পোস্টস

সমালোচনা

স্বর্গছায়া: সাধনাবিহীন কবিতার প্রশান্ত সাগরে কবির ডুব- সাঁতার হয় না।

২০ জুন ২০২৪

এস এম শাহনূর- কবি ও গবেষক

মূল লেখক মো. জমির হোসেন পারভেজ


 

সাধনাবিহীন কবিতার প্রশান্ত সাগরে কবির ডুব-সাঁতার হয় না। উৎকৃষ্ট শব্দ চয়নের সমাহারে শ্রীবিন্যাসের পুঁথি না গাঁথলে - সে পুঁথির মালা গলে না পরলে কবি নামের সাধক- ঋষি কখনো হওয়া যায় না। সংস্কৃতির অনন্য শহর, মহা মনীষীর চারণ ভূমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী বিধৌত বল্লভপুর গ্রামের কৃতি সন্তান, তিতাস নদীর জলের সফেদি উচ্ছ্বাসে বড় হওয়া ড. এস এম শাহনূর সেই সাধকের তপোবনের একজন সাধক- কবি। তিনি ভাষ্কর র‍্যোঁদার  মতো কথা ছলে ছন্দের ঝংকারে মূর্তি তৈরী করেন। সে মূর্তির নাম কবিতা। আর সে অপূর্ব অনন্য কবিতা - নারীর অবয়বের মূর্তিমান হয়ে - স্নিগ্ধ- সৌরভের পরশ ছড়িয়ে চেতনা বিহীন পাঠকের চিত্তাকাশে মেঘের ঘর্ষণের মতো বিদ্যুৎ চমকানোর  প্রতিকৃতি তৈরী করে বজ্রপাতের বিকট তৌর্যক শব্দে চৈতন্যের ডাকে এক চেতনার ইমারত নির্মাণ করেন।
বইটিতে কোনো বিষয় বাদ পড়েনি। ভ্রমণ জীবনের স্মৃতিকথাও কবি সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন, প্রেম - অপ্রেম, মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়, দুর্নীতি, বিশ্বাস ঘাতকতার চিত্রও তুলে ধরেছেন। স্বদেশ প্রেম প্রতিহিংসার বর্ণনা করেছেন কাব্যিক রসে।

বইটির প্রচ্ছদ নামের নব বধূর ঘোমটা খুঁলতেই রাতের শশীর কিরণের মতো কবিতারা ঝলমল করতে থাকে চমৎকার শব্দের তরঙ্গমালায়। কবিতায় প্রসূডি ও রিটুরিক অপরূপা দীঘল কেশী পল্লিবালার আলতারাঙ্গা পায়ের মলের শব্দে আমি বিমোহিত হই, কবিতার প্রেমে পড়ি। অসাধারণ বাক্যালংকারের ছন্দের তর্জনিতে আমার ঘুমাচ্ছন্ন চোখের পাতা বারংবার পলক ফেলে যায়।
"স্বর্গছায়া"র কবিতারা সারারাত অবধি আমাকে নির্ঘুমে জাগিয়ে রাখে ছন্দের সোনার কাঠি, রুপার কাঠির জাদুকরী মন্ত্রে।

তাঁর রচিত "খোকার জন্মদিন" কবিতায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশ নামের মহাকাব্যের রচয়িতা প্রমিথিউস রূপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সু-কর্ম, নিপূণ নেতৃত্ব, আত্মত্যাগে মহিয়ান হয়ে উঠার কথা প্রতীকী অর্থে ছন্দের মূর্ছনায় অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ কবিতায় আমি কবিসত্তার জলছাপ দেখতে পেয়েছি, কবিকে আবিষ্কার করেছি- 
" আজি হতে শতবর্ষ আগে খোকার জন্ম হল 
বাঙালির প্রাণে বঙ্গবন্ধু , দুনিয়া বিশ্ববন্ধু বল।"

