । এক সময় কোনো কথা খুঁজে পায় না সৈকত । আর পারমিতাতো সেই কখন থেকে চুপচাপ শুধু শুনেই যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর সামনে এসে অপ্রয়োজনীয় অথচ মনোযোগী দৃষ্টি বুলাচ্ছে দু’জন। পেছন থেকে রুচিরা ডাকে। কাছাকাছি হতেই রুচিরা সহাস্যে বলে- আজ চাকরিটা কনফার্ম হল।
সৈকত ও পারমিতা দু’জনই একসাথে বলে ওঠে- কনগ্র্যাচুলেশানস্।
দু’জনের খুশীতে রুচিরার মনটা পুরোপুরি সুখী হয়। তারপর বলে- আজ সারাদিন তোমাদের নিয়েই ঘোরাঘুরি করবো। কি বলো, তোমাদের কারও আপত্তি নেই তো?
দু’জনই একসাথে বলে- না। সৈকত হাসতে হাসতে বলে- এতবড় সুখবর! ঘুরবো আর মজা করবো সারাদিন। কী বলো পারমিতা?
একদম ঠিক। আজ সারাদিন শুধু মজা করবো।- পারমিতার কথায় যেন সকল ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে।
মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে রুচিরা বলে- তোমাদের এই ভালোবাসায় যেন সারাজীবন থাকতে পারি।
অবশ্যই রুচিদি।- সৈকতের মুগ্ধতায় পারমিতাও বেশ খুশী হয়।
রিকশা নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে আসে। দুপুরের খাবার পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনেই খায়। তারপর সবুজ ঘাসের বুকে পেতে বসে চলে গল্পের পশরা। এখানেই সৈকত ও পারমিতা একজন অন্যজনের কাছে পরিচিত হয় নতুনভাবে । গল্পের ভেতরই পারমিতা খুঁজে পায় মনের মানুষের আংশিক চেনা আঙিনা। আকাশ যেমন সবুজ প্রান্তকে ছুঁয়ে থাকে তেমনই দূরত্বে থেকেও সৈকত ছুঁয়েছে পারমিতার মনের বাগানকে । সন্ধ্যা নাগাদ ওরা টিএসসির দিকে পা বাড়ায়।
*
সৈকতের মনটা বিশেষ ভালো নেই। সৈকত, পারমিতার প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই ভেবেছিল সে যেমন পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে তেমনিই পারমিতাও । এই যে এখন, মনটা মেঘলা আকাশের মত তবু এখনও পারমিতার ভাবনায় সৈকত নিমগ্ন। পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে পারার শুরুটা পেলেই সৈকত রাজা হয়ে যায়।
আচমকা পরিচয় । প্রথম দেখাতেই সৈকত সমুদ্রের গহীন ঢেউয়ে তলিয়ে যায়। একসময় নিজেকে আবিস্কার করে পারমিতা নাম্মী মেয়েটির কৃষ্ণ-কালো গভীর চোখে। পারমিতাকে দেখার ইচ্ছেটা সময়-অসময় মানে না। প্রতিটি মুহূর্তকে সুসময় মনে করে সৈকত। অথচ সেই যে তিনজন সারাদিন একসাথে কাটিয়েছিল, তারপর পারমিতার আর পাত্তা নেই। পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। সৈকতের মনটা কেমন যেন চঞ্চলা হরিনীর মতো উদভ্রান্ত হয়ে আছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পারমিতার খোঁজে ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়েছে। এদিক-সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজি। সবই অবশ্য মনে মনে। মনের মধ্যে এক অসহ্য যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি।
এদিকে আবার রুচিরাকেও খুঁজে নাগাল পাচ্ছে না সৈকত। বিমর্ষচিত্তে সৈকত লাইব্রেরি বারান্দায় বসে আছে। হাতে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ছে। দৃষ্টি নিঃসীম আনমনা। থেকে থেকে সিগারেটে দিচ্ছে লম্বা টান। আবার মনে মনে হেঁটে চলে যাওয়া লোকজনের ভীড়ে পারমিতাকে খুঁজছে সৈকতের দুটি অস্থির চোখ। আশেপাশে সুখের অনুরণনকে বাতাসে ছড়াচ্ছে অজস্র সুখের নিঃশ্বাস। অথচ কোনকিছুই সৈকতকে স্পর্শ করছে না। চোখের জলসায় শুধু পারমিতার অবাধ বিচরণ। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে সৈকতকে দেখতে পেল রুচিরা। কাউন্টার থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। এগিয়ে গিয়ে সৈকতের পাশে বসল কোন কথা না বলে। সৈকত টের পায়নি; গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। রুচিরা ইচ্ছে করেই অস্তিত্বকে জানান দিল গলা-খাকাড়ি দিয়ে। সৈকতের ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে। তারপর ভাবলেশহীন জিজ্ঞাসা- কখন এলেন?
অনেকক্ষণ! অথচ তুমি একটুও টের পাওনি। এত গভীর হয়ে কী ভাবছো?- বলতে বলতে রুচরিা সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না, এমনি। নির্দিষ্ট তেমন কিছুই না।- সৈকতের কণ্ঠে পাশ কাটানোর প্রয়াস।
রুচিরা বুঝতে পেরে কথার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায়, বলে- তারপর, এই ক’দিন তোমার যে দেখা পেলাম না?
সৈকত একটু আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে- আমারওতো একই প্রশ্ন!
রুচিরার জবাব- যদিও আমি কিছুটা ব্যস্ত ছিলাম তবুও তোমাকে মনে মনে অনেক খুঁজেছি।
হলে গেলেই পারতেন।- সৈকত বেশ অভমিান ভরা কন্ঠে বলল।
হলে যেতে আলসেমি ধরে যায়। তাছাড়া ব্যতিক্রম চত্বরে এসে খোঁজ নিয়েছিলাম। যাক তারপর বল তোমার খবর কি?
চলবে…