পোস্টস

উপন্যাস

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-১৩ )

১৬ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস )

*পার্থসারথি

পর্ব-১৩  

চিরকুটটি পারমিতার হাতে দিতে দিতে সৈকত বলে- কোন দুঃশ্চিন্তা করো না। বাসায় তাড়াতাড়ি যাও। 

পারমিতা নীরব। সৈকত আর কথা বাড়ায় না। বইপত্র জমা দিয়ে, কাউন্টার থেকে ব্যাগটা তুলে সৈকত ও পারমিতা রিকশায় চেপে বসে। সৈকত বাসায় যায়নি। পারমিতাকে নামিয়ে দিয়ে ওই রিকশাতেই ফিরে আসে। 

*

প্রভাময়ী দেবী। পারমিতার মা। সংবাদ পেয়েই তিনি গত সন্ধায় এসেছেন। ছেলে পাপ্পুকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। পারমিতার দাদাবাবু অভীক মজুমদারের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। কারণ ওদের আর কেউ এখন বাংলাদেশে থাকে না। গত বছর সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। 

প্রভাময়ী দেবী ঘরের এমাথা-ওমাথা পায়চারি করছেন। আর মাঝে মাঝে মনের অজান্তেই টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছেন। সেই দুপুর থেকে মেয়েটার ব্যথা ওঠেছে । নরমাল ডেলিভারি হল না। শেষ বিকেলে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সুদেষ্ণা মা-বাবার প্রথম সন্তান। তাই প্রভাময়ী দেবী খুবই আকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন সুসংবাদ পেতে। তিনি বেশ চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। কারণ ব্যথাটা বেশিই হয়েছিল। জামাই বুঝাল- মা, চিন্তা করবেন না। নরমাল ডেলিভারি না হলে সিজার করাবো। আজকাল আধুনিক চিকিৎসা । কোনরকম অসুবিধা হবে না। আপনি বাসায় থাকুন। পাপ্পু আর আমি যাচ্ছি। 

যাওয়ার আগে প্রভাময়ী দেবী ছেলে পাপ্পুকে বারবার বলে দিয়েছেন- আমার মেয়েটার অবস্থা জানিয়ে কতক্ষণ পরপরই ফোন করবি। 

অথচ সেই যে বিকেল বেলা ওরা গেল এই পর্যন্ত কোন সংবাদ জানায়নি। কাজের মেয়েটা কতক্ষণ পরপরই এসে বলছে- জেঠীমা, চিন্তা কইরেন না। কুনু অসুবিধা অইব না। আমার মনে হয় হেরা খুব ব্যস্ত আচে। হের লাইগ্যা ফুন করতে পারতেছে না। আফনে চেয়ারে বইন শইলডা ঠান্ডা অইব। 

কাজের মেয়েটা আপন মনে কথা বলেই যাচ্ছে। আর প্রভাময়ী দেবী নিজের আপন ভুবনে ডুবে আছেন গভীর চিন্তায়। চিন্তাক্লিষ্ট মনে শুধুই পায়চারি করছেন। কলিং বেলটা বেজে ওঠতেই কাজের মেয়েটা রীতিমত দৌড়ে যায়। প্রভাময়ী দেবীও পায়চারি থামিয়ে এগিয়ে যান। পারমিতা ঘরে পা ফেলতেই প্রভাময়ী দেবীর উৎকণ্ঠচিত্তে জিজ্ঞাসা করেন- এতক্ষণে এলি মা? 

পারমিতা কিছুটা ভড়কে যায়। কারণ মা এসেছেন সে খরব পায়নি পারমিতা। মাকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে- আমি একটু আগেই খবর পেলাম। খবর পেয়েই সরাসরি চলে এলাম। মা, দিদি ওরা কোথায় ? কাউকে দেখছি না কেন? 

তোর দিদিকে নিয়ে ওরা হাসপাতালে গিয়েছে। 

হাসপাতালে? দিদির কী হয়েরেন মা? আমি কিছুই জানতে পেলাম না।- পারমিতার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে গেছে। পারমিতা জানত যে ওর দিদি গর্ভবতী। তবে ডেলিভারী ডেটটা তো আরও সপ্তাহখানেক পর। তাই এ কথাটা মাথায় একদমই আসেনি। মার কথাটা শোনার পর বেশ হালকা লাগছে নিজেকে। তারপর মাকে আরও জড়িয়ে ধরে বলে- মা, তোমার নাতি হবে না নাকি নাতনী? 

