পর্ব- ৩
মান্নান ঘাটে পোছালাম| ট্রলারের সাথে কথা ছিল আমি যতক্ষণ থাকবো, ততক্ষন সে ঘাটে অপেক্ষা করবে এবং কাজ শেষে আমাকে নিয়ে সুনামগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে দিবে|আমি সাইট এ প্রবেশ করলাম, ঠিকাদারের সাইট ইঞ্জিনিয়ার আমিন আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো:
আমিন:"আসসালামু আলাইকুম স্যার!"
আমি:"ওয়ালাইকুম আস সালাম"
আমিন:"স্যার, সাইট ঢালাই এর জন্য রেডি, আপনি চেক করে দিলে শুরু করতে পারি?"
আমি: "আমিন, স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং গুলো আনেন, চলেন প্রথমে আমরা টাওয়ার বেস (পাইল ক্যাপ) চেক করি"
আমিন:"চলেন, স্যার"
আমি একে একে রেইনফোর্সমেন্ট, বেসের ডাইমেনশন, ক্লিয়ার কভার স্ট্রাকচারাল ড্রয়িং অনুযায়ী চেক করা শুরু করলাম, কোনো ভুল পেলাম না |সবকিছুই ড্রয়িং অনুযায়ী করা হয়েছে, অতীব চমৎকার, আমার সময় নষ্ট হবে না!
এরপর বিটিএস রুম এর ফ্লোর চেক করলাম: তাতেও কোনো ভুল না পেয়ে, বললাম, "আমিন, ঢালাই শুরু করেন, সিমেন্ট, বালি আর পাথরের অনুপাত হবে ১:১.৫:৩”|
আমিন:"ওকে,স্যার"
ঢালাই শুরু হলো আর আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মনে মনে দেখলাম অনুপাত অনুযায়ী সব কিছু ঠিক হচ্ছে নাকি, যখন দেখলাম ঠিক হচ্ছে, আমি আমার চিন্তার জগতে ডুব দিলাম|ভাবছি মান্নাঘাটের জনপদ নিয়ে! আচ্ছা এখানে কি ইন্টারনেট আছে? ডিশ এন্টেনা? এখানকার মানুষ কি টিভি দেখে? শুনে অবাক হলাম যে এখানে কোনো টি এন্ড টির লাইন নেই! আমার ফোন কোম্পানি যদি এই জায়গায় ট্রান্সমিশনশুরু করতে পারে, তাহলে এখানকার মানুষ মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারবে! কি আনন্দের বিষয়!, আমি এই এলাকার মানুষের ওই দুর্লভ মুহূর্তের অংশ হতে যাচ্ছি! মনে মনে ঠিক করলাম, যেদিন এখানে ট্রান্সমিশন শুরু হবে, আমি এখানে আসবো আর এখন থেকে আমার নানীর সাথে কথা বলবো| বলাইবাহুল্য আমার নানী আমার একজন পছন্দের ব্যাক্তিত্ব|
এই যে আমি আজ বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছি, আমার খারাপ লাগছে না! বরং ভালো লাগছে এই ভেবে যে এটি আসলে দেশের উন্নয়নের জন্যই করছি! উন্নয়ন উন্নয়ন করে আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা যে গলা ফাটায়, তারা কি কোনোদিন এই জায়গায় আসবে? মনে হয় না! তারা তো ভিআইপি, তাদের কাজ তো জনসভা করা আর প্রতিপক্ষকে গালাগালি করা! স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পরেও দেখতে হয় স্বাধীনতার সপক্ষেরশক্তি আর বিপক্ষের শক্তি! হাসি পায় এই ভেবে যে আমাদের দেশের মানুষ কেন বড় দুই দলকে অন্ধ সমর্থন দেয়? কেন তারা প্রার্থী না দেখে দলকে ভোট দেয়? সংসদের অধিবেশন গুলো দেখলে মনে হয়, আমরা এখনো ১৯৭১ সালে বসবাস করছি! আর আমরা ইঞ্জিনিয়াররা চিহ্নিত ঘুষখোর হিসাবে? হয়তো ১০% ইঞ্জিনিয়ার ঘুষ খায় আর বদনাম হয় পুরো প্রজাতির|এই যে আমি আজকে এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, জানি না আজকে দুপুরে খেতে পারবো কিনা! কোনো ছাপড়া রেস্টুরেন্টও চোখে পড়ছে না! একটা সিগারেট ধরালাম, যাতে ক্ষুধা না লাগে!