"বটতলীর মেলা" কবিতায় কবি আশৈশবের স্মৃতিরোমন্থনের নীলাদ্রির সানুতে চড়ে বৈশাখী উৎসবে পসরা সাজিয়ে রাখার দৃশ্যায়নে অবগাহন করেছেন; অতঃপর বিখ্যাত চিত্র শিল্পী- এস এম সুলতানের মতো রং তুলিতে বৈশাখী মেলাতে সখা- সখির সাথে ঘুরাঘুরি চিত্র এঁকেছেন-- কবি চোখের মেধামননের অন্তর্দৃষ্টিতে।

" বৈশাখে মন পড়ে রয় বটতলীর ঐ মেলায় 
সখা সখি গিয়েছিনু জড়াজড়ি ধরি গলায়। "
কবির বেদনার আঁখি জল নিঃসৃত হলে কাজল রাঙ্গা চোখের নিচের অংশের ত্বক গড়িয়ে পড়ে কপোলে কৃষ্ণনদীর রেখা এঁকে যায়। সেই কলঙ্কিত রেখা দেখেই কবি জ্যোতিষ ভাবনায়-- সমাজের বৈষম্য, নিন্দা, ঠকানো, ভেজালের চিত্র নকশা করেন নকশিকাঁথার মাঠে বসে কলমকে সুই - সুতার বন্ধনে আবদ্ধ করে -- কবির দু' লোচনের জ্যোতি ছড়িয়ে যান 'স্বর্গছায়া' কাব্যগ্রন্থের মানচিত্রে। সেই মানচিত্রে শিশিরস্নাত সবুজ ঘাসের কালিতে রচিত হয়েছে--
"তুমি ভেজাল হলে আমিও পুরো ভেজাল 
নির্ভেজালের হিসাব নিকাশ করবে মহাকাল।"

"কিংকরী" কবিতায় কবি নারীকে দেখেছেন-- সাধক কবির চোখে। নারী এক শিল্প, এ শিল্পের মহা সমুদ্রে পুরুষ অভিযাত্রীক ম্যাগালায়নের অভিলাষীক চোখে  এক  নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে নতুন প্রজন্মের জন্য  নতুন স্বর্গ অন্বেষণী পথ দেখিয়ে অমরত্ব লাভের সূত্র অঙ্কন করে যেতে পারে সে কথা যেমন কবিতায় প্রতীকী রসালো  বাক্যে দেখিয়েছেন;  তেমনি নারী নামের সেই পাপাত্মার সমুদ্রের উত্তাল শৈল সম রোষতরঙ্গে ডুবিয়ে পুরুষকে হাবিয়ায় পুড়াতে পারে তার চিত্রও এঁকেছেন ছন্দের সাপ-লুডু খেলার ছলে। যেমন তিনি বলেছেন--
"পাপাত্মা নারীর ভুলের বেড়াজাল থেকে 
নারীর পদতলে জান্নাত খুঁজে মহা পুরুষ।"

"এসো বৃক্ষতলে" কবিতার চরণে চরণে কবি মানবাত্মার মাঝে কবির অন্তরালে কৃষকের লাঙ্গলের ফলা চালিয়েছেন। নবরুপে চাষ করেছেন চাষির ভূমিকা নিয়ে। মানব আত্মায় চাষ করা যায় সে বোধ আগে আমার উদয় হয়নি। আমরা আমাদের আত্মাকে পবিত্র, নির্মল, শুদ্ধ করণের মাধ্যমে সুন্দর জীবন, মনুষ্যত্ববোধ, সদালাপী, সত্য-ন্যায়ের অমরত্ব সোধা পানে স্মরণীয় বরণীয় কিংবা মহামনীষীর শ্রেণিতে উপনীত হতে পারি, সে কথা প্রত্যুষের পাখির কলরবের ছন্দের সুরের ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন এই ভাবে। 
"শুদ্ধ আত্মার বৃক্ষ দেয় বিশুদ্ধ বায়ু 
ফলে বল, ফুলে সুরভী, বাড়ে আয়ু। "

