পোস্টস

উপন্যাস

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর- (পর্ব-১৭)

১৬ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর ( ক্যাম্পাসভিত্তিক রোমান্টিক প্রেমের  ধারাবাহিক  উপন্যাস )

*পার্থসারথি

পর্ব-১৭ 

পারমিতা এবার নিজেকে একটু সামলে নেয়ার চেষ্টা করল। তারপর সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বলে- যা হওয়ার তা তো হবেই। প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই। আপনি একথা আর কাউকে বলবেন না। তাহলে কান্নাকাটি শুরু হয়ে যাবে। শেষ সময়টা দিদির অস্থিরতায় কাটবে তাহলে। তা হতে না দেয়াই ভালো। এ সময়টুকু আপনি দিদির কাছাকাছি থাকবেন সর্বক্ষন। আচ্ছা দাদাবাবু, দিদির ব্লাডটা আবার টেস্ট করালে কেমন হয়? 

আমিও ভাবছি আরেকবার টেস্টটা করাই। তোমার দিদিকে আর বেশিদিন রাখতে পারব না। বড়জোড় সপ্তাহখানেক। তোমার দিদিকে একটু সময় দিও। জীবনের শেষ মুহুর্তে যেন পূর্ণতায় ভরপুর থাকে।- এই বলে অভীক মজুমদার পারমিতার দিকে তাকায়। 

পারমিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অভীক মজুমদার পারমিতার মাথায় হাত রেখে বলেন- এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। এখন আমাদের শক্ত হতে হবে। মাকে কিন্ত বলো না। 

আর কোন কথা বলতে পারেননি অভীক মজুমদার। দুঃখ-ভরা বুকে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসেন। পারমিতা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদাবাবুর চলে যাওয়ার পথে। আবার রক্ত পরীক্ষা করানো হল। এবার দেখানো হল দেশের সেরা ডাক্তরদের আরেকজনকে। একই বক্তব্য, রোগী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। 

এই কথায় জীবনাচলের চঞ্চলতা থমকে আছে। পারমিতা কতক্ষণ পরপর দিদির সান্নিধ্যে যায়। বাচ্চাকে বুকে ধরে কষ্টের নিঃশ্বাসে কিছুক্ষণ সুখ নিতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। বরং বাচ্ছাটিকে কোলে নিলে দুঃখ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর বাকিটা সময় রুমের ভেতর চুপচাপ বসে থাকে। অভীক মজুমদার রুমে চুপচাপ বসে থাকেন আর একটার পর একটা সিগারেট টানেন। সিগারেটের ধোঁয়ার কুগুলী তো নয় যেন দুঃখের কুগুলী ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়। 

রুচিরা এবং সৈকত এখন প্রায় প্রতিদিনই বাসায় আসে। ওরাও দিদির খরবটা জানে। এসেই দিদির কাছে বসে কিছুক্ষণ। তারপর পারমিতাকে কিছুক্ষণ সান্তনা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকে না। যেদিন ওরা আসতে পারে না সেদিন ফোন করে খোঁজখবর নেয়। দিদি সুদেষ্ণার দুঃখ এবং কষ্টের মাঝে সবাই নীরবে ডুবে আছে। আর নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কষ্টের মুহূর্তগুলোতে গোপনে গোপনে শ্বাস ফেলছে।

পড়ন্ত বিকেল। দিদি বাচ্চাকে কোলে টেনে ঘুমিয়ে আছেন। দাদাবাবু রুমে নেই, অন্য কোন রুমে গেছেন। পারমিতা নিঃশ্বব্দে ঢুকে। দিদির কাছাকাছি এসে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই দিদি বলেন- পারমিতা বস, তোর সাথে কিছু কথা আছে। কথাগুলো বলতে দিদির খুবই কষ্ট হয়। দিদির শিয়রের কাছে পারমিতা বসে। দিদির মাথায় হাত রাখে। দিদি চোখ মেলে তাকায় । তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দেয় পারমিতার কোলের উপর। পারমিতা দু’হাত চেপে ধরে ব্যাকুল-চিত্তে দিদির দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করে- দিদি! 

