Posts

নন ফিকশন

শেষ জিজ্ঞাসা : দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে মানুষের জানা-বোঝার সীমানা

June 16, 2024

রনি আতিক

118
View

মোট চার পর্বে লেখাটি শেষ হবে। এখানে প্রথম পর্বের আলোচনা থাকল। এরপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে যথাক্রমে দর্শন, বিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনা থাকবে। আর শেষ পর্বে দর্শন ও বিজ্ঞানের সমন্বয় ও পুরো আলোচনার একরকম শেষ টানা হবে।

পর্ব : ১ 

।। গল্পের শুরু ।।

প্রতিটা মানুষই কতগুলা মৌলিক প্রশ্ন বুকে নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। প্রশ্নগুলো সরল কিন্তু গভীর; যেমন, আমি কে? আমি আসলাম কোথা থেকে আর আছিই বা কোথায়?

বড় হতে হতে এই জিজ্ঞাসা-ভান্ডারে যুক্ত হয় আরো কিছু প্রশ্ন : যেমন, চারপাশের জগতটা আসলে কেমন? জীবনের অর্থ কী? আর মৃত্যুই কি সবকিছুর সমাপ্তি?  

মানব-ইতিহাসে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছে নানা মিথ বা উপকথা, বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন, এবং বিজ্ঞান। কিন্তু উত্তর কি আদ্যেও মেলে? বেশির ভাগ মানুষই দেখা যায় একটা বয়সে এসে থিতু হন কোন একটা ব্যাখ্যায়, বোঝাপড়ায়। আর সামান্য কিছু মানুষ অতৃপ্তি নিয়ে চালিয়ে যান অনুসন্ধান। মূলত, এই গুটিকয়েকের নাছোড় লেগে থাকাই এগিয়ে নেয় মানব প্রজাতির সম্মিলিত জ্ঞানকান্ডকে। 

তো যে প্রশ্নগুলোর মারফতে প্রজাতি হিসাবে আমরা মানুষ হয়ে উঠেছি, আজকের এই সুষমা কিংবা ক্লেদমাখা সভ্যতায় পৌঁছেছি সেই প্রশ্নগুলোর সমাধানে, দর্শন ও বিজ্ঞান কতটুকু কী করতে পেরেছে বা করছে, এখানে আমরা সেই খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করব। জগত সম্পর্কে মানব জ্ঞানের সম্ভাবনা এবং প্রজাতি হিসাবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করব প্রধানত দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে।
 

।। আসিমভের গল্প : “শেষ জিজ্ঞাসা”।।

মূল আলোচনায় ঢোকার আগে আপনাদের সাথে আমার প্রিয় একটা গল্প শেয়ার করতে চাই। গল্পটা সাইন্স ফিকশনের অন্যতম গ্র্যান্ড ফিগার আইজ্যাক আসিমভের লেখা। আর বিশেষ এই গল্পটি শেয়ারের কারণ হল আমাদের আজকের আলোচনার কেন্দ্রে থাকা যে দার্শনিক দোদুল্যমানতা, অনিশ্চয়তা— আসিমভ এই গল্পে সেটা নিয়েই কাজ করেছেন।

গল্পটি ১৯৫৬ সালে লেখা। নাম “দ্য লাস্ট কোশ্চেন”। এখানে দেখা যায়, ২০৬১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ১০ ট্রিলিয়ন বছর ধরে মানুষ একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। যেটাকে আসিমভ নাম দিয়েছেন “লাস্ট কোশ্চেন” বা শেষ জিজ্ঞাসা। এই সুদীর্ঘ কাল ধরে, মানুষ প্রশ্নটা বারবার করতে থাকে— ক্রমশ উন্নত হতে থাকা একটা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কাছে। এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-কে তার বিকাশের সাথে তাল রেখে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আলাদা আলাদা নামে ডাকা হয়। Multivac থেকে শুরু হয়ে Microvac, GalacticAC, UniversalAC, CosmicAC এবং সর্বশেষ AC বা “Automatic Computer” নামে ঐ AI-কে সম্বোধন করা হয়।

তার কাছে জানতে চাওয়া মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হচ্ছে : “শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে প্রকৃতির যে স্বাভাবিক যাত্রা সেটাকে কি থামিয়ে দেয়া বা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব? সম্ভব হলে কীভাবে?”  শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলা বা অর্ডার থেকে ডিস-অর্ডারের দিকে প্রকৃতির এই স্বাভাবিক যাত্রাকে, বিজ্ঞানের ভাষায় এনট্রপি বলে। বরফ গলে যাওয়া, পানির বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাওয়া বা ফুটতে থাকা পপকর্ণ— সবই এনট্রপির উদাহরণ।

তো এনট্রপির বিষয়টা মানব প্রজাতির জন্য ক্রমশ বাঁচা মরার প্রশ্ন হয়ে ওঠার কারণ হল : সূর্যের মত মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রেরই এনট্রপি বাড়তে বাড়তে, তার রূপান্তরের একপর্যায়ে মৃত্যু ঘটবে। ফলে এনট্রপি উল্টানো সম্ভব না হলে—দূর ভবিষ্যত হলেও—মহাবিশ্বের সমাপ্তি একপ্রকার নিশ্চিত। ফলে, প্রাণ টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির কোনো উৎসই তখন আর অবশিষ্ট থাকবে না। কাজেই প্রশ্নটি মানব প্রজাতির ভবিষ্যত অস্তিত্বের সাথে সরাসরি জড়িত।  কিন্তু গল্পে দেখা যায়, পরবর্তী ১০ ট্রিলিয়ন বছরের মধ্যে মানুষ বা ঐ উচ্চতর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই প্রশ্নের কোন সমাধান করতে পারেনা। বারবার একই উত্তর জানাতে থাকে : “অর্থপূর্ণ উত্তরের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি”

