১।
আমি বাবার হাত ধরে বসেআছি। বাবার হাড্ডি যুক্ত জল নির্যাসিত হাত।আমার খুব শৈশবের কিছুস্মৃতি মনে আছে প্রথমযখন বাবার হাত ধরতাম। খুবস্পষ্ট ভাবে মনে নেই।তবুও চোখে আবছায়া করেরাখা সেইসব দৃশ্য মনে পরে। স্কুলযাবার পথে কিংবা মেলাশেষে ঘরে ফেরার সময়।তারপর অনেকটা সময় আমি আরবাবার হাত ধরিনি। লজ্জালাগতো। বাবাও কেমন জানি দুরেরমানুষ হয়ে গিয়েছিলো। কঠিনএকটা অবয়ব পরে থাকতোতার মুখ জুড়ে। আমিতার গহীনে ঢুকতে পারতামনা। আমার বোঝা হতোনাকতটা কোমলতা ভিতরে আছে। বাবার হাতআমি আরেকবার ধরেছিলাম। ১৯৭২ সালে। আমরাযখন শাহজাদপুরে চলে এসেছি। মামারবাসায়। আমাদের জন্য দুইটা মাত্ররুম। একরুমে আমরা ভাইবোনরা থাকি।আরেক রুমে বাবা মা।বাবা সারাদিনই বিছানাতে শুয়ে থাকেন। একসকালেদেখলাম বাবা কাদছেন। কাছেগেলাম আমি। বাবা আমারদিকে তাকিয়ে করুন গলায় বললেন “আমাদের কি হবেরে অনু?” মা একপাশে বসে তাকিয়ে আছেবাবার দিকে, বাবা আমার দিকে।সকালের রোদ কেবল হাল্কাভাবে এসে পড়েছে ডালিমগাছের গোড়াতে। আমি শক্ত গলায়বললাম, “কিছুই হবেনা বাবা। আমরা ভালো থাকবো।তুমি দেখো।“ ১২ বছরের একবালকেরকথায় বাবার কতটা আস্থা পেয়েছিলোবুঝিনি , কিন্তু আমার দিকে সেতাকিয়েছিলো আরো বেশ কিছুক্ষন।আমাদের দেখতে বাসা ভরে অতিথিএসেছিলো। মানুষ অবাক হয়ে বললো, “আপনার বাসা দখল হয়েগেলো? কেউ কিছু বললোনা?
আমি চোখ বন্ধ করে ৭২ এর সেই সকালে ফিরে গেলাম। শেরপুর নকলাতে ফিরে যাই। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীন দেশ। আমরা দীর্ঘ পলায়ন শেষে ফিরে এসেছি নিজের এলাকায়। বাসার সামনে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো, আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়।বাসা দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী রসু মিয়া। বাবাকে কোনরকমে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখেছি। রসু মিয়া চেচিয়ে বলছেন, “আপনারা ইন্ডিয়া যাবার সময় বিক্রি করে দিলেন । মনে নেই।“ মা বললেন, “আমরা ইন্ডিয়ায় যাবো কেন? অনুর বাবা অসুস্থ হয়ে গেলো বলেই না, গ্রামে চলে গেলাম।“ রসু মিয়া খিক খিক করে কাশে। কপালে সুক্ষ্ণ ভাজ পরে। গলা লাগিয়ে বলে, “আমার হাতে কাগজ আছে। অনুর বাপের সাইন আছে। আমার দুই পোলা মুক্তিযোদ্ধা।“ মা রেগে বলেন আমার স্বামীও। এরপর ঘর ভর্তি মানুষ বিকট স্বরে হেসে ওঠে। “ওরে একটূ মারধর খেলেই মুক্তিযোদ্ধা হয় নাকি। হ্যা। তোমার স্বামীকে ভুল করে তুলে নিছিলো। জহির আশরাফ নামে যে ছিলো সে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো।সে শহিদ হইছে। মারা গেছে।“ বাবা করুন চোখে তাকালো রসু মিয়ার দিকে। বিরবির করে বললো, “মারা গেছে? সে মারা গেছে…” রসু মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলেই চলেছে, “তোমার সোয়ামি মুক্তিযুদ্দের কইচ্ছে তাকি! মাঝ খান থেকে মাইর খাইলো। আমি শেষে আসল কথা না কইলে তো মরেই যাইতো তোমার সোয়ামী। যাউকগা এরকম মাইর কত হাজার মানুস হুদা হুদাই খাইছে। তোমার ভাগ্য! কপ্পাল কত্ত খানি পোড়া…হাহাহাহা।
