ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )
*পার্থসারথি
পর্ব-০৮
কথার পিঠে কোন কথা আমি বলছি না। কিন্তু মা বলেই চললেন- আগামীকাল তোর বাবা গিয়ে কথা বলে আসবেন। তারপর উনারা এসে তোকে দেখে যাবে।
মা’র আরও অন্যান্য কথা থেকে জানা গেল, ছেলে গত দশ বছর যাবৎ আমেরিকায় থাকে। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে আটত্রিশ । বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ছেলের মা চাচ্ছেন ছেলেকে বিয়ে-শাদী করিয়ে দেশেই আটকে রাখতে। ছেলে আমাদের পাশের গ্রামের। মা'র সব কথা শেষ হলে আমি বলি- এখন বিয়ে-শাদী করব না। আগে লেখাপড়া শেষ করি । তারপর যা বলবে সবই শুনব।
মা আমাকে আদর করতে করতে বললেন- লক্ষীসোনা আমার। ছেলেটা খুবই ভালো। না করিস না। বেশ টাকা-পয়সা আছে। তাছাড়া বিয়ের পর তোর লেখাপড়া তুই করে যাবি। এমন একটা পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বিদেশ ফেরত । দেখতে সুন্দর। ছিমছাম গোছানো পরিবার। আমরা যেমন চেয়েছিলাম তার চেয়েও ভালো। সবসময় এমন সম্বন্ধ পাওয়া যায় না। তাছাড়া আমাদের পাশের গ্রামের।
এসব জানাই কি যথেষ্ট? তাছাড়া ছেলের বয়স আমার দ্বিগুন হবে।- আমি মাকে বলি।
মা আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন- ছেলেদের এই বয়স এমন কিছু নয়। বরং ওরা একটু সংসারী হয়। তুই অমত করলে তোর বাবা ভীষণ রাগ করবেন এবং আমিও খুব কষ্ট পাবো।
এতে রাগ করার কী আছে? আমি এখন বিয়ে-শাদী করবো না।- দৃঢ়কণ্ঠে বলার চেষ্টা করি।
বিয়েতে ছেলে-পক্ষের কোন দাবি-দাওয়া নেই। তুইতো বুঝতেই পারিস, তোর বাবার পক্ষে খরচপাতি করে তোকে বিয়ে দেয়ার মত সাধ্য নেই। তুই অমত করে তোর বাবাকে কষ্টে ফেলিস না।
মার কথা শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকি। একসময় মা ঘুমিয়ে পড়েন। আর আমি সারারাত কান্নায় বুক ভাসাই। নানান চিন্তায় সারারাত ঘুরপাক খাই। কোন কূল কিনারা পাইনি। কী করবো না করবো ভেবেই দিশেহারা; আমি অনন্যোপায় হয়ে অভিমান বুকে চাপা দিয়ে চুপচাপ থাকলাম। কারণ আমার কোন কথাকেই মা কিংবা বাবা কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। অবাধ্য হয়ে যে বেঁকে বসে থাকবো তা'ও পারছিলাম না।
পরদিন বাবা স্কুলে গেলেন না। ছুটি নিয়ে সোজা ছেলের বাড়ি গেলেন। বিকেল বেলা ফিরে এসে জানালেন- ছেলে, পরিবার, বাড়ি সব মিলিয়ে শতভাগ পছন্দ হয়েছে। ছেলেপক্ষ আগামীকাল আমাকে দেখতে আসবে।
আমার কোন না-ই বাবা কিংবা মা শুনলেন না। মা এবং বাবার ধারণা এর চেয়ে ভালো পাত্র আমার জন্য জুটবে না কিংবা জুটাতে পারবেন না। তারপর আমি নীরব থেকে গেলাম। আমার অমতেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
এটুকু বলার পর রুচিবার চোখে মুখে যেন রাজ্যের ক্লান্তি জড়িয়ে এল। চোখ ছলছল করছে। ঠোঁটের কাঁপন স্পষ্টই দেখতে পেল পারমিতা। পারমিতা একেবারে চুপচাপ । কথাগুলো শুনে ভীষণরকম খারাপ লাগছে। রুচিরা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে চলে- তুমি আমার ছোটবোনের মত। এরপরও তোমাকে বলব।
কথা শুনতে শুনতে পারমিতার মনটা ক্রমশঃ খারাপ লাগায় প্লাবিত হচ্ছে। তবুও পারমিতা মাথা কাত করে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয়।
