পোস্টস

গল্প

দীর্ঘশ্বাস

২০ জুন ২০২৪

সুকান্ত সোম

 

 

সোবাহান মোল্লা স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে , কিছুক্ষন পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে এই বর্ষায় নাতিকে একটা ফুটবল কিনে দেয়ার কথা আছে। গত বছর ও চেয়েছিল কিন্তু সে কিনে দিতে পারে নাই।অভাব যাদের নিত্য সঙ্গী সামান্য কটা টাকা কখনো কখনো এত বেশি মনে হয় যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার আবার সখ । সে মনে মনে ভাবে আকাশ এতো স্বচ্ছ কেন? প্রকৃতি এতো ধূসরে কেন? প্রকৃতির মনে যেন সুখ নাই। বর্ষাকালে প্রকৃতি যে রুপে সাজে তা যেন  কোথায় হারিয়ে গেছে ।বর্ষায় আর বৃষ্টি হয় না , শীত কালে শীত পড়ে না , হয়তো এর সবই হয় তবে কখনো আগে আবার কখনো পরে । প্রকৃতি যেন নির্বোধ হয়ে গেছে কিংবা অকাল পক্ক বালকের মত আচরণ করে। কিন্তু তাই বলে এই বর্ষায় সোবাহান মোল্লা মন থেকে মেনে নিতে পারে না । মনের গভীরে সু গভীর দুঃখ থাকলে তা যেমন দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসে তেমনটা মনের অজান্তেই সোবাহান মোল্লার বেড়িয়ে আসে। এই বর্ষায় খরা যাবে তা কি সোবাহান মোল্লার মত অভিজ্ঞ আর পোড় খাওয়া মানুষ আন্দাজ করতে পেরেছিল? সে ভাবতেও পারে নি। গ্রাম ছেড়ে অনেকেই চলে যাচ্ছে , প্রকৃতির নিষ্ঠুর ব্যবহারে মানুষ আজ দিশে হারা । প্রকৃতির নিঠুর আচরনে তার নাতি শৈশব হারা হবে সে এই জীবনে কল্পনাও করতে পারেনি। অথচ তাদের সময় কত হইচই রইরই কান্ড ঘটতো এই বর্ষাকে কেন্দ্র করে। বর্ষা এলেই ফুটবলে মেতে উঠতো তারা । এখন কি সব ক্রিকেট ফ্রিকেট এসেছে । যতসব । কিন্তু তার ভাবতে ভালই লাগে ।তার নাতিটিও তার মতই ফুটবল পাগল। অথচ গত দুই মৌসুম খরার কবলে পড়ে ঠিক মত ঘরে খাওয়ার ধানই ওঠে না আবার ফুটবল কিনে দেয়ার মত বিলাসিতা। "কি গো মোল্লা আমরা সবে চলে গেনু গো । এহেন আকালের দিনে আর জান বাচানো যায় না। তুমি কি যাবা আমাদের সাথে ?" সোবহান মোল্লা সচকিত খেয়ালে চোখ ফিরিয়ে দেখে রহিমের মা পঞ্চের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ধুলায় ভরা রাস্তায় পায়ের চিহ্ন একে তার নিকটে চলন্ত পথেই প্রশ্ন তা ছুড়ে যায় । উত্তরের অপেক্ষা না করেই পা বাড়িয়ে চলে যায়,। সোবাহান মোল্লাও কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে দেয় যাও দেখিনি তোমরা , দু এক এর ভিতরে আমরাও চলে যাবনি । রহিমের মা চলে যায় অনেক দূর উত্তর শুনতে পেল কিনা বোঝা যায় না । সোবাহান মোল্লা তার গন্তব্য পথের দিকে চেয়ে থাকে , ধুলা ভরা পথে পায়ের চিহ্নের দিকে চোখ পরে । মনের অজান্তেই সে কল্পনার রাজ্যে চলে যায় , বর্ষার সময় সেখানেই কাদায় ভরা পায়ের চিহ্নর কথা মনে পরে। সে সব অতিতের কথা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে কাদায় ভরা ফুটবল মাঠের কথা মনে পরে যায়। এক ফুটবল নিয়ে কত ছেলে পুলেদের হইচই । এই আবুল বল দে বল , ইশ গোল টা ফসকে গেল বলে চিল্লায়ে উঠে । তার নাতির গোল বলে চিল্লায়ে ওঠার শব্দে সোবহান মোল্লা বর্তমানে ফিরে আসে। নাতির খেলা দেখে সোবাহান মোল্লা আনন্দ পায় যেমন আনন্দ তার ছোট বেলায় পেত । সে দেখে নাতিটা পলিথিন দিয়ে ফুটবল বানায়ে খেলছে। কিন্তু সাথে সাথে কষ্ট টা বেড়ে ওঠে যখন ভাবে নাতিটাকে ফুটবল কিনে দিতে পারে না ।নাতি নানাকে দেখেই বলে এবার কিন্তু ফুটবল কিনে দিতেই হবে নানা ।