বাবা খুব অসহায় চোখে তাকালো। আমরাও হাসি শুনছি । মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া কাপিয়ে অসংখ্য শকুনের দল হাসছে। বাবা অস্ফুত স্বরে , গায়ের সমস্ত জোর লাগিয়ে বললো, “হুম! আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। আমি সে অধিকার নিয়ে আসিনি। কিন্তু এই ঘর বাড়ি আমার…” রসু মিয়া রাগে ফেটে গিয়ে বললো, “মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধা নিবার আইসো। বাইর হও মিয়া। আর নই কেস করো। আমিও আছি।
বাবা অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। মার করুন চোখে টলমল করে জল। এইরকম অসহায় মুখ শেষ দেখেছিলাম, .১৬ এপ্রিল, ১৯৭১ এ। ঢাকায় একটা বড় রকমের ঝামেলা হয়েছে আগের রাতে। এটুকুই শুনেছি, এর চেয়ে বেশি কিছু জানা হয়নি। সন্ধ্যার আগে আগে একঝাক লোক আসলো। বাবাকে ধরে নিয়ে গেলো। চায়ের কাপ তখনো অর্ধেক খানি ফাকা তার।কাপের চারপাশ জুরে বাবার ঠোটের স্পর্শ। সন্ধ্যার নেমে আসা অন্ধকার ক্রমশ আলোকে গিলে খাচ্ছে, চারপাশ দখল করে ফে;লেছে অন্ধকার। পাশের বাসার চাচী এসে ফিস ফিস করে বলছে, “এ জহিররা , জহির আশরাফ…ঐনা আম্লিগ করে। ওরে ধরতেই আইচিলো এরা। ভুল কইরা লইয়া গেচে।“
সেই সে আধার নেমে আসা রাত। আমরা সব কয়টি ভাইবোন এক খাটে চুপচাপ ধরে বসে আছি একে অপরকে। মা রাত একটু নামার পর থেকেই কাদছেন। নকলাতে আমাদের একমাত্র স্বজন ঝন্টু চাচা রাজাকারদের বাসায় বাসায় ছুটছেন। কিছুক্ষন পরপর বাসায় এসে বলছেন, “ভুল লোককে ধিরে নিয়ে গেছে । তাদের বোঝাতেই পারছিনা। ভয় পাইয়েন না। দুয়া করেন। দুয়া করেন। ঠিক ঠিক চইলা আইবো।“
বাবা আসলেন পরদিন সকালে। তিনজনের ঘাড়ে পিঠে চরে। পা দুটো কুৎসিত ভাবে থেবলে গেছে। যেন একটা অংশ পচেই গেছে। তিন জায়গায় কপাল ফুলে গেছে অদ্ভুত রকমে। কানের কাছে তখনও রক্ত লাল হয়ে ফুলে আছে। বাবা এসে বসলেন খাটে । বসা অবস্থায় রাখা গেলোনা তাকে। তাকে শুয়ে দেওয়া হলো। তিনি বিরবির করে বলছেন, একটু পানি দাও, অনুর মা। মা পানির গ্লাস এনে তাকে একটু উচু করে বসালেন। পানি মুখে দিতে গেলেন, বাবা ভরভর করে বমি করে দিলেন। বিছানা মার শাড়ি মাখিয়ে বমি। সে রাতে তার জ্বর উঠেছিলো। একজন ডাক্তারের অভাবে সারারাত আমরা পরিবারের সবাই পাগলের মতো ছোটাছোটি করতে লাগলাম। রাতে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম “বাবা চলে যাবেন”। একদম নিশ্চুপ হয়ে কোনরকম শব্দহীন হয়ে তিনি শুয়ে ছিলেন। আমরা মাঝে মাঝে তার শিরা ধরতাম তার নাকের কাছে আঙ্গুল শুয়ে বুঝতে চাইতাম নিশ্বাস আছে কিনা! ভোরের আজানের পর হঠাৎ শুনলাম তার মৃদু স্বর। তিনি বলছেন, অনুর মা! আমাকে একটু পানি দাও। আর একটু সাদা ভাত , লবন আর কাচা মরিচ দিয়ে মাখিয়ে দিলেই হবে। আর কিছু লাগবেনা।