মেয়ের কথায় প্রভাময়ী দেবী যেন একটু আনন্দিত হলেন। ভেতরের হাহাকার যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। প্রভাময়ী দেবীর মুখমন্ডলে উজ্জ্বল ছায়া আচমকা খেলে গেল। তারপর সোহাগী কণ্ঠে বলেন- কোনটিতেই আমার মন খারাপ হবে না। যা হবে তাতেই আমি সুখী। 

পারমিতা খুশিতে আটখানা হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে থেকেই বলে- মা এর জন্যেই আমি তোমাকে খু-উ-ব ভালোবাসি। 

প্রভাময়ী দেবীর উজ্জ্বল মুখখানা মূহূর্তেই আবার চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে গেল। মেয়েটার যে কী হলো কিছু জানতে পেলাম না। বারবার বলে দিলাম ফোন করিস । না, আর একদম ভালো লাগছে না। কথা বলতে বলতেই কণ্ঠস্বরটা কেমন ভারী হয়ে এল প্রভাময়ী দেবীর। 

কোন হাসপাতালে গিয়েছে, বলেছে কিছু ?- পারমিতা মাকে জিজ্ঞ্যেস করে। 

না-রে মা! আমাকে ওরা কিছুই বলে যায়নি।- এই বলে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন প্রভাময়ী দেবী। 

পারমিতা কাছাকাছি হয়ে বসল। প্রভাময়ী দেবী পারমিতাকে কাছে টেনে নিলেন। তারপর প্রায় কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন- মেয়েটা আমার কী যে কষ্টটা করল সারাদিন। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানতে পারছি না। 

পারমিতা সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে মাকে বলে- মা, কোন দুশ্চিন্তা করো না। ডেলিভারি কেস আজকাল কোন ব্যাপারই না। 

প্রভাময়ী দেবী সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন- ঠিক বলছিস তো মা? 

মাকে গলায় জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে- হ্যাঁ মা, তোমার সাথে আমি কখনও মিথ্যা বলি? 

মেয়ের কথায় প্রভাময়ী দেবী অনেকটা শান্ত হলেন। পারমিতার ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল। কাজের মেয়েটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথাই শুনছিল। পারমিতাকে আসতে দেখেই সরে গেল। পারমিতা এগিয়ে গিয়ে বলে- ‘রান্না-বান্না সব করে রেখেছিস তো? 

না দিদি, এখনও কিছুই রান্না করিনি। 

বসে থাকলে চলবে? খাবার রেড়ি করে রাখ।- এই বলে পারমিতা মায়ের কাছাকাছি এসে বলে- মা দাদাবাবু তো একটু পরেই আসবে। কিন্তু কিছুইতো রান্না করা হয়নি। পারমিতা ভাবে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলে কিছুক্ষণের জন্য মনটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকবে। 

মা তোমার হাতের রান্না দাদাবাবুর খুব পছন্দের। ওঠ মা, দাদাবাবু পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরবে। মাকে রীতিমত টেনেই তুলল। মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। পিছু পিছু কাজের মেয়েটাও। পারমিতা ক'দিন পরপরই বাসায় চলে আসে। কিছুদিন থাকে, তারপর আবার হলে চলে যায়। তাই কিছু জামা কাপড় এবং বইপত্র বাসাতে সবসময়ই থাকে। 

জামা কাপড় পাল্টিয়ে পারমিতা বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠে। পারমিতা রীতিমত দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন রিসিভার তুলল। প্রভাময়ী দেবীও ছুটে এলেন। পারমিতা কথা বলছে। প্রভাময়ী দেবী মনোযোগ দিয়ে মেয়ের কথাবার্তা শুনছেন। কিন্তু ওপার থেকে কি বলছে তাতো তিনি শুনতে পারছেন না। তাই চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা জড়িয়েই আছে। 

টেলিফোনটা রেখেই পারমিতা মাকে বলে- মা কোন চিন্তা করো না। ভাল একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছে। ওরা অনেকক্ষন চেষ্টা করেছে। নরমালি হবে না। অপারেশন করবে। একটু পরই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। 

প্রভাময়ী দেবীর পায়চারি আবার বেড়ে গেল। কয়েক চক্কর মায়রে পিছু পিছু পারমিতাও হাঁটল। তারপর খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলে- মা, অপারেশন শেষ হলেই পাপ্পু ফোন করে চলে আসবে। 

প্রায় দেড় ঘন্টা পর ফোন বেজে ওঠল।

 

চলবে...