ফুটবল যে কিনে দেব তা খেলবি কার সাথে সবাই ত গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে । আমি তোমার সাথে খেলবো , তুমি না থাকলি একাই খেলবো । ঠিক আছে আমি তোমাকে বল কিনে দেব , তুমি আর কটা দিন বানানো বল দিয়ে খেল। নাতি সউল্লাসে নিজের বানানো বল দিয়ে খেলে । গোল দেয় আর আনন্দ করে । কোন লক্ষ্য ভেদের আনন্দ । সে যা লক্ষ্য করেছে তা পুরণের আনন্দ । নাতির খেলা দেখে সোবাহান মোল্লার মনে পড়ে সেও ভাল খেলোয়ার ছিল। বাবা বল কিনে দিতে পারতো না কিন্তু তাদের পাড়ায় অনেক ছেলেপুলে ছিল তারা কয়েক পয়সা করে জমিয়ে ফুটবল কিনতো ।তাদের সময় পেলে নামকরা খেলোয়ার ছিল। যদিও তার খেলা সে কোন দিন দেখতে পায়নি। এদানিং সে বাজারে গেলে লিয়াকত আলি ডাক্তারের ডিসপেন্সারিতে গেলে সে প্লের ছবি দেখেছিল। কালো ছোটখাট মানুষ অথচ তারই কত নাম ডাক। সোবাহান মোল্লা মেরাডনা মেসি এদের নাম ও শুনেছে । সে ব্রাজিলের সমর্থক । নাতিকে কাছে ডেকে সে কোন দলে সাপোর্ট করে নাতি তরিত্ব গতিতে উত্তর দেয়। আর্জেন্টীনা সাপোর্ট করে। আর তার প্রিয় খেলোয়ার মেসি। এদানিং মেসির কথা সোবাহান মোল্লা অনেক শুনেছে । কিন্তু তার সময়কার প্লের মত হতে পারবে না ।নাতি আবার খেলতে চলে যায়।

