পোস্টস

গল্প

ফণিভূষণ চক্রান্তির চক্রান্ত

১৯ জুন ২০২৪

সুকান্ত সোম

 

নাম তার ফণিভূষন চক্রবর্তী।কিন্তু কালক্রমে পিতৃপ্রদত্ত নাম খানি আর তা রইলো না।ফণিভূষন নামের ফারা নাম বের হল ফণিভুষন চক্রান্তি। অন্য মানুষের নাম সংক্ষিপ্ত করা বা তা বিকৃতি করা নিয়ে মানুষের যত আগ্রহ থাকে তাতে মানুষের কর্মকান্ডও কিছুটা ভুমিকা যে রাখে না তা বলা যায়না। এই ফণিভূষন চক্রবর্তীও তার কর্মকান্ড দিয়ে নামের সার্থকতাকে যেন প্রমান করতে উঠে পরে লেগে গেল।কিছু মানুষ জন্ম থেকেই যেন কেমন উল্টাপাল্টা ভাবে বেড়ে ওঠে এবং তাতেই যেন সবার গা সওয়া হয়ে যায়।ফণিভুষন চক্রান্তিও তেমন। মা বাবা তার উভয়ী দেখতে সুশ্রী ছিলেন। কিন্তু বিধাতার ভিন্ন খেয়ালের সময় বুঝি চক্রান্তি কুষ্টি লিখেছিলেন। নইলে এমন মা বাবার সন্তান তাদের উল্টো  রং এর হবে কেন।আবার গায়ের রং এর সাথে মনের খাসলতও  কেমন যেন খাপছাড়া হয়েছিল। অল্প বয়সে বাবা মা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেও স্কুলে না যেয়ে  গরুর রাখালদের সাথে সখ্যতা  বেড়ে গেল।গ্রামের ছেলে একট আধটু এমন টা হয় আরকি কিন্তু তার সব কিছুতেই যেন লাভ করার চক্রান্ত থাকতো। সবাই যখন আম কুড়াতে ব্যস্ত সে তখন আমের সাথে যে শুকনো  মরিচ গুরো দিয়ে আম খেতে হয় তা বাটতে ব্যস্ত যাতে করে কুড়িয়ে আম যা পাওয়া যায় তার চেয়ে মরিচ গুড়োর বিনিময়ে আম বেশি পাওয়া যায়। বয়স যখন তার ১৭ বছর তখন ক্লাস টু অবধি পড়ে পড়াশোনায় ক্ষান্ত দিল। গ্রামের এমন কোন ঝগড়া ছিল না যাতে তার হাত ছিল না।  একের সাথে অন্যর ঝগড়া বাধিয়ে দিতে তার জুড়ি মেলা ভার।  এমন কোন এক সময় বাবার অসহ্য ঠেকে গিয়েছিল তখনি ঝাটা পিটে করে এমন মার টাই না দিল অন্য কোন ছেলে হলে এতোদিনে শুধরে যেত কিন্তু না এ যে চক্রান্তি।  অবশেষে বাবার আশু মৃত্যু কামনা করে গ্রাম থেকে পালিয়ে গেল। কোথায় যে পালিয়ে গেল তার খোজ কেউ পেল না।বাবা মা তার খোজ পেল বটে কিন্তু জানতে পারলো বাপ যেদিন মরবে সেদিনই সে গ্রামে ফিরবে তার আগে নয়। কিন্তু বিধি বাম।  বলায় বাহুল্য তার বাবা তার চাওয়া মিথ্যা প্রমান করে শত বছর আয়ু পেয়েছিলেন।একদিন কার থেকে শুনে ছিল বাবা মারা গিয়েছে,  তাই সে বাড়িতে ফিরে ছিল কিন্তু বাবা মারা যায় নাই দিব্যি বেচে আছে গ্রামের লোক জন ও তাকে বলতে লাগলো চক্রান্তি কথার দাম নাই। তাতে চক্রান্তির কিছুটা মান গেলেও কালক্রমে তা ঢাকা পড়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ একদিন মনে তার উদয় হল সে যা চাই তার উল্টো হয়। বাবার মৃত্যু কামনা করেও দিব্যি বাবা বেচে আছে। তাইলে এবার বাড়িতে বিবাহর কথা আগেই পাড়িবে যাতে তার বিবাহ না হয়। কিন্তু সে কথা পাড়িতেই বাবা মা  উৎসাহে তার বিবাহের জন্য পাত্রি খুজতে ব্যস্ত হল কিন্তু তার এ চক্রান্ত সফল হল না দেখে সে বলল কালো মেয়ে বিবাহ করবে। কিন্তু সে এই বারো সফল হল না।  অত্যান্ত রুপবতী এক কন্যার সাথে তার বিবাহ হল।  কিন্তু তাতেও সংসারে তার মন বসলো না।  বউ কে মার ধোর করে নিয়মিত।  বউকে মেরে কান টায় নষ্ট করে দিল। সেই থেকে ফণিভুষন চক্রান্তির বউয়ের সাথে স্বদ্ভাবটা আর রইলো না৷ তার বাবা মা পৃথক করে দিল সংসারব অভাব অনটন হলে বুঝি তাদের ফণি শুধরে যাবে।  কিন্ত না কিছুতেই কিছু হল না। সংসার ক্রমেই বাড়তে লাগলো কিন্তু ফণিভূষন শুধরায় না।  বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় তখন কে যেন তাকে ধরে নিয়ে ২৫ বছরের যুবক দেখিয়ে সরকারের রেল বিভাগের একখান চাকরীর ব্যবস্থা করে দিল। দিন যায় ফনীভূষনের বয়স বাড়তে থাকে।চাকরীতে ঢুকে পরিবারের সদস্যগণ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। আর যাইহোক সব সময় তো আর ফণিভূষনের মুখোমুখি থাকতে হতো না।  ফণিভূষন এর চারটি ছেলে ছিল,  তারাও বড় হল। সে তার ছেলেদের বিবাহ দিত আর মোটা অংকের পণ নিত। এই করে করে তার অর্থের গৌরব কিছু টা বেড়েছিল।  বাড়ির জন্য সব কিছু জিনিস নিজেই ক্রয় করতো আবার নিজেই টাকা খরচের দুঃখে হইচই করতো।অন্য কাউকে বাজার করতে দিয়ে বিশ্বাস পেতো না সে নিজেই বাজার করতে চলে যেতো। বাজার করে এসেই বলতো বয়স হয়েছে অথচ নিজেকেই এখন বাজার করে খেতে হয়। চার ছেলের বউয়ের পাল্লায় পরে ফণিভূষন টিভি কিনতে বাধ্য হল।  পাড়ায় তখন টিভি বলতে তার বাড়িতে আর কয়েক বাড়ি পরে চৌধুরীদের বাড়িতে। চৌধুরীদের বাড়িতে কেউ টিভি যেতে পারতো না বিধায় গ্রামের ছেলে,  বউ ঝি দের শেষ ভরসা চক্রান্তির বাড়িতে।  প্রথম প্রথম চক্রান্তি বাবু বিরক্ত হলেও কিছু করতে পারতো না।  কিন্তু তার নাম যে ফণিভূষন চক্রান্তি। বাড়িতে যারাই আসতো তাদের দিয়ে সে ফুটফরমায়েশ খাটায়ে নিতে শুরু করলো। হয়তো কাউকে দিতো ছাগল চড়াতে এই বলে যে যা অমুক দিনে সবার সামনে বসে টিভি দেখবি। হয়তো কাউকে দিয়ে গরুর গোবর ধুয়ে নিতো যা। অমুক সন্ধ্যায় তমুক নাটক দেখতে আসবি কিন্তু৷ কারো গাছে কোন ফল মনে ধরলে এই একটু দিয়ে যাস বিকেলে একটা নাটক আছে।  চক্রান্তি বাবু নিজের চক্রান্তে সফল হল। ছেলে বউরা মিলে এবার চক্রান্তি বাবুকে ফ্রিজ কিনে দেয়ার বায়না ধরলো,  সেও না না করে কিনেও দিল।কারেন্টের যেদিন বিল আসে সেদিন তার মুখটা আর দেখার মত থাকে না।সব কিছুতেই তার লাভ লসের চিন্তা। হঠাৎ একদিন মনে তার বড় দুঃখ হল। পরিবার পরিবার করে তার জীবনটায় দিয়েদিল।  অথচ ছেলে, ছেলে বউদের কারো কোন মনে তাকে নিয়ে চিন্তা নেই। সবাই শুধু চাই আর চাই।এবার সে বুদ্ধি করলো দেখি ছেলে, আর ছেলের বউরা তাকে কত ভালবাসে। একদিন কথার ছলে সেই ঝগড়া বাধিয়ে দিল৷।  তারপর গ্রাম ত্যাগ করলো এই ভেবে যে তাকে কেউ খোজে কিনা। এভাবে কয়েক দিন চলে গেল কিন্তু কেউ তার খোজে বেরোলো না। মনের দুঃখে চক্রান্তি বাবু ফিরে এলো। বাড়িতে ফিরলে ছেলেরা বকাবকি কর‍তে লাগলো।  বুড়ো বয়সে ভিমরতি গেল না।  ফণিভূষন বাবু ছেলেদের এমন ব্যবহারে  মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলে। কয়েকদিন ধরে কারো সাথে বলে না। একা একাই চলতে ফিরতে লাগলো।সবাই ভাবতে লাগলো ফণিভূষন চক্রান্তি হয়তো আবার কোন চক্রান্ত করার প্লান করছে।  সে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হল। অনেক দিন তার কোন খোজ পাওয়া গেল না৷ ছেলেরাও তার কোন খোজ নিলো না।  ছেলেদের কাছে একদিন চিঠি এলো। ফণিভুষন চক্রান্তি তার ছেলেদের উদ্দেশ্য করে লিখেছে, যে সে দুরের কোন এক আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে।  তার ছেলেরা তাকে খুজবে না সে জানে তবুও কেউ যেন তার খোজ না করে। তার নামে যা সম্পদ ছিল তার মধ্যে বাড়ি ছেলেদের দিয়েছে আর তা বাদে সব কিছু সে কোন এক এতিম খানার নামে দান করে দিয়েছে। এতোদিনে সে যে শান্তি পায়নি এখন সে সেই  শান্তিতে আছে। আর এটাই ছিল সম্ভবত ফণিভূষন চক্রান্তির শেষ চক্রান্ত।