পোস্টস

প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ও মাওলানা রুমির সুফি ভাবধারা

১৭ জুন ২০২৪

এনামূল হক পলাশ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি মাওলানা রুমির ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন? এই বিষয়টা আলোচনা করতে হলে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে যে মাওলানা রুমির ভাবধারা কি। মাওলানা রুমির ভাবধারার মূল উৎস কি। মাওলানা রুমীর ভাবধারার মূল  উৎস হচ্ছে সুফিবাদ। ইসলামের ইতিহাসে গুপ্তজ্ঞানের চর্চাকারী সাহাবিদের বলা হয় 'আসহাবে সুফ্ফা' বা 'আহলুস সুফফা'। যার অর্থ বারান্দার অধিবাসী। মসজিদের নববির বারান্দায় অধিকাংশ সময় কাটাতেন তারা। বেশিরভাগ পণ্ডিত ও গবেষকই মনে করেন, এই 'সুফ' শব্দ থেকে সুফি শব্দটি এসেছে। 'সুফি' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ 'পশমি কাপড় পরিধানকারী।' উল্লেখ্য, আরবদের কাছে পশমি কাপড় অনাড়ম্বর জীবনের প্রতীকরূপে সর্বজনগ্রাহ্য বিষয় ছিল এবং ইসলামের মহানবি (সা.) পশমি কাপড় পছন্দ করতেন। যতদূর জানা যায়, মহানবি হজরত মুহম্মদ (সা.) পরলোকে গমনের সময়ও পশমি কাপড় পরিহিত ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুলভ পশমি পোশাককে পার্থিব আরাম-আয়েশ, অহংকার-দম্ভ পরিত্যাগের নিদর্শনরূপে গণ্য হতো প্রাক্ ইসলামি যুগেও। মহানবি (সা.) উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সময় মুসা নবি পশমি কাপড় পরিহিত ছিলেন। পশমি কাপড় পরিধানকারী এই সকল আড়ম্বরহীন জীবনযাপনকারীদের জীবন ও দর্শন থেকে সুফি দর্শনের সূত্রপাত। আরেক দল গবেষক মনে করেন, সাফ বা সারি (কাতার) থেকে সুফি কথাটি এসেছে। তাঁদের মতে, সুফিরা প্রথম সারির মানুষ। আরেক দল গবেষক মনে করেন, 'সাফা' শব্দ থেকে সুফি শব্দটি এসেছে। 'সাফা' অর্থ পবিত্রতা, পরিষ্কার। এ দলের গবেষকদের বক্তব্য, যাদের অন্তর পবিত্র বা পরিষ্কার, তাঁরাই সুফি। নিকলসনসহ পশ্চিমের কয়েকজন পণ্ডিত মনে করেন, গ্রিক শব্দ 'সোফিস্ট' থেকে সুফি শব্দটি এসেছে। সোফিস্ট অর্থ জ্ঞান। পশ্চিমের কেউ কেউ বলেন, ইসলামের প্রথমদিকে আব্বাসীয় ও উমাইয়া বংশের অর্থপ্রীতি ও ক্ষমতাপ্রীতি তথা রাজতন্ত্রের কঠোর বিধিবিধান ও বাহ্যিক পক্ষপাতদুষ্ট নীতিনিয়মের শক্ত বাঁধন থেকে মুক্তির পথ হিসেবে খ্রিষ্টান সাধুদের অনুসরণে সুফিধারার উদ্ভব ঘটে। এই দলের গবেষকগণ সুফিবাদের এই উদ্ভবকে একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুফিতত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো প্রেম। প্রেম একটি পর্যায়ে শক্তিতে পরিণত হয় এবং সকল কিছু থেকে সাধককে বিচ্যুত করে প্রেমের সত্তা এবং সম্পর্কের প্রবল আবেগ থেকে উৎসারিত। এ কারণেই সুফির চোখে আল্লাহ সুন্দর, সত্য ও প্রেমের ধারক এবং একই সঙ্গে জ্ঞানেরও ধারক।

সুফিভাবনাকে ঘিরে যে শিল্প-সাহিত্য গড়ে উঠেছে সেখানে অবলীলাক্রমে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র একটি ভাষাশৈলী। এ ভাষা প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে ভাষার মধ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন এক ভাষা। ফারসি কবিতা ও গজলকে ঘিরে এই ভাষাশৈলী বিকাশ লাভ করে। শরাব, সাকি নেশা, পানশালা, পেয়ালা, রঙিন আঁখি, বুলবুল, সিরাজি, লালপানি ইত্যাদি শব্দের আবরণে তাঁরা তাঁদের আসল কথাটি গোপন করে রেখেছেন। সাকি- যে শরাব পরিবেশন করে, এখানে যে জ্ঞানদান করেন অর্থাৎ পর, গুরু। শরাব পানে মাতাল বা নেশায় চোখ লাল হওয়ার অর্থ হচ্ছে গুরু কর্তৃক নতুন জ্ঞান তাকে ভাবাবেগ দান করেছে; শিষ্য সে জ্ঞানের পরশে বাহ্যজ্ঞান হারিয়েছেন। ভাষার এই আবরণটি জানতে পারলে কবির ভাব ও ভাবনাকে বোঝা সম্ভব। অনেকেই বলেন, ভাষার আবরণ ভেদ করে দ্বিঅর্থের গূঢ় অর্থকে বের করে উপলব্ধির মধ্যেই সুফি রচিত গজল ও কাব্যের নান্দনিকতা। 