না এভাবে বসে থাকলি চলবিনানে ওই পাড়ার রইস এর কাছে যেতে হবে ক্ষেতে পানি দিতে হবে । পেটে ক্ষুধাও লেগেছে । দুটো খেয়ে না হয় যায়। কইরে মা দুটো খেতে দে দেখি। দিচ্ছি বাবা যাও হাত মুখ ধুয়ে আস।সোবাহান মোল্লা নল্কুপের পানিতে হাত ধুতে যায়। পানি তুলতে তার ভীষন কষ্ট হয়। অথচ আগে কলে চাপ দিলিই ভগ ভগ করে পানি উঠতো। অতি কষ্টে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসে যায়। সে খেয়ে দেয়ে নাতিকে গোসল করার কথা বলে যায় । পুকুরে গোসল করার মত পানি নেই ওখানে ময়লা পানিতে যাস্নে কিন্তু। কলেই গসল টা সেরে নিস । মাকে বলিস পানি তুলে দেবেনি। হাতে ছাতাটা নিয়ে সে রইসের ওখানে যায় । গিয়ে রইস কে ক্ষেতে পানি দিতে বলে । রইস জানায় যে দু তিন দিন পরে দিবে । এখন অনেকে পানি দেবার কথা বলে গেছে। অগত্য তাকে ফিরে আসতে হয় । রইসে খুব তেল হইছে মনে মনে বলে । অথচ বইছর কয়েক আগেও রইসের ঘরে খাওন থাকতো না। সেই রইসের কত তেল। এভাবে দু এক দিন পরেই রইস ক্ষেতে পানি দিয়ে যায়। আগে বর্ষার পানিতেই ক্ষেত ঘরে উঠতো আর এখন টাকার মত টাকা খরচ আর মানুষে মুখে তেল দেয়া । ক্রমেই খরা বাড়তে থাকে । তবুও মেশিনের পানিতে , সারে যাই খরচ হোক ধানটা মনে হয় ঘরে তুলতে পারব । এইবার ধান বিক্রয় করে নাতিকে বল কিনেই দেব। সময় বেশ গড়িয়ে গেল। সোবাহান মোল্লা দেখলো আকাশে অবস্থা তেমন ভাল যাচ্ছে না । মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে । ধান পাকার সময় এমন বৃষ্টি শুভ লক্ষন নয়। তবুও সবাই ঘরে ধান তুলে ফেলে । সোবাহান মোল্লাও ধান পায় । তবে খুব একটা যে বেশি ধান পায় তা নয়। তবুও ঘরের ধান খাওয়া মানে মনে নিশ্চিন্ত থাকা আর তাছাড়া নাতিকে এই ধান বিক্রি করে ফুটবল কিনে দেবে । বৃষ্টি টা কমে গেলেই বাজারে যেয়ে ধান বিক্রি করে ফুটবল কিনে আনবে । কিন্তু বৃষ্টি থামার যেন নামই নেই। এই সময় এমন বৃষ্টি যে হতে পারে সোবাহান মোল্লা তার বাপের জন্মেও দেখেনি । তার আর তোর সইছে না। নাতিটা র মুখের দিকে চেয়ে দেখা যায় না । বল খেলবে বলে তার যেন রাতে ঘুমই হয় না ।পরের দিন বিকেলে বৃষ্টি একটু কমলে সোবাহান মোল্লা কোন রকমে ধান বের করে বাজারে নিয়ে যায় । কিন্তু তেমন একটা দাম পায়না । তবুও তার আনন্দ ধরে না । তার নাতি ফুটবল খেলবে সে দেখবে । প্রান ভরে দেখবে । বল নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় । সোবাহান মোল্লা নাতিকে বল টা হাতে দেয় । নাতি তার বলটা নিয়ে ঘরের মাঝেই খেলতে খেলতে বল বুকে জড়িয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ।সোবাহান মোল্লাও ঘুমাতে যায় কিন্তু প্রবল বৃষ্টী শুরু হয়েছে ।চাল দিয়ে পানি পড়ছে ।চালের ছিদ্র কোন রকম বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে । পরের দিন অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যায়। চারে দিকে পানি আর পানি । থৈ থৈ করছে । বাড়ির উঠান পানিতে ডুবে গেছে । সোবাহান মোল্লা খুব কষ্ট পায় খুব । না তার বাড়ি ডুবে যাবার জন্য নয় । নাতিটার ফুটবল খেলা সে দেখতে পাবে না বলে । সে মেঘলা আকাশের দিকে তাকায় আর আল্লাহ গো বলে চিতকার দেয়। এ তোমার কেমন বিচার । এতো অভাব গেছে না খেয়ে কষ্টে দিন গেছে তবুও তোমাকে দোষারপ করিনি কিন্তু আজ তোমাকে দোষ দেব নাতো কাকে দেব। এই কি তোমার বিচার ।কিসের প্রতিশোধ তুমি নিচ্ছ ।চারে দিকে তাকায় আর সোবাহান মোল্লার বুক ডুকরে কেদে উঠে । কবে যে আবার সব ঠিক হবে আর আমার নাতিটা ফুটবল খেলবে । চারে দিকে তাকায়ে দেখে অসময়ে থৈ থৈ পানি বন্দি জীবন , বন্দি শৈশব। মেঘলা আকশের দিকে তাকায় আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাথে চোখ দিযে পানিও গড়িয়ে পড়ে । সে দীর্ঘশ্বাস যেন প্রকৃতির দীর্ঘশ্বাস আর তা যেন পানিতে নিভে যায।