ঢালাই চলছে,আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর চিন্তা দেবীর আরাধনা করছি! সিলেটে পুরা দুই সপ্তাহ টানা থাকতে হবে, সময় কাটাবো কি করে, কাজ শেষে? হোটেলে যেয়ে দেখতে হবে ইন্টারনেট লাইন আছে কিনা! কিছু বই পত্র কিনতে হবে ঢাকায় যেয়ে নীলক্ষেত্ থেকে, নীলক্ষেতের মতো সস্তায় বই মনে হয় পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না! বই পড়লে আর নেটে ঘুরাঘুড়ি করলে সময় ভালো কেটে যাবে! এদিকে ক্ষুধা বাড়ছে, কাছের দোকান থেকে এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিসকুট আর দুটো কলা কিনে আনলাম, এই হবে আমার আজ দুপুরের খাবার আর সেই সাথে চা-সিগারেট তো চলছেই! পকেটে এখন বেনসনের প্যাকেট থাকে, আমার একটা ভাব আছে না! আফটারঅল, আমি এখন দেশের একটি অন্যতম প্রধান মোবাইল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার!
এবার একটু অফিসের কাজ করা যাক! আমিনকে বললাম ফিল্ড বুক নিয়ে আসতে|ফিল্ডবুকে আমরা সাইটে যা দেখতাম তা লিখতে হতো আর পাইল ক্যাপের রডের পরিমান হিসাব করে দিতে হতো যাতে পরবর্তীতে ঠিকাদারদের বিল ছাড়তে কোনো সমস্যা না হয়! আমি সিগারেট খাচ্ছি আর রডের পরিমান হিসাব
করছি ক্যালকুলেটর টিপে টিপে| মনে পড়ছে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে লেভেল-১, টার্ম-২ তে এই কোয়ান্টিটি এস্টিমেশন করেছিলাম! যাই হোক, ফিল্ডবুক লেখা শেষ করলাম! কিন্তু ঢালাই আর শেষ হয় না! কংক্রিট মিক্সার ঘুরছে আর ঘর-ঘর শব্দ হচ্ছে!
সারাদিনের ক্লান্তির কারণে কিছুক্ষন কেদারায় বসে থাকলাম| আমার অনেক বন্ধু আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো, সাইটে দাঁড়িয়ে ঢালাই দেখি বলে, অনেকে বলতো, "দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তোমার এই অবস্থা?" কেন জানি ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ কর্ম আমাদের সমাজে খুব নিচু চোখে দেখা হয়! আমি এদের নির্বুদ্ধিতায় রাগ করতাম না! আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, ড: এফ আর খান একজন নাম করা প্রকৌশলী হয়েও দিনের পর দিন সাইটে যেতেন আর আমি তো অতি সামান্য একজন ইঞ্জিনিয়ার! আমাদের সমাজ গুরুত্ব দেয় স্যুটকোট পড়া কালোবাজারিদের যারা সৎ পয়সায় টাকা উপার্জন করে না, আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে আমাদের এদের স্যালুট করতে হয়! আরও গুরুত্ব পায় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করা বিসিএস ক্যাডার, যারা ঠিক মতো বাংলাই বলতে পারে না আর ইংরেজি তো অনেক দূরের কথা! পাত্র হিসাবে এদের বাজারদর অতি উচ্চ! মাঝে মাঝে মনে হয় বিসিএস এর যারা ভাইভা নেয়, তারা কি ঘাস খায়? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন যে কঠিন হয়! এদের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবে
হেসেছেন আর কবে কেঁদেছেন এই জাতীয় প্রশ্ন করা হয় না! আমার সুযোগ হয়েছিল এদের একজনের সাথে আলাপ করার, যদিও তিনি বাঙালি ছিলেন, কিন্তু তার সে কি বুদ্ধিমত্তা আর কি জ্ঞান! এই কারণে ভারত আমাদের সাথে যখন কোনো চুক্তি করে, আমাদের প্যান্ট খুলে নিয়ে যায়, আর আমরা কোনো কিছু করতে পারি না! জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করা ছাড়া! কি হবে এসব ভেবে?
আরো এক ঘন্টা পরে ঢালাই শেষ হলো | এবার ফেরার পালা, ট্রলারে উঠে বসলাম, এবং যাত্রা শুরু হলো, তখন সবে অন্ধকার হতে শুরু করেছে| আমি দেখছি আর ভাবছি, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম, সারাদিনের ক্লান্তিতে | কতক্ষন হবে জানি না, হঠাৎ মনে হলো কেউ ডাকছে, উঠে দেখি পৌঁছে গেছি, তখন পুরা রাত | ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গাড়ি খুঁজতে লাগলাম, ফোন দিলাম ড্রাইভার কে:
আমি:" ফজলু ভাই, গাড়ি কই?"
ফজলু:"স্যার, আমি আপনাকে দেখসি, আমি আসতেসি"
আমি:"ওকে"
গাড়ি আসলো, আমি গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম সিলেট এর উদ্দেশ্যে|
(চলবে)
(এই লেখার প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক এবং এই লেখা কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীকে অপমানিত করার জন্য নয়! নিজের অজান্তে যদি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ||)