বাবা মরে যাননি সে রাতে। তবে তিনি চিরদিনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন। তখন আমার বয়স ১১ মাত্র। আমি বড় ছেলে পরিবারের। এই বড় পরিবারের দ্বিকে তাকাবার কেউ আর ছিলোনা। তাই বাবার মরে যাবার চেয়েও বেশি দুঃসংবাদ হয়ে উঠলো তার কর্মক্ষমতাহীন হয়ে যাবার ব্যাপারটি।
মোবাইলে রিং বেজেই চলছে। আমি বাবার হাত খানা বিছানায় রেখে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম। , টেবিল থেকে মোবাইল খানা তুলে নিলাম। ওপাশ থেকে মিনু বলছে, “ভাই! আমি রওয়ানা দিছি। ঘন্টা খানেক লাগবে আসতে। এতোক্ষন বাবারে ধরে রাখিস। যেতে দিসনা। আমি আইতাছি…” আমি কলটা কেটে দিলাম। এখন কয়টা বাজে? সকাল ১১ বেজে গেছে। আমি খালি বাসাটা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম সামনে, বাগানে। আহ এই একটা বাসা বাবাকে কিনিয়ে দিতে পেরেছিলাম বটে। এইটুকুই আমার আত্বতৃপ্তি। গেটের কাছে কেউ দাড়িয়েছেন মনে হয়। গেটের একপাশ দিয়ে ছায়া পড়েছে বাগানে। গেটে হাল্কা নকও করলো কেউ।আমি দরজা খুলে দিলাম। একটা মানুষের মুখ দেখা গেলো। লম্বা করে বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের মানুষটি , মুখ আত্ববিশ্বাসে ভরপুর। সে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, আসতে পারি? আমি বললাম, “আপনি কে?” অসংখ্য পাখী যেন সেই সময় হঠাৎ ডেকে উঠলো। মনে হলো আমার এই বাসার সামনের ছোট্ট বাগানে হঠাৎ করেই আলোকচ্ছটা বেশি করে এসে পরলো। এর মাঝে আমি স্পষ্ট শুনলাম, লোকটা হাল্কা গলায় বললো, আমি জহির আশরাফ। মুক্তিযোদ্ধা জহির আশরাফ।
২।
জহির আশরাফ সাহেবেরও এক পা খোড়া। তিনি বাগানে গোলাপ গাছ গুলোর কাছে বসে আছেন। একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে। তার হেলান দেবার কায়দা দেখেই বোঝা যায় তিনি ক্লান্ত। ভরাট গুলায় হঠাৎ বলে উঠলেন, “আমি যুদ্ধ করে পা হারিয়ে ফিরেছি বাহাত্তুরের মার্চে। তখন বোঝতো। পা নেই একটা, মানুষ আমি যতই মুক্তিযোদ্ধা হই , মানুষের কাছে তো খোড়াই। নকলাতে আমার কিছু ছিলোনা। আসলে আমি তো নকলাতে তোমাদের মতোই ভিনদেশী ছিলাম। তোমার বাবা যেমন শিক্ষক ছিলেন, আমিও তাই ছিলাম । কিন্তু পা হারিয়ে ফিরে তাই আর সেখানে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি। ফিরে গিয়েছিলাম বোনের কাছে গাইবান্ধা তে। অনেকদিন দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি, নিজের অক্ষমতার সাথে। কতদিন ভেবেছি কোথাও গিয়ে আত্বহত্যা করি। আবার ভেবেছি একজন মুক্তিযোদ্ধা আত্বহত্যা কেন করবে? করলে কি সেটা একটা উদাহরন হয়ে যাবেনা?”
আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। কেন যেন কোনরকমের রাগ ঘৃণা কাজ করছিলোনা। এই লোকটিরই বা কি দোষ। আমাদের কপালটাই এমন…তিনি সিগ্রেট ধরালেন। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এই সিগ্রেটটা ছাড়তে পারিনি বুঝেছো। যুদ্ধের সময় খেতামনা। খেয়েছি এই পা হারানোর বেদনা যখন লাগলো গায়ে তখন থেকেই। “ এরপর তিনি আমার দিকে ঝুকে আসলেন। বললেন, তোমার কি আমার উপরে অনেক রাগ হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে? “ জোরে একটা টান দিলেন সিগ্রেটে। “আমার জন্য তোমার বাবা এতো বড় আঘাট পেলো। কর্মহীন হয়ে গেলো। কিন্তু কে এমন জানতো বলো?”আমিই জেনেছি কত পরে।“ আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনি জেনেছিলেন?” তিনি বললেন, “হ্যা। তাও দশ বছর পরে। একটানা ব্যবসা লস খেতে খেতে হঠাৎ করে ঘুরে দাড়িয়েছি সবে। তখন একদিন আমার ছাত্র সাইফুল ছুটে আসলো বাসায়। সেই কতদিন পর দেখা। দশ বছর পার হয়ে গেছে। আমি বললাম, কি রে? সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদলো। সাইফুলও আওয়ামী লীগ করতো তখন। তোমার বাবার সাথে সেও ছিলো সেই কাষ্টডিতে”
তিনি কিছুক্ষন তার অকেজো হয়ে যাওয়া পা টি নড়ালেন। সামনে পিছনে। নিঃশ্বাস ফেললেন গাঢ় ভাবে। “তারপর থেকেই আমি নকলাতে যাওয়া শুরু করেছি,। শুধু মাত্র তোমার বাবাকে খুজে পাবার জন্য। রসু মিয়া তখন সদ্য এরশাদের দলে যোগ দিয়েছে। সুতরাং তার শক্তি অনেক। তবে আমি তাকে বলেছিলাম, যদি আবার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আছে, কোনদিন তাহলে তার এই পাপের শাস্তি কড়ায় গন্ডায় পেতে হবে।রাজাকারের বাচ্চা“ কেন জানি তার গল্পে আমার আকর্ষন কমে গেলো। তাছাড়া ভিতরে আমার অনেক কাজ। আমি বললাম, “চাচা আর কিছু বলবেন? আমার আজ অনেক কাজ” তিনি ব্যথিত চোখে তাকালেন। তারপর আবার শুরু করলেন, “দল ক্ষমতায় আসার পরপরই আমি সেই বাসা পুনরায় উদ্ধারের কাজে লেগে গেলাম। আমি বাসা পাবোই। আর এই রসু মিয়াকে ফাসিতে ঝোলাবো। কেবল তো একবছর গেলো। “ আমি হাসলাম। কৌতুকের হাসি। তারপর বললাম, আপনি আমাদের খোজ পেলেন কোঁথায়?
