পোস্টস

গল্প

ভূতের ডাকে

২০ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

ভূতের ডাকে

▪পার্থসারথি

     *

সূর্য ও নিশান দুষ্টের শিরোমণি। লেখাপড়ায়ও সবসময়ই বাজে। শুধু খেলা আর খেলা। কার গাছে কী ফলেছে তা চষে বেড়ানোই ওদের নেশা। পাড়ার সবাইকে সবসময় অতিষ্ঠ করে তোলে। প্রতিদিন অন্ততঃ একটা-দুটো নালিশ ওদের নামে আসবেই। মা-বাবার ভীষণ অবাধ্য ওরা। কোন কথাই তেমন শোনে না। পশ্চিমে যেতে বললে যাবে পূবে। আর উত্তরে যেতে বললে যাবে দক্ষিণে। আর একটা বাজে অভ্যাস আছে; মার্বেল খেলা আর সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে তাস খেলা। এবং তা পয়সা দিয়ে পর্যন্ত খেলে। যা এলাকার গুরুজনরা ভালো নজরে দেখেন না কখনও। স্কুল থেকে এসেই মার্বেল অথবা তাস খেলায় মত্ত থাকে।

খুব ভোর বেলায় ঘুম থেকে ওঠেই বাজার থেকে সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়িয়ে আনে। আজ শনিবার। তাড়াইল বাজারে হাটবার ছিল। অথএব আগামিকাল ভোরে সিগারেটের অনেক খালি প্যাকেট পাওয়া যাবে। তাই খেলা শেষে সূর্য ও নিশান বড় জামগাছ তলায় দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছে। পরামর্শ অনুযায়ী খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়াতে যাবে। 

সূর্য নিশানকে বলল- নিশান, যে আগে ঘুম থেকে উঠবে সে অন্যজনকে ডাক দিবে। 

ওরা দু'জন যখন বড় জামগাছ তলায় দাঁড়িয়ে এই পরামর্শ করে তখন গোধূলী পেরিয়ে চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আর ওরা যখন কথা বলছিল তখন জামগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে ওদের সব কথা শুনছিল দুষ্ট ভূতটা। ওদের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসল। আর মনে মনে বলল, দাঁড়া তোদের মজা দেখাচ্ছি। এই ভেবেই ডালে কয়েকটা ডিগবাজি দিলো মনের আনন্দে। সূর্য কিংবা নিশান ভূতের এই খবর কিছুই জানতে বা বুঝতে পারলো না।

সূর্য ও নিশান খুব খোশ মেজাজে রাতের ঘুম ঘুমাতে গেল। অথচ আগামীকাল স্কুলের যে লেখাপড়া আছে তা নিয়ে কোন মাথা ঘামাল না। ওরা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ক'দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। তবুও লেখাপড়া নিয়ে ওদের কোন মাথা ব্যথা নেই। 

     *

রাত গভীর। চারদিক খুব নীরব। কোন মানুষজনের চলাফেরা নেই। শুধু মাঝে-মধ্যে বাজারের পাহারাদার চেঁচাচ্ছে- হেই হেই, খবরদার! হেই হেই, সাবধান! একজনের চিৎকার অন্যজনের কানে পৌঁছাতেই সে-ও একইভাবে হাঁক দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ঠিক শেয়ালের মতো। আবার মাঝে-মধ্যে বাজারের নেড়ী কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওঠছে। বাজারের রাস্তার এক প্রান্ত থেকে দৌঁড়ে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে। থেকে থেকে হুঁতোম পেঁচা বুক কাঁপিয়ে ভয়ানকভাবে ডেকে ওঠছে। এমন সময় বাইরে একা বের হওয়া সম্ভব নয়। অমাবস্যা রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাকালে চোখে কিছুই দেখা যায় না। কারণ তাড়াইল বাজারে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। শুধু বাজারের রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাইট পোস্টের বক্সে হারিকেন বাতি জ্বালানো রয়েছে। তাতে খুব একটা দূর পর্যন্ত আলোকিত হয় না। তাছাড়া সূর্য ও নিশানদের বাড়ি পাড়ার একটু ভেতরে। যদিও ওদের বাড়ি বাজার এলাকায় কিন্তু কোন লাইট পোস্ট নেই। ওদের দু'জনের বাড়ি প্রায় পাশাপাশি। মাঝখানে গুটিকতক ঘর।