ইবনুল আরাবি, ইবনুল ফরিদ, নিজামি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, আব্দুল কাদির বেদিল, সানাই, মাওলানা রুমি, হাফিজ, খৈয়াম, গালিব, বুল্লে শাহ, গরহর শাহি, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই, ইকবাল, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সুফিদর্শন দ্বারা প্রভাবিত বা সুফিদর্শনকে তাঁরা প্রভাবিত করেছেন। লোকসাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে সুফিদর্শন। আরবি, ফারসি, তুর্কি, হিন্দি, উর্দু, বাংলা ভাষায় সুফিদর্শনের প্রভাব পড়েছে বেশি। 

খোরাসানের মাওলানা জালালউদ্দীন রুমিকে (১২০৭-১২৭৩ খ্রি.) সুফি ভাবধারার রাজা বলা হয়। তিনি এশিয়া মাইনরের কোনিয়ায় বাস করতেন। অতএব তাঁর নাম রুমি (রোমান)। তাঁর কবিতার গ্রন্থ মসনবী দৈনন্দিন জীবন থেকে গৃহীত ঘটনাবলিতে পূর্ণ, যাতে আল্লাহর সঙ্গে মিলনের পথ প্রদর্শন করা হয়েছে। একটি খাঁটি ও মার্জিত অন্তরে আল্লাহর সৌন্দর্য অধিক পরিষ্কারভাবে অভিব্যক্ত হতে পারে। তিনি মৌলভীদের (তুর্কী, মেল্লেভী) রীতি প্রতিষ্ঠা করেন। সংগীতের তালে নৃত্য করে বলে তারা 'নৃত্যরত দরবেশ' নামে পরিচিত।

মাওলানা রুমি তাঁর জীবনের শেষ বারো বছর ধরে রচনা করেন এই সুদীর্ঘ ধারাবাহিক কবিতাগুচ্ছ। চৌষট্টি হাজার লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুচ্ছ ছয় খণ্ডে বিভক্ত। বিশ্ব সাহিত্যে এর সমতুল্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই। এটি বহু বিষয়কে ঘিরে সমুদ্রের মতো স্ফীত হয়ে ওঠে। এটি আত্মব্যাখ্যামূলক। কাল্পনিক, কোথায়ও আত্মার স্বাস্থ্যের ওপর রসিকতামূলক মন্তব্য ও কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা। এতে লোককাহিনি, কৌতুক এবং কবিতা রচনার সময় উপস্থিত লোকদের সম্পর্কে মন্তব্য রয়েছে। রুমি তাঁর মহিমান্বিত উক্তিগুলিকে তাঁর লিপিকার হুশাম চেলেবিকে লিখে রাখতে বলতেন তারা যখন কোনিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন। হুশাম ছিলেন শামস এর মুরিদ। অতএব, এই দীর্ঘ কবিতাকে বন্ধুর সাথে রুমির আলাপ- চারিতার সম্প্রসারিত রূপ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। রুমির এই অদ্ভুত একক বৈচিত্র্যের সর্বোত্তম রূপক ছিল তাঁর চারপাশের লোকদের কেন্দ্র করতে যেখানে কখনো তিনি উপস্থিত হতেন। সুফিবাদের অন্যতম খ্যাতিমান গবেষক প্রফেসর ডক্টর আর. এ. নিকলসন (Dr. A. R. Nicholson), সুফিবাদ বিশেষজ্ঞ এ. জে. আরবেরি (Dr. A. J. Arberry) মসনবীকে একটি মহাসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করেন। এটি এখনো বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীতে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভাষা নেই যেখানে পুরো মসনবী বা তার অংশবিশেষ অনূদিত হয়নি। এই মহাগ্রন্থ ইংরেজি সাহিত্য, ফরাসি সাহিত্য, জার্মান সাহিত্য, উর্দুসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যকে যুগ যুগ ধরে নানাভাবে প্রভাবান্বিত করে আসছে। নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাবধারা অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের 'দুই পাখি', 'সীমার সাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর,' আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার প্রদীপ না 'জ্বালালে দেয় না কিছু আলো' ইত্যাদি হয় মাওলানা রুমির মসনবীর সোজাসুজি অনুবাদ অথবা তাঁর ভাবধারার ঋণে ঋণী। রুমি নিজেই তাঁর মসনবী গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন: 'স্রষ্টার কাছে পৌছানোর অজস্র পথ খোলা আছে, আমি তাঁর মাঝ থেকে প্রেমকে বেছে নিলাম'। 