কবি 'মরণ' কবিতায় দর্শনের দৃষ্টি সঞ্চালন করেছেন তপস্বীর ধ্যানের প্রতিফলন ঘটিয়ে। হতাশা ব্যঞ্জনা, হিংসা- প্রতিহিংসার রঙ্গমঞ্চ ভেঙ্গে মৃত্যু অনিবার্য ভাবে এসে চার বেয়ারার পালকিতে দেহটাকে চড়াবে, সে কথা এ কবিতায় এ ভাবেই তুলে ধরেছেন--
"দুনিয়াবি অর্জন দুশ্চিন্তার কারণ 
মরণ একদিন সব-ই করবে হরণ। "

'দেশ' কবিতায় কবি স্বদেশ প্রেমের এক স্মৃতিসৌধ শহীদি আরক্তে রঙ্গিন করে নির্মাণ করেছেন। আকাশছোঁয়া ভালোবাসার অনুভূতির প্রকাশের এক পসলা বৃষ্টি ঘটিয়ে, প্রাতঃকালের আবির রাঙ্গা বীর চেতনার উদয়ে বীরত্বের হুঙ্কারের উক্তি প্রকাশ করেও কবি এখানে বেহালার সুরে আত্মত্যাগী লক্ষপ্রাণকে পরম মমতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন--
"লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা 
কেমনে ভুলিব এমন ত্যাগের কথা।"

শুধু এ কবিতা গুলোই 'স্বর্গছায়া' কাব্যগ্রন্থকে উচ্চ আসন দেয়নি, নিন্মের কবিতাগুলোও ভাবগাম্ভীর্যে অনন্য।

"পচা কাদার শুকনো ঠনঠনে মাটির মূর্তি ! 
ভিতরে স্রষ্টার সত্তা, ষড়রিপুর প্ররোচনা, 
অধরে রূপের জৌলুস কেমনে থাকে হুঁশ।"
(কবিতা- মানুষ ও মানব)।

"কোরআন পুরাণ বাইবেল চষে কী লাভ? 
মানুষ হয়ে মানুষেরে ঘৃণা এ যে মহাপাপ।" (কবিতা- মহাপাপ)।

"গাঁয়ের মায়ায় যোগী ভিন দেশে ন‘ যায় 
ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে বারেক ফিরে চায়।"
(কবিতা- গেঁয়ো যোগী ভিক্ষা পায় না)।

"সহসা সত্যালোকে টুটে মিথ্যের বাঁধন 
একান্তে প্রভূর পদতলে আত্মসমর্পণ। 
(কবিতা- কেউ সত্য খোলে না)।

"পরিচয় পর্বে আপনাকে জানাবে মোবারকবাদ, 
বিদায় কালে ভুল হবে না দিতে ধন্যবাদ। "
(কবিতা- সাগর কন্যা সাইপ্রাস)।

"আমি তো পড়েছি লেবাননের রাজধানী বৈরূতের প্রেমে, 
সময় পেলেই চষে বেড়াই অলিগলি আর নিশীথে ঘুমে।"
(কবিতা- অবাক শহর-সবাক দেশ)।

"করোনা এসেছে দুনিয়ার হালাল হারাম চেনাতে 
করোনা এসেছে এক আল্লাহতে ঈমান শেখাতে।"
(কবিতা- করোনা মুক্ত বিশ্ব চাই)।

"হারানো সুন্দর পৃথিবীর রূপ ফিরে পেতে চাই
মহান আল্লাহর দয়া ও কল্যাণ পেতে চাই।" (কবিতা- আত্মসমর্পণ)।

কবির সাধনা অব্যাহত থাকুক, নব সৃষ্টি হোক অবিরত। কবি তাঁর লেখনিতে গৌরবের মুকুট পরুক। সংস্কারক মনে মশাল জেলে জ্ঞানের সূর্যোদয়ে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে নিয়ে যাক অনন্য স্থানে ।

 

লেখক: কবি ও নাট্যকার