তিনি একটা পেপার কাটিং দেখালেন। আমি দেখলাম সেখানে লেখা, “মুক্তিযোদ্ধা জহির আশরাফের খোজ চাই।“ অনেকগুলো কথা শেষে তারিখ লেখা, ১১/০৭/১৯৯৭। মানে একবছর আগে। তিনি আনন্দ গলায় নিয়ে বললেন“তোমাদের খোজ পেয়েও গেলাম। কিন্তু দেখো আসতে আসতে ছয় মাস পার হয়ে গেলো। তবুও যে পেলাম সেই অনেক। আমি জহির ভাইয়ের সাথে দেখা করবো। তাকে জড়িয়ে ধরে কাদবো। আমার অনেক কিছু করার আছে তার জন্য।“
তার এসব কথায় আমার তেমন কোন চিন্তা হলোনা। কিন্তু অবাক লাগলো যে তিনি পেপারে “মুক্তিযোদ্ধা” শব্দটি সম্বোধন করেছেন। আমি বললাম, “চাচা ঠিক আছে। যে ঘটনা ঘটেছে সেতো পুরোই কাকতালীয়। কিন্তু আপনি বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা কেন বলছেন? তিনি তো যুদ্ধ করেননি।“ হতভম্ব চোখে তিনি আমার দিকে তাকালেন। ততক্ষনে বাসাতে মিনু আর মিনুর স্বামী এসে পৌছাইছে। আমি দ্রুত তার কাছে গেলাম। মৃদু কান্নার স্বরে বললো, বাবা কোথায় ? আমি বললাম, ভিতরের ঘরে যা। আমি আসছি।
ফিরে এসেছি। জহির চাচার সামনে গুয়ে বসেছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই কথাটা খুব ভুল বললে তুমি, জহির ভাই মুক্তিযোদ্ধা নন?
-অন্তত তিনি তাই বলতেন। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলতেন না। “
-তিনি কি ভেবেছেন সেটা আলাদা কথা। কিন্তু তোমার বিবেক কি বলে।
-আমার বিবেকও বলে তিনি ভুলের স্বীকার। “ জহির চাচা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর শুরু করলেন।
-জহির ভাই যেদিন ধরা পরেন সেদিনই দুপুর বেলা তার সাথে আমার দেখা। আমরা দীর্ঘদিন একসাথে গল্প করেছি, ঘুরেছি, খেয়েছি। জহির ভাই আওয়ামীলীগ করতেন না হয়তো। কিন্তু তার পুর্ণ সমর্থন ছিলো আমাদের প্রতি। পচিশ মার্চের রাতের ঘটনা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই যেকোন উপায়ে ভারত যাবো। দেশের জন্য যুদ্ধ করবো। জহির ভাইয়ের সাথে সে গল্পও করেছি। আর আগে থেকেই বন্দুক চালানো, লড়াই করা এসব তো আমার জানাই ছিলো। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে আমি সিদ্ধান্ত নেই যুদ্ধে যাবো, ১৬ এপ্রিল তারিখ আসরের নামাজ পরেই আমার চলে যাবার কথা। ১৫ এপ্রিল গ্রামে পাক আর্মি ঢুকলো। সন্দেহবাদীদের ধরে নিতে লাগলো একের পর এক। আর এর মাঝে জহির আশরাফ নামে ভুল মানুষকে তুলে নিয়ে গেলো।“ আমি বললাম, সেসব তো আমরা জানিই।“ জহির অ্যাংকেল বললেন, তুমি যা জানোনা তা বলি তাহলে? জহির ভাই মাগরিবের নামাজের কাছাকাছি সময়ে ধরা খেলেন। তাকে নিয়ে আসা হলো ক্যাম্পে। পাক আর্মিরা তাকেই আমি হিসাবে ধরে নিলো। জহির ভাই কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন আর্মিরা ভুল করছে। কিন্তু তিনি রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত মুখ বুঝে সহ্য করে গেলেন। বললেন না , তারা ভুল করছে। এমনকি রাজাকাররা বলার পরেও। কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? তিনি অনেকটা ঝুকে এসে বললেন, কারন তিনি বুঝেছিলেন তিনি স্বীকার করার সাথে সাথেই তাকে রেখে পাক আর্মিরা আমাকে খুজতে বের হবে। আমার আর যুদ্ধে যাওয়া হবেনা। আমি ধরা পরবো। তাতে একটা মুক্তিযোদ্ধা কমে যাবে। একজনের যুদ্ধ অন্তত শেষ হয়ে যাবে। আমার ছাত্র সাইফ তাকে ফিসফিস করে বলেছে, বলছেননা কেন? তিনি উত্তরে বলেছেন, শুধু জহির ভাই পার হয়ে যাক। সে যাক। আমি বললেই আমাকে ফেলে তাকে খুজবে। তাকে ধরতেও পারবে হয়তো। নিজে মুক্তিযুদ্ধে যাইনি একজন যাচ্ছে , এতোটুকু করবোনা?
