ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে জাবি বন্ধ দিয়ে দিল, সাথে সাথে ভর্তি প্রক্রিয়াও স্থগিত৷ বলছি, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিনের কথা৷ হাতে তিনটা অপশন সাস্ট, রাবি আর খুবি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভর্তি৷ জাবিতে মেরিট পজিশন খারাপ ছিল না, সাবজেক্ট পাব এতটুকু সিউর বলা যায়৷ কিন্তু, অন্য কোথাও ভর্তি না হয়ে রিস্ক নেওয়ার মত অবস্থায়ও ছিলাম না৷ একে ত সেকেন্ড টাইমার, তার উপর- ইমপ্রুভমেন্ট দিছি৷
আব্বা কোন ভাবেই চাচ্ছিলেন না, আমি ঢাকার বাইরে পড়তে যাই৷ বিশেষ করে রাবিতে তো কোন ভাবেই না৷ সে আমি যত ভাল সাবজেক্ট-ই পাই না কেন! কিন্তু কেন? সাধারণত আব্বা আমাকে কখনো কিছুতে বাধা দেয় না, এক্ষেত্রে দিল কেন? এর পিছনেও একটা গল্প আছে, আব্বা এলাকার বেশ বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন৷ বাংলা ইংলিশে উনার দখল বেশ উচ্চ পর্যায়ে৷ এগুলা আমার কথা না, ছোট বেলা থেকেই মানুষের মুখে মুখে শুনে আসতেছি। যে ভদ্রলোক আব্বাকে ঢাবিতে ভর্তি হবার টাকা দিবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন, শেষ বেলায় এসে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পরবর্তীতে, আব্বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হলেন৷ বাড়িতে কথা হলো, জমি বেচে উনার পড়ালেখার খরচ চালানো হবে৷ সেই কথা মত জমিও বেচা হলো৷ কিন্তু চাষের জমি বেচলে উনার পরিবার খাবে কি? আমার দাদা সিদ্ধান্ত নিলো, জমি বেচার টাকা থেকে কিছু জমি বর্গা নিবেন; ওই জমিতে চাষাবাদ করবেন৷ ফসল বিক্রির টাকায় নিজেরাও চলবে; সাথে আব্বাকেও দিবেন৷
সব কিছুই কি আর বাংলা সিনেমার মত এত পরিকল্পিত হয়? হয় না রে ভাই৷ এটাই বাস্তবতা৷ আব্বার ক্ষেত্রেও হল না৷ আব্বা সেই রাজশাহীতে একা একা খেয়ে না খেয়ে পড়ে রইলো দিনের পর দিন, তার বাড়ি থেকে আর টাকা আসে না। আসবে কেমনে? ফসল বিক্রি করে যে টাকা হইছে, তা দিয়ে তারা নিজেরাই চলতে পারে না। তাছাড়া, তখন ত আর বিকাশ ছিল না! খালি পেটে তো আর পড়াশোনা হয় না৷ প্রচন্ড মানুষিক চাপে, আব্বা মানষিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। এই একই ঘটনা আমার সাথেও পুনরাবৃত্তি হোক; সেটা আব্বা চায় নি।
জাবিতে অস্থিতিশীল অবস্থা, এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি৷ সাস্টে GBE, খুবিতে আর রাবিতে STAT আসছে। রাবিতে মাইগ্রেশনে আরও ভাল সাবজেক্ট আশার সুযোগ আছে৷ শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি হতে পারব, এরচে বেশি আমার পরিবার থেকে এফোর্ট করতে পারবে না। খুলনায় চলে আসলাম। যেখানে আমার পজিশন সবচে পিছনে ছিলো। আব্বার থেকে আর কিছু পাই আর না পাই, ইগোটা পেয়েছিলাম। আমার জীবনে মাঝামাঝি বলতে কিছু নাই, হয় ফার্স্ট, না হয় লাস্ট।
ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হওয়ার এক মাস আগে ক্যাম্পাসে চলে এলাম। সাথে ছিল মিজান আর শিশির। এডমিশনে ভাল করেছিলাম, আত্মবিশ্বাস অন্য লেভেলে। ভাবনা ছিল, এক মাস ক্যাম্পাসের পরিবেশ জানব বুঝব। যাতে ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই নিজেকে মানায় নিতে পারি। সেই সময় আমার টার্গেট কি ছিল জানেন? CGPA 4! ইভেন ক্লাস শুরু হবার আগে থেকেই আমি সাবজেক্ট নিয়ে জানতে শুরু করেছিলাম, পড়তে শুরু করেছিলাম। ভাবনার পুরোটা জুড়ে ছিল, ''URP''তে পড়ার যে চ্যালেঞ্জ আমি নিছি; সেটা যেকোন মূল্যে পূরণ করব৷
২০১৯'র ডিসেম্বর মাস, এই শহরে আমি ওই একটা মাসই বেচে ছিলাম৷ যেভাবে ক্যাম্পাস লাইভ ইঞ্জয় করব ভাবছিলাম, তার সব কিছুই করা শুরু করে দিছি ততদিনে৷ রাত বেড়াতে ঘোরাঘুরি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা গান আরও কত কি! প্রতিদিন রাত পার করতাম এই অপেক্ষায়, কবে ক্লাস শুরু হবে৷ জানুয়ারির এক তারিখে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। সবচে বড় ধাক্কাটা খেলাম তখন, যখন জানতে পারলাম- ডিসিপ্লিন উন্নয়ন ফি নামেও কিছু একটা জমা দিতে হয়৷ রেজিস্ট্রেশনে টাকা লাগবে, আমি শুধু এটা জানতাম। তারপর, বাসায় জানালাম। আব্বা মা বলল, আচ্ছা চিন্তা করিস না; ম্যানেজ হয়ে যাবে৷
একটা একটা করে দিন পার হয়, কিন্তু টাকা আর ম্যানেজ হয় না। সেই দুইটা সপ্তাহ যে আমার উপর দিয়ে কিভাবে গেছে আমি জানি না৷ আমি এতটা ডিপ্রেশড হয়ে গেছিলাম, বলার বাহিরে। হতাশা আর টাকার চিন্তায় ক্লাস করা বাদ দিয়ে দিলাম। বার বার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরতেছিলো, আমিও কি আব্বা মত অসুস্থ হয়ে ফিরে যাব এই শহর থেকে! এই পুরো বিষয়টা হাতেগোনা দুই একজন জানতো। ক্লাসমেট-সিনিয়রদের তখন চিনতাম না তেমন৷ তারচে বড় কথা, আমি নিজেকে ছোট করতে চাইনি সবার সামনে। আব্বা একটা কথা বলত, "প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবি, কিন্তু কাউর কাছে হাত পাতবি না। একবার হাত পাতার খুব খারাপ। আত্মবিশ্বাস কমায় দেয়, আর হীনমন্যতা বাড়ায় দেয়।"
শেষ দিন এসে ভার্সিটিতে টাকা জমা দিলাম। হাফ ছেড়ে বাচলাম। টেনশনে গতদিন গুলোতে ঠিকমত খাওয়া দাওয়াও করি নাই। টের পেলাম, শরীর বেশ দুর্বল হয়ে গেছে৷ অসুস্থ হয়ে পড়লাম৷ আবার কিছুদিন ক্লাসে আসতে পারলাম না। কিন্তু ততদিনে পড়াশোনার গাড়ি অনেক দূরে চলে গ্যাছে৷ একে ত সব নতুন নতুন সাবজেক্ট; তার উপর এতদিনের গ্যাপ। পারতেছিলাম না আর, তবুও রেগুলার হওয়ার চেষ্টা করলাম। বাসার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই ভেঙ্গে গেছিলো। ক্লাস এইটে থাকতে, আব্বা স্ট্রোক করছেন। উনার প্রতিমাসে ৩/৪ হাজার টাকার ঔষধ ম্যান্ডেটরি। মায়ের একার ইনকামের উপর পুরো পরিবার৷ শুনলাম, আব্বার ঔষধ কেনার টাকাটা পর্যন্ত, আমার ফি দিতে ব্যয় হয়ে গেছে৷ কি এক অপরাধবোধ আমাকে জেকে ধরলো। আমি বাসায় টাকা চাইলে, আব্বা যে পর্যন্ত না শুনত- মা আমাকে টাকা পাঠাইছে৷ সে পর্যন্ত উনি নিজে ভাত খাইতো না৷ উনার কথা, 'আমার ছেলে না খেয়ে কষ্ট করবে; আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে না।'