বাসর রাতটা থাকে প্রতিটি মানুষের জীবনে স্মৃতিময় অধ্যায়। বিশেষ করে মেয়েরা, এই রাতটি নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে রাখে। বাসর রাতের জন্য প্রতিটি মানুষের জীবন চলে অপেক্ষায় থাকা একেকটা প্রেমময় মহাকাব্য। অথচ আমার জীবনটা বাসর রাতেই তছনছ হয়ে গেল। বিয়েটা অমতে হলেও অনেক কথা মনের ভেতর সাজিয়ে রেখেছিলাম বাসর রাতে বলব বলে। অথচ লোকটা বাসর কুঞ্জে ঢুকেই অশ্লীল হাত দুটো এলোমেলোভাবে আমার সারা শরীরে চালায়।
আপনি বাধা দিতে পারলেন না? রুচিরার কষ্টটুকু পারমিতাকেও যেন গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল।
আর কিসের জন্যে বাধা দেব। আমার জীবনটাই তো ওর হাতের মুঠোর চলে গেল। ভাবলাম বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন সহ্য না করে উপায় নেই। তারপর লোকটা সারারাত নেকড়ের মত আমাকে খাবলে খাবলে উপভোগ করল। আমি নিরুপায় হরিণীর মত শুধু ছটফট করলাম। এভাবে প্রায় মাসখানেক চলল। আমার জীবনের সব রস, আনন্দ, দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে দিল। আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্পর্শে স্পর্শে নীল করে তুলল। সে কী বিভৎস স্মৃতি। মনে হলেই কষ্টগুলো চাড়া দিয়ে ওঠে হিংস্র নেকড়ের মতো। তখনই পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে একেবারে অর্থহীন মনে হয়; পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যই আমার চোখে কুৎসিত লাগে। পূর্ণিমার জোছনা ভরা আকাশ, এক আকাশ ভরা তারার ঝিকিমিকি কিংবা ভোরের সূর্যের উঁকি সবই অর্থহীন মনে হয় আমার কাছে। জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে রুচিরা যেন উত্তেজিত ও উন্মাদপ্রায় হয়ে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তবুও বলতে থাকে আবার- শেষ রাতটিতে লোকটা যেন সত্যি সত্যি নেকড়ে হয়ে গেল। আমি ক্লান্ত। কষ্টে নিঃশ্বাসটুকু ফেলার মত অবস্থা আমার নেই। অথচ আমার কষ্টের নিঃশ্বাস থেকেও যেন লোকটা স্বাদ ছেকে নিতে লাগল। অবশ হয়ে এল আমার শরীর । ঘুমের রাজ্যে যেন তলিয়ে গেলাম আমি।
ভোর রাতে যখন চেতন ফিরল চেয়ে দেখি লোকটি চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছে। আমার জ্ঞান ফিরেছে টের পেয়েই কাছাকাছি হয়ে বসল। আমি চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত কোন অনুভূতি টের পেলাম না। সম্ভবত যন্ত্রণায় অবশ হয়ে গিয়েছিল নিম্মাংশ।
লোকটা ডেকে আমাকে বলে- আমি আজই আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। এই জীবনে তোমার সাথে আমার আর দেখা না-ও হতে পারে। আমার ইচ্ছে নেই যদি-না ভাগ্য টেনে আনে।
আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। লোকটা বুঝতে পেরেছে যে আমি কিছুই বলব না। তাই আবার বলে চলে- আমি আগেই বিয়ে করেছি। আমার তিন বছর বয়সী এক ছেলেও আছে। তোমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার মা আমাকে জোর করে বিয়ে করিয়েছেন। অবশ্য বাবা থাকলে এই কাজটা করাতে সাহস করতেন না। যাই হোক, এসব বলে আর কোন লাভ নেই। আমি বাংলাদেশে থাকছি না, এটাই ফাইনাল। আমি কিন্তু আমার মাকে সব বলেছিলাম। এরপরও মা এমনটা করালেন। তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।
চলবে...