দিদির দু’চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ফোটা গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া অসম্ভব রকমের শুকনো । জিহব্বা দিয়ে বারবার চেটে ভেজানোর চেষ্টা করছেন। কষ্টের নদী পেরিয়ে দিদির কণ্ঠে বেজে ওঠে- পারমিতা, আমার সময় মনে হয় শেষ হয়ে এসেছে। 

পারমিতা ভেতর জগৎ কেঁপে ওঠে। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করেনি। শুধু দিদির হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে থাকে। 

শুকনো জিহব্বা শুকনো ঠোঁটে ঘষে দিদি আবার বলে- আমার সময় খুবই কম। আমার সন্তান তোর কাছে রেখে যাচ্ছি। নিজের মত করে মানুষ করিস। মায়ের আদরের শূন্যতা যেন না বুঝে। আর তোর দাদাবাবুকে একটু দেখে রাখিস। খুব ভালো মানুষরে। জীবনে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। অথৈ কষ্টে ফেলে স্বার্থপরের মত চলে যাচ্ছি। তোকে আমি অন্যায় আবদারে বেঁধে যেতে চাই না। যতটুকু পারিস তোর দাদাবাবুর জন্যে করিস। কোন রকম ভুল বলে থাকলে আমার ওপর রাগ করিস না। 

পারমিতা নিজেকে আর সামলাতে পারে না। দিদির বুকে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দিদি তুই অমন কথা বলছিস কেন? তুই ভালো হয়ে ওঠবি। তুই ভালো হয়ে ও... ঠ... বি...!- বলতে বলতে পারমিতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। 

ঘরের ভেতর পা রেখেই কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে অভীক মজুমদার তাকায়। পারমিতা দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পিছিয়ে নিঃশব্দে চলে এলেন। 

মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অভীক মজুমদার একটার পর একটা সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। আর সুদেষ্ণাহীন দিনগুলোর কথা ভাবছেন। বুকের ভেতর শুধু কষ্ট। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। হঠাৎ সুদেষ্ণার ক্ষীণ কণ্ঠ কানে এল। অভীক মজুমদারের কাছে কণ্ঠটা অপরিচিতি মনে হল। বুকটা কেঁপে ওঠে অজানা আশঙ্কায়। সিগারেটটা এস্ট্রেতে গুজে সুদেষ্ণার কাছে এগিয়ে যান। হাতটা নেড়ে সুদেষ্ণা স্বামীকে কাছে ডাকে। অভীক মজুমদার স্ত্রী সুদেষ্ণার পাশে শোয়। সুদেষ্ণা খুব কষ্টে নিজেকে টেনে এনে স্বামীর বুকে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। দু’জনার মাঝে নিঃসীম নীরবতা। ভোর রাতে হঠাৎ করে অভীক মজুমদারের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে দৃষ্টি চলে যায়। আকাশ কিছুটা র্ফসা হয়ে এসেছে। মাঝে মধ্যে দু'একটা কাক কা-কা ডেকে ডেকে নতুন সকালের জানান দিচ্ছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে আসেন। হঠাৎ খেয়াল হয় সুদেষ্ণার নিঃশ্বাস কোনরকম স্পর্শ করছে না। পাথর খণ্ডের মত ঠাগুা হয়ে বুকের উপর পড়ে আছে। মাথাটা সরাতে গিয়েই টের পেলেন সুদেষ্ণা চলে গেছে দূর, বহুদূর! অভীব মজুমদার মাতৃহীন কন্যার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকান। বুকের ভেতরে এক সমুদ্র গর্জন। কিন্তু কাঁদতে ভুলে গেছেন। সময় যেন থমকে গেছে। 

রুচিরার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আরও পনের বিশ দিন লাগবে শেষ হতে। সৈকতের পরীক্ষা সামনের সপ্তাহেই শেষ হবে। আর আজই পারমিতার শেষ পরীক্ষা। রুচিরা ও সৈকতের আজ পরীক্ষা নেই। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে ওরা পারমিতার অপেক্ষায় আছে। পারমিতার প্রতিটি পরীক্ষায় ওরা থেকেছে। পরীক্ষা শেষে কিছুক্ষণ গল্প পরপর কয়েক কাপ চা। তারপর পারমিতাকে রিকশায় তুলে দিয়েছে। 

পারমিতা কমন রুমের দরজা দিয়ে বের হল। পারমিতাকে দেখতে পেয়েই সৈকত এগিয়ে গেল রুচিরাকে নিয়ে।

 

চলবে...