পোস্টস

গল্প

একদল গাঁধা (রম্যগল্প)

২০ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

একদল গাঁধা (রম্যগল্প)

▪পার্থসারথি

     *

হরিপদ, কালিপদ, উমাপদ, দিলদার, আক্কেল আর রহমত ওরা সবাই হরিহর আত্মা। ওরা একই গ্রামের বাসিন্দা। আনন্দপুর গ্রাম। সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় আর আনন্দ-বেদনায় একে অপরের পাশে থাকে সবসময়। কেউ কাউকে কখনও কোনরকম বিপদে ফেলে চলে আসে না। ওদেরকে গ্রামের কেউ বলে বোকার দল, কেউবা বলে গাঁধার দল, কেউবা বলে সহজ-সরল আবার কেউবা বলে অন্যকথা। তবে যে যা'ই বলুক, ওরা ওদের মতোই চলে। পারলে কাউকে উপকার করবে কিন্তু কখনও কোনরকম অনিষ্ট করে না।

আজ ওদের আনন্দের দিন। কারণ রাতে ওরা সবাই যাত্রাপালা দেখতে যাবে। প্রিন্সেস রত্না বলে কথা। যাত্রাপালা হবে পাশের গ্রামে। নৌকায় যেতে এক ঘন্টার পথ। ওরা নৌকা ঠিক করেই রেখেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

     *

যাত্রা শুরু হবে রাত দশটার পর। আর চলবে সারারাত। ওরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছে খাবার-দাবার আর হুকার আয়োজন। প্রধান মাঝি রহমত হাঁক ছেড়ে বললো- সবাই নৌকায় ওঠো। এখনই নৌকা ছাড়বো।

কালবিলম্ব না করে সবাই নৌকায় ওঠে যার যার অবস্থানে গিয়ে বসল। নৌকার হাল ছাড়া আরও দুটো দাঁড়টানা বৈঠা। ওরা হাত বদল করে করে দাঁড় টানছে। আর হুকাটাও একটু পরপর হাত বদল হচ্ছে। মাঝে মাঝে চলছে গলা ছেড়ে ভাটিয়ালী গান। সবকিছু মিলিয়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। আর সবার মাঝে আনন্দের ছড়াছড়ি। বর্ষাকাল চারদিকে অথৈ পানি আর পানি। দাঁড় টানার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভাটিয়ালী গানকে আরও মধুময় করে তুলছে। 

প্রায় ঘন্টাখানেক পর গলা ছেড়ে কালিপদ জিজ্ঞ্যেস করে- টর্চটা জ্বালিয়ে দেখ, আর কতদূর পথ বাকি আছে। 

রহমত সামনের দিকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে শুধু রাশি রাশি পানি। গ্রামের কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। রহমত শংকা প্রকাশ করে বলে- আমার মনে হয় আরও অনেক দূর আছে। ঐ আরও জোরে দাঁড় টান দে।

কালিপদ রহমতের সাথে তাল মিলিয়ে বলে- হবে হয়তো, যা উল্টো স্রোত বইছে। তবে এতক্ষণেতো পৌঁছে যাবার কথা। ঠিক আছে, আরও জোরে দাঁড় টানো।

সবাই সমস্বরে ছন্দে ছন্দে বলতে লাগলো- আরও জোরে দাঁড় টানো হেইয়ো, আরও জোরে দাঁড় টানো হেইয়ো, আরও জোরে দাঁড় টানো হেইয়ো।– সবাই বেশ চঞ্চল এবং উদগ্রীব যথাশীঘ্রই যাত্রাপালা দেখবে বলে। বিশেষ করে প্রিন্সেস রত্নার মন পাগল করা নাচ।

এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু এখনও ওরা পৌঁছাতে পারেনি। সবাই হতোদ্যম হয়ে মন খারাপের হাওয়ায় অলস হয়ে গেল। কারণ এখনও রাশি রাশি পানি চোখের সামনে। তার ওপর হুকার কলকেয় আগুন নেই। হুকা টানাও অনেকক্ষণ বন্ধ। সবার শরীর ও মনের আনন্দ যেন মিইয়ে গেল।

     *

রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোর হয় হয় ভাব। সবার মধ্যে হুকা টানার নেশাটা চাড়া দিয়ে ওঠেছে। হরিপদ গলা ছেড়ে বলে- রহমত, ওইতো পেছনে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। নৌকাটা ঘুরিয়ে ওখানে ভিড়িয়ে দে। একটু আগুন নিয়ে আসি। যাত্রা না-হয় দেখতে পারলাম না। কিন্তু হুকা ছাড়া একদম চলতে পারছি না।

নৌকাটা পাড়ে ভিড়াতেই হরিপদ কলকে হাতে একলাফে নামে। আবছা অন্ধকার তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলেন এক মহিলা উঠান ঝাড় দিচ্ছে।

হরিপদ গলা খাঁকাড়ি দিলেন। পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেয়ে মহিলা লজ্জায় অবনত হয়ে মাথার ঘোমটা আরও লম্বা করে টানলেন। হরিপদ আবার গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললেন- মাগো, একটু আগুন হবে?

মহিলা উঠান ঝাড় দেয়া বন্ধ করে একটু সতর্ক হলেন এবং ভাবছেন- কন্ঠটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে হলেও বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। কিছু না বলে সতর্ক হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন পরবর্তী ডাকের জন্য।

হরিপদ এবার একটু গলা চড়িয়ে বললেন- মাগো, একটু আগুন হবে? কলকেতে একটুও আগুন নেই। আমরা হুকা টানতে পারছি না।

মহিলা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে, সে তার নিজের স্বামী। কয়েক কদম এগিয়ে কাছাকাছি এসে ঘোমটাটা তুলে চোখজোড়া বড়বড় করে তাকিয়ে ঝাঁটা উঁচিয়ে বললেন- সারারাত ছাইপাশ গিলে নিজের বউকে মা ডাকা হচ্ছে! মাতাল কোথাকার! কাছে এসো, তোমাকে বুকের আগুন দিচ্ছি!

হরিপদ ভূত দেখার মতো নির্বাক ও অবাক বিস্ময়ে একপলক তাকিয়েই উল্টোদিকে দিলো দৌঁড়। এটা নিজের বাড়ি, নিজের বউ চিনতে এতক্ষণ লাগলো! এক দৌঁড়ে নৌকা ঘাটে চলে এলো হরিপদ।

এখানে এসে মাথায় দু'হাত রেখে নৌকা বাঁধার খুঁটির কাছে এসে বসে পড়ল। এখন কান্না ছাড়া গতি নেই। একে একে সবাই হরিপদর কাছে এগিয়ে এলো।

সবার চক্ষু চড়কগাছ- যেখানকার নৌকা সেখানেই আছে ঠিকঠাক বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা। সারারাত করেছে ভীষণ পরিশ্রম একদল গাঁধা।

শেষ

( স্বীকার: ঘটনাটি শিশুকালে আমাদের এলাকার লোকমুখে শোনা। তবে মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পটা নিজেই লিখলাম।)

Click & Read: বইটই-এ প্রকাশিত অসাধারণ রোমান্টিক প্রেমের কবিতা গ্রন্থ 'এক চিমটি ভালোবাসা’ এর লিংক