রাত তখন আনুমানিক তিনটা হবে। বাড়ির সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গেছো ভূতটা সূর্যদের বাড়ির কাছে এসে নিশানের স্বর নকল করে ডাক দেয়- সূঁর্য তাঁড়াতাড়ি ওঁঠ। অঁনেক বেঁলা হঁয়ে যাঁচ্ছে।

দু'তিনবার ডাক দেয়ার পর সূর্য চোখ মেলে তাকাল। ভূতটা যখন আবার ডাক দিল তখন সূর্য হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বলল- একটু দাঁড়া নিশান, আমি এক্ষুণি আসছি।

শার্টটা গায়ে দিতে দিতেই সূর্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসেই ঘুম জড়ানো চোখে বলল- নিশান, তুই কোথায়?

ভূতটা একটু দূরত্ব বজায় রেখেই বলে- আঁমি এঁইখানে, তাঁড়াতাড়ি আঁয়।

ভূতের সুরটা বেশ নাকালো। কিন্তু সূর্য গভীর ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখের তন্দ্রালুভাব এখনও লেগে আছে। তাছাড়া তাস কুড়াতে যাবে সেই নেশা মিলিয়ে ভূতের স্বরটা সূর্য ধরতে পারেনি। মোটকথা ভাববারও কোন ফুসরৎ নেই। তাড়াতাড়ি তাস কুড়াতে হবে। খুব দ্রুত পা চালাচ্ছে সূর্য। মনে মনে ভাবলো নিশান অনেক আগে চলে যাচ্ছে, তাই সূর্য বলল- নিশান, একটু দাঁড়া এক সাথে যাই।

উত্তরে ভূতটা বলল- তাঁড়াতাড়ি হাঁটা দেঁ। দেঁরি কঁরলে তাঁস পাঁবো নাঁ। অঁন্যেরা তাঁস কুঁড়িয়ে নিঁয়ে যাঁবে।

ঘুম জড়ানো চোখে সূর্য দ্রুত পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে। ভূতটা যেদিক থেকে ডাকছে সূর্য সেদিকেই হাঁটছে। তবে কোনদিকে যাচ্ছে তা টেরই পাচ্ছে না সূর্য। ভূতের তো পোয়া বারো অবস্থা। ভুল পথে সূর্যকে আনতে পেরে ভীষণ খুশী। নাচতে নাচতে গেছো ভূতটা আগে আগে যাচ্ছে। সূর্য এখনও বুঝতে পারেনি আগে আগে যে যাচ্ছে সে নিশান নয়, ভূত। সূর্য এখন বাজারের মাঝরাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে অথচ কিছুই টের পাচ্ছে না। চোখে ঘুম ঘুম ভাব এখনও লেগে আছে। বাজারের রাস্তা শেষ করেই ভূতটা নদীর রাস্তার দিকে পা বাড়াল। তারপর সূর্যকে ডেকে বলল- তাঁড়াতাড়ি আঁয় সূঁর্য, নঁইলে তাঁস এঁকটাও পাঁবো নাঁ।

সূর্য রীতিমতো দৌঁড়ে ছুটছে। ভূততো নাচতে নাচতে আগে আগে চলছে। মাঝে কয়েকটা ডিগবাজিও দিয়ে নিল। নদীর পাড়ে এসে সূর্য ঘুম জড়ানো চোখে তাকাল। কিন্তু কিছুই টের পেল না। খুব জোরে ডেকে বলল- নিশান, তুই কোথায়?