এই উপমহাদেশে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সূত্রপাত করেন সম্রাট আকবর। ভারতে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির লক্ষে তিনি ফতেপুর সিক্রিতে আয়োজন করেছিলেন আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এই সংলাপের মাধ্যমেই তিনি সকল ধর্মের সারাংশ সমন্বয় করে তৈরি করেছিলেন দ্বীন-ই-ইলাহী বা স্রষ্টার ধর্ম। আকবরের জীবদ্দশায় ঐকান্তিক উদ্যোগ ছিল নতুন এ ধর্মমত চালু করার; কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দীন-ই-ইলাহী লীন হয়ে যায়। আকবরের দ্বিতীয় কাজটি ছিল 'সুল-হি-কুল' বা সর্বজনীন শান্তি নামে জাতীয় নীতি প্রণয়ন। আকবরের লক্ষ্য ছিল পরধর্মসহিষ্ণু ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিভিত্তিক একটি কল্যাণধর্মী সমাজ নির্মাণ। এর ধারাবাহিকতায় গীতাসংকলক শঙ্করাচার্য ভারতীয় আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ এই উপমহাদেশে ধর্মসংস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা পুরুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এর আগে মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো এই উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে মিলন ঘটানোর অভিপ্রায়ে রচনা করেছিলেন মজমাউল বাহরায়েন (দুই সমুদ্রের মিলন)। কাদেরিয়া তরিকার অনুসারি দারাশিকোর সুফিবাদী চেতনায় রচিত ওয়াহিদাতুল সাওয়ানিহ (১৬৪০ খ্রি.) আরেকটি সম্প্রীতিমূলক গ্রন্থ। ফারসি ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ তাঁর অমর কীর্তি। এর প্রায় আড়াই শ' বছর পর তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়। একেশ্বরবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আরবি-ফারসি ভাষায় রচনা করেন তুহুফান্ডুল মুয়াহহিদ্দীন (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার)। 'নিরাকার ব্রহ্মোপসনাই প্রকৃষ্ট'- এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রবর্তন করেন ব্রাহ্মধর্ম। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুফি ভাবধারায় প্রভাবিত। হয়েছিলেন। তার গীতাঞ্জলি কাব্য পাঠ করলে দেখা যায় এটি একটি প্রার্থনাধর্মী কাব্য। তার কিছু কবিতার ভাব চমৎকার ভাবে কোরানের কিছু আয়াতের ভাবকে সমর্থন করে। যেমন তিনি লিখেছেন, 

 

‘অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তরতর হে।

নির্মল করো উজ্জ্বল করো,

সুন্দর করো হে।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো,

নির্ভয় করো হে।

মঙ্গল করো, 

নিরলস নিঃসংশয় করো হে।'

 

তার সাথে যদি আমরা সূরা ত্ব-হা এর ২৫-২৯ নম্বর আয়াতকে মিলাই তবে দেখতে পাব,

 

 

‘হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন, এবং আমার কাজ সহজ করে দিন, আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন (যাতে আমি নির্ভয়ে, নিঃসংশয়ে সত্য প্রচার করতে পারি) যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত- ২৫-২৯)।

 

প্রার্থনাধর্মী এই দুইয়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। আবার রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন,

 

“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার

চরণধুলার তলে।

সকল অহংকার হে আমার

ডুবাও চোখের জলে।

আমারে না যেন করি প্রচার

আমার আপন কাজে;

তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ

আমার জীবন-মাঝে।

আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও

হৃদয়পদ্মদলে ।

সকল অহংকার হে আমার

ডুবাও চোখের জলে।"

 

 

সেই লেখার সাথে সূরা নামল এর ৩০ নম্বর আয়াতের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন -

 

‘হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছো, তার জন্য আমাকে শুকরিয়াবনত করো। আর আমি যাতে এমন সৎকাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। আর তোমার অনুগ্রহে তুমি আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো।' (সূরা নামল, আয়াত- ৩০)।

আসলে সুফির প্রচারিত দর্শন আর ভারতীয় দর্শন একাকার হয়ে যুগ যুগ ধরে সকল ধর্মের মানুষের ভেতর এক আলাদা মনোজগৎ তৈরি করেছে। বাংলার রবীন্দ্র সাহিত্যে সুফি চিন্তার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। 

 

সহায়ক গ্রন্থ : ১. আত্মদর্শনে সুফিবাদ - মোহাম্মদ আব্দুল হাই, ২. মিনহাজুল আবেদীন - ইমাম গাজ্জালী, ৩. রিলেজিয়াস মাইন্ডসেট - সজল রোশন, ৪. গীতাঞ্জলি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।