[অনুবাদকের ভূমিকা: কিংবদন্তি আছে যে, ডেলফির ম্যাক্সিমগুলো স্বয়ং দেবতা অ্যাপোলোর লেখা, যেহেতু অ্যাপোলোর মন্দিরের দেয়ালেই সেগুলো খোদাই করা ছিলো। আবার অনেকে বলেন, প্রাচীন গ্রিসের সাত বিজ্ঞ ব্যক্তিই এই নীতিবাক্যগুলির মূল লেখক। এই সাত বিজ্ঞ ব্যক্তি হচ্ছেন সোলোন, বিয়াস, থেলিস, ক্লিওবুলুস, মাইসন, পিট্টাকাস ও চিলন। তবে কিংবদন্তি যাই থাক, আদতে হয়তো এগুলি নেহাত মানুষের মুখে প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন ছাড়া কিছুই নয়। অবশ্য সেই কারণেই এগুলি মূল্যবান। কারণ গ্রীক জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ সম্পর্কে আমরা একটা স্পষ্ট ধারণা পাই এখান থেকে। বেশির ভাগ উপদেশই অবশ্য খুব মামুলি শোনায়, কিন্তু সমস্ত উপদেশের পরিণতি তো আসলে এটাই, তাই না? এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ডেলফির মন্দিরগাত্রে খোদিত হওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ নীতিবাক্যের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের ইহজাগতিক, দৈনন্দিন জীবন। একশো সাতচল্লিশটি নীতিবাক্যের একটিতেও পরকালের কথা বলা হয়নি, স্বর্গ-নরকেরও কোনো উল্লেখ নেই কোথাও। এটা অবশ্য গ্রীকদের ধর্মবোধেরই একটা মূল বৈশিষ্ট্য। একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর মতো মানুষের জীবনে অতো ব্যাপক ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা গ্রীক পৌত্তলিক ধর্মে কখনো পালন করেনি। তার উপর, এক ধরনের পরকালে বিশ্বাস করলেও কোনো গভীর পরজাগতিকতার বোধ গ্রীকদের ছিলো না। গ্রীকদের ধর্মের লক্ষ্য ও কেন্দ্র এই ইহজীবন৷ ইহজীবনকে আরো সহজ ও শান্তিময় করাই এই ধর্মের লক্ষ্য। ফলে ডেলফির উপদেশগুলিকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিক উপদেশ হিসেবেই স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারি।
ডেলফিক ম্যাক্সিম আছে সব মিলিয়ে একশো সাতচল্লিশটি। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে জোয়ানেস স্টোবিয়াস তাঁর সুবিখ্যাত অ্যান্থোলজিতে ম্যাক্সিমগুলি সংকলিত করেন। এর মধ্যে তিনটি ম্যাক্সিমকে বলা হয় এনট্রান্স ম্যাক্সিমস, যথাক্রমে ‘নিজেকে জানো', ‘অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়' এবং ‘প্রতিজ্ঞা করলে তো নিজের বিপদ ডেকে আনলে'। এই তিনটিই ডেলফিক ম্যাক্সিমসের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত। কিছু কিছু ম্যাক্সিমকে অন্য ম্যাক্সিমের পুনরাবৃত্তি মনে হয়। আবার কিছু ম্যাক্সিম আছে একটু জটিল, দার্শনিক প্রকৃতির। সেগুলোর নিচে অনুবাদকের ব্যাখা জুড়ে দেওয়া হলো। আজকের অনেকাংশে ন্যায়নীতিহীন যুগে অনেক মামুলি নীতিকথাও প্রায় আধ্যাত্মিক বাণীর মতো শোনায়। এরকম কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্রাকেটের মধ্যে অনুবাদক নিজেও কিছু কথা বলেছেন।]
১. ঈশ্বরকে অনুসরণ করো
(গ্রীকরা পৌত্তলিক ছিলো। সুতরাং একবচনে ব্যবহৃত হলেও ঈশ্বর শব্দটি এখানে মূলত গ্রীকদের অন্যতম মুখ্য দেবতা অ্যাপোলোকেই বোঝানো হচ্ছে)
২. দেশের আইন মেনে চলো
৩. দেবতাদের উপাসনা করো
৪. পিতা-মাতাকে সম্মান করো
৫. ন্যায়ের কাছে হার স্বীকার করো
(গ্রীকরা বোধ করি জানতো যে মানুষ স্বভাবতই ন্যায়ের বিপক্ষে, কারণ সুযোগ পেলে কেউই ছাড়ে না। কিন্তু মানুষের সদিচ্ছা ছাড়া তো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই মানুষকে স্বেচ্ছায় ন্যায়ের কাছে হার মেনে নিতে বলা হচ্ছে। অবশ্য আধুনিক যুগের রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা কিছুতেই ন্যায়নীতির কাছে পরাস্ত হবেন না। এই সিদ্ধান্তের ফলাফল আমরা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি। ন্যায়ের অবস্থা এখন ডোডো পাখির মতো।)
৬. যা শিখেছো, তা ভালো করে জানো
(শেখা আর জানা এক জিনিস নয়। যেমন, শিক্ষা আর দীক্ষা এক জিনিস নয়। ‘জানা’ ব্যাপারটাকে গ্রীকরা খুব মূল্য দিতো।)
৭. যা শুনেছো, তা ভালো করে উপলব্ধি করে দেখো
৮. নিজেকে জানো
(এই বাণীটি অবশ্য সক্রেটিসের উক্তি হিসেবেই বেশি বিখ্যাত। তবে, সক্রেটিক দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ হলেও উক্তিটি সক্রেটিসের নয়। তার চেয়ে বড়ো কথা, সক্রেটিস যে অর্থে নিজেকে জানার কথা বলতেন (অর্থাৎ নিজের আত্মা ও আত্মসত্তাকে জানা), এখানে সম্ভবত সেই অর্থে নিজেকে জানার কথা বলা হয়নি। এখানে নিজেকে জানার অর্থ হচ্ছে সমাজে নিজের অবস্থান, নিজের সামর্থ্য, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। তবে উক্তিটিকে বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করার স্বাধীনতা পাঠকের অবশ্যই আছে। সক্রেটিস সেটাই করেছিলেন।)
৯. বিবাহের ইচ্ছা রাখো
(এই ইচ্ছা নেই কার? তাকেই খুঁজে বের করা দরকার। গ্রীকরা ব্যক্তির সুশৃঙ্খল সামাজিক জীবনকে গুরুত্ব দিতো, কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে সেটাই দরকার। বৈরাগীরা রাষ্ট্রের কল্যাণসাধন করবে- এমন আশা বোধ হয় গ্রীকরা করতো না।)
১০. তোমার সুযোগ সম্পর্কে ভালো করে জানো
১১. নশ্বর মানুষ হিসেবে চিন্তা করো
(মানুষ অমর হলে তার হয়তো ঠিক সেই অর্থে চিন্তা বলেই কিছু থাকতো না। মরণশীল বলেই আমরা চিন্তা করি বা আদৌ চিন্তা করতে পারি। যাই হোক, আমরা যা কিছুই ভাবি না কেনো, আমরা যে নশ্বর, এটা যেনো কিছুতেই ভুলে না যাই। জীবনের অনেক আড়ম্বর, অনেক অদরকারি ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সেক্ষেত্রে এড়িয়