গেছো ভূতটা চালাকি করে পানিতে কয়েকবার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে বলল- আঁমি সাঁতার শুঁরু কঁরেছি। তুঁই তাঁড়াতাড়ি নেঁমে আঁয়। নঁদীর ঐঁ পাঁড়ে যেঁতে হঁবে। 

সূর্য কথাগুলো শুনেছে ঠিকই কিন্তু কিছুই বুঝে ওঠতে পারেনি। তাই চিৎকার করে বলে ওঠল- আমিও আসছি। প্যান্টটা খুলে নিই।

সূর্যের শেষ কথাটি শুনে এবং ভূতটি দেখতে পাচ্ছে যে, সূর্য এখনই পানিতে নামতে যাচ্ছে। এখনই ঘাড় মটকিয়ে তাজা রক্ত খেতে পারবে। তাই গেছো ভূতটা মহাআনন্দে কয়েকটা ডিগবাজি দিয়েই হঠাৎ মনমরা হয়ে মাটিতে লেপটে বসল। আর দু'হাত দু'গালে রেখে বসে রইল- মনে মনে বলতে লাগল; এঁকটুর জঁন্য আঁমার সঁব প্ল্যাঁন শেঁষ! 

সূর্য যখন শেষ কথাগুলো বলল তখন বাজারের এক পাহারাদার কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে এক মুহূর্তেই দৌঁড়ে এসে জাপটে ধরে সূর্যকে কোলে তুলে নিল। সূর্য হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে আর বলছে- আমাকে ছাড়ো। আমি তাস কুঁড়াতে যাচ্ছি।

পাহাড়াদার সূর্যকে চিনে ফেলল। তারপর পাঁজাকোলে করে ওদের বাড়িতে নিয়ে এল। বাড়িতে আনার পর হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে গেল। শুধু কান্নাকাটি শুরু হতে বাকি। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে এল। সকালে সূর্যদের বাড়িতে লোকজনের ভীড় জমে গেল। সবাই বলাবলি করছে- ভাগ্যটা খুব ভালো। একটুর জন্য বেঁচে ফিরেছে। নিশ্চিত অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলো। পাহারাদার সময় মতো না দেখলে ভূত নদীতেই ঘাড় মটকে ফেলে রাখতো।

যখন ঘটনা ঘটেছে তখন সূর্য কিছুই বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছে নিশানই তাকে ডেকেছে। কিন্তু নিশানকে ডেকে এনে জিজ্ঞ্যেস করা হলো। সে সূর্যকে ডেকেছে কিনা। নিশান বলল যে, সূর্যকে ভোর বেলায় ডাকার কথা ছিল। কিন্তু সে ঘুম থেকেই জাগতে পারেনি।

কথাগুলো শুনে সূর্য ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ভূতের ডাকে পেছন পেছন দৌঁড়ে নদীর পাড় পর্যন্ত গিয়েছে। ভাবতেই সূর্যর করুণ অবস্থা। ভয়েতে সারা গায়ের লোম কদম ফুলের মতো খাড়া হয়ে ওঠল। ভূতের ডাকের কথা শুনে নিশান ভয়েতে একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

এরপর থেকে সূর্য ও নিশানের দুষ্টুমিটা কমে গেল। মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করল। মা-বাবার কথা সবসময় শোনে। কারো গাছের উপর চড়াও হয় না। আর আসল কথা হলো- যেখানেই থাকুক সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে চলে আসে।

এবার দু'জনের পরীক্ষার ফলাফল দেখেতো সবাই অবাক। সূর্য ও নিশান ক্লাশে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। সবাই ওদের অনেক অনেক আদর এবং ভালোবাসা জানিয়ে গেল। কেউ কেউ আবার সুন্দর উপহার দিয়েছে। সূর্য ও নিশান এখন অনেক বদলে গিয়েছে। সবাই ওদেরকে এখন খুব ভালোবাসে।

     ***

বইটই-এ প্রকাশিত অসাধারণ রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস 'ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর’ এর লিংক