স্যার সাবমিশনের কাজ দিছে, বিকেলে জমা দিতে হবে৷ আমার কাছে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট নাই। পকেটে কাগজ কলম কেনার টাকা নাই। বাসায় টাকা চাইতে লজ্জা করত। এরপর আমি আর বেচে উঠতে পারি নি। যেভাবে যায় যেতে দাও, লেট ইট গো। কুয়েটে মোটামুটি ভাল সাবজেক্ট আসল, এটা বাড়িতে জানাইয়ো নি। ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন নিজের হাতে চাপা দিছি। জাবিতে ইন্টারভিউতে ডাকলো, বাড়িতে তাও বলি নাই। আমার চেয়ে পজিশনে হাজার পিছনে, তারাও এখন জাবিতে পড়তেছে। এসব নিয়ে না কখনো আফসোস হয় কিনা জানিনা৷ আজকাল অতীত সাফল্যের ঢেকুর তুলে তৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করি। কি করব, এইটুকু জীবনে; সাফল্য বলতে ত ওতটুকুই৷
এই গল্পগুলো কেন বললাম? এখনো অনেকে বলে, তুই শখ করে ১.১ টার্মে রেজাল্ট খারাপ করছিস৷ সারাদিন ঘুমাইছিস, ক্লাসে যাস নাই হ্যান ত্যান৷ কতজন বাকা চোখে দেখছে আমাকে। যে যাই বলছে, আমি আজকের আগ অব্দি কাউর ভুল ভাঙ্গাতে যাই নি। যাইতে ইচ্ছেও করে নি৷ যার যা ইচ্ছা ভাবুক৷ নিজের অর্থনৈতিক অপরাগতা গুলোকে আমি, কত না মিথ্যে আর কাল্পনিক গল্প দিয়ে ডেকে দিয়েছি৷ ভাবলে হাসি পায়, আবার কান্নাও আসে৷
এক ভাই জিজ্ঞেস করছিলো, ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে? আমি বলছিলাম, বিদেশ যেতে চাই স্কলারশিপ নিয়ে। উনি জিজ্ঞেস করল, সিজি কত? আমি বললাম, সিজিপিএ ২.৫। সিজি শুনে ভাই হাসতে হাসতে কয়, ' তুই এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন! চার তলা থেকে লাফ দে।' এটাই হয়তো সেই টার্মে পুরো ভার্সিটির মধ্যে লোয়েস্ট সিজি। কিন্তু, প্রত্যেকটা কোর্স সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞান ধারণা নিয়ে, প্রায় সব সাবজেক্টে ৭/১১/১৫/১৬ (৪০ এর মধ্যে) ব্যাকাপ নিয়ে, পরীক্ষা শুরুর মাত্র এক/দুই সপ্তাহ আগে প্রিপারেশন নিয়ে, সব থিউরী কোর্সে পাস করে যাওয়াটা কিন্তু এত সহজ ছিল না৷ ভাইভা দিই নি বলে, তিনটা সেশনালে রিটেক আছে। একমাসের মত সময় পড়ে শূন্য থেকে, ১.২ টার্মে সিজিপিএ ৩.৩৪ উঠাইছি৷ এগুলা কি খুব সহজ ভাই? এই সময়টায় যে জীবনে সংকট ছিল না, এমন না৷ ছিল, আগের চেয়ে বেশি-ই ছিল৷ তবুও তো করছি। নিজেকে এটা দেখাইছি যে, মনে আত্মবিশ্বাস থাকলে, পৃথিবীর কোন সমস্যাই কোন সমস্যা না। এই গল্প বলে, আমি কাউর সিম্প্যাথি গেইন করতে চাই না৷ না কাউর কোন এটেনশন চাই। চাই শুধু নিজের কাছে একটু হালকা হতে। নিজের ভিতরে জমানো গল্পের ভারে ভারে আমি নুইয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন৷ এবার, নিজের মেরুদণ্ডে ভর করে আবার উঠে দাড়াতে চাই, সব প্রতিকূলতা পার করে। নিজের ইগোকে আর বড় করতে চাই না৷ মুক্ত হতে চাই। বাকি সবার মত আমার অনেক কিছু নাই, এটা বলতে আমার কোনো লজ্জাও নাই।
এজন্যই বলি- 'জীবন সুন্দর, বৈচিত্রময় আর বিরক্তিকর!'
কিহ? জীবন সুন্দর না?