উত্তর পাওয়া যে সম্ভব হয় না, তার কারণ কী হতে পারে? ঐ AI বা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা (এপিসটেমিক লিমিটেশন) নাকি কেবলই জগত সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের ঘাটতি? আমাদের আজকের পুরো আলোচনা এই প্রশ্নটির সাথে গভীরভাবে জড়িত।

গল্পে আমরা দেখি, ২০৬১ সালে প্রথমবারের মতো প্রশ্নটি উত্থাপনের পরবর্তী ১০ টিলিয়ন বছরের মধ্যে মানব সভ্যতা সৌরজগৎ, ছায়াপথ ও সারা মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, একসময় নিভে যেতে থাকে সব নক্ষত্র, ছায়াপথ আর সুপার ক্লাস্টার। প্রাণ টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির কোনো উৎসই আর অবশিষ্ট থাকে না। অনন্ত কালের জন্য, মহাবিশ্ব জুড়ে, নেমে আসে অন্ধকার।

শেষ অবলম্বন হিসাবে, অবশিষ্ট মানব সভ্যতা দৈহিক অস্তিত্ব পুরোপুরি ত্যাগ ক’রে নিজেদের কালেক্টিভ চেতনাকে যুক্ত করে নেয় ঐ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সাথে, যা আগে থেকেই চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের ঊর্ধ্বে, হাইপার স্পেসে অবস্থান করছিল। তবে আসিমভ তার গল্পের ইতি কিন্তু এখানেই টানেন নি। টানলে এটি হইতো মাস্টারপিস হয়ে উঠত না। সেই আলোচনা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক। 

এখন, যে উদ্দেশ্যে আসিমভের গল্পের অবতারণা সেই আলোচনা শুরু করা যাক।

।। শূন্য থেকে ।।

বিজ্ঞান অনুসারে, আজ থেকে প্রায় ১৩ শ ৮০ কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয় সময়ের, উৎপত্তি ঘটে শক্তি ও পদার্থের, জন্ম নেয় মহাবিশ্ব। 

মহাবিশ্ব সৃষ্টির আনুমানিক ৩ লক্ষ বছর পর গঠিত হয় প্রথম পরমাণুটি। পরমাণু হলো মৌলের ক্ষুদ্রতম একক, যা সরাসরি রাসায়নিক পরিবর্তনে অংশ নেয়। এই পরমাণুগুলো পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে আরো জটিল ধরণের কাঠামো তৈরি করে; যাকে আমরা ‘অণু’ বলি। সেখান থেকে নির্দিষ্ট কিছু অণু পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে, আনুমানিক ৩৮০ কোটি বছর আগে, বেশ জটিল ধরনের কিছু কাঠামো গঠন করে; যাদেরকে “প্রথম অরগানিক লাইফ” বলা যেতে পারে। তবে, এগুলো ছিল নিতান্তই সরল প্রকৃতির। 

এরপর কেটে যায় আরো দীর্ঘ দীর্ঘ সময়। আজ থেকে মাত্র ৭০ হাজার বছর আগে এসে, মহাবিশ্ব তারই বিকশিত একটা সত্ত্বার মাধ্যমে নিজের উৎপত্তি, বিকাশ, অস্তিত্ব ও প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করবার মত চেতনা লাভ করে। আর এই সত্ত্বাটা হচ্ছেন আপনি, বা আমি অর্থাৎ মানব প্রজাতি। এই সময়টায় অর্থাৎ আনুমানিক ৭০ হাজার বছর আগে, ভাষা উদ্ভবের ফলে মানুষের চিন্তা ও প্রশ্ন করবার ক্ষমতা তৈরি হতে থাকে। বলে রাখা ভাল, আমরা যেহেতু এখনও মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার বিকাশ ঘটেছে কিনা জানি না— তাই, সেটিকে বিবেচনার বাইরে রেখেই এটা বলা।

এখন, মানুষ যেহেতু, মহাবিশ্বের বা প্রকৃতির একটা অংশ, ফলে জগত ও নিজের অস্তিত্বকে বোঝার এই চেষ্টায়, তার কিছু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হওয়াটা স্বাভাবিক। ফলে প্রশ্ন উঠবে : দুনিয়ার আদিম সব বুনো প্রান্তরে নিতান্তই টিকে থাকার প্রয়োজনে, যে মানব মস্তিষ্কের বিকাশ— তা কি জটিল এই মহাবিশ্বকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে সক্ষম হবে? মানুষের অজানাকে জানাতে চাওয়ার এই অভিযান, ভবিষ্যতে কি এমন কোন দুর্ভেদ্য দেয়ালের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে— যা অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না?

নাকি মানব প্রজাতির ক্রম বিকাশমান বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার কোন সীমা, আগে ভাগেই এঁকে দেয়াটা উচিত হবে না?

আসুন এই প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে দর্শন ও বিজ্ঞান আমাদের কোন দিশা দিতে পারে কীনা, সেই খোঁজ খবর একটু নেয়া যাক।

পরবর্তী পর্বে আমরা দর্শন নিয়ে আলোচনা করব।

Comments

    Please login to post comment. Login