আমার গা একটূ কেপে ওঠে, আজ সকাল থেকে অনেকবার কাদতে গিয়েছি, কাদতে পারিনি, এবার একটু চোখে জল চলে আসলো। জহির "আংকেল, আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেক রাতে যখন তিনি সত্য বললেন, পাকিস্তানীরা তাতে আরো রেগে গেলেন।কি ভয়ানক কষ্টই না মানূষটা পেয়েছেন। আর তুমি বলো , তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন? আমি বিরবির করে বললাম, “আমি তো এসব জানতাম না।“ তিনি ক্রদ্ধ গলায় বললেন “এসব ব্যাপার না হলেও কি তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়না। ভুল ভাবে যারাই মার খেয়েছে কোন না কোন ভাবে তারা কোন একজন মুক্তিযোদ্ধা কে বাচিয়ে দিয়েছেন। আজ মুক্তিযুদ্ধে আমি যা করেছি তার অর্ধেক ভাগীদার জহির ভাই।“ তিনি এবার একটু শান্ত হলেন। আকুল হয়ে বললেন, “এবার অন্তত তার সাথে দেখা করিয়ে দাও।“ আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “তিনি এই বাসাতেই আছেন।মৃত হয়ে। আজ সকালে তিনি মারা গেছেন। ঠিক নয়টার সময়।আপনি বেশ দেরী করে ফেলেছেন চাচা“ জহির চাচা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষন। অনেক চেষ্টা করেও জলের ঢেউ ধরে রাখতে পারলেননা। কিছুতা স্থির হয়ে বললেন, আমি তাকে একজন মুক্তিযুদ্ধের সম্মান দিয়েই দাফন্ করাতে চাই। আমি পারবোও। আমি দৃঢ় গলায় বললাম, না। তিনি তা কোনদিনই চাননি।
-তার কবরে নাম ফলকে মুক্তিযোদ্ধা লিখতে চাই।
-না চাচা, তিনি এমনও চাননি কখনো।
- তোমাদের নকলার বাসাটা তার স্মৃতিতে নতুন করে সাজাতে চাই।
-না চাচা। এমনকি নকলার বাসাটাও আমাদের দরকার নেই। প্লিজ।
-তুমি কি তাকে জড়িয়ে ধরতেও দিবেনা? আমি কি তার দাফনের সময় থাকতে পারবোনা?
বাসায় ততক্ষনে কোরানে হাফেজ ছেলে গুলো ঢুকতে শুরু করেছে। খাটিয়া এসেছে। কাফনে কাপড়। আমি জহির চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, অবশ্যই এগুলো আপনি পারেন। আসুন আমার সাথে চাচা। আমি তার একহাত ধরে এগুতে লাগলা। কেন জানি বাবার হাতের মতোই লাগছিলো। আমি আরেকটু শক্ত করে তার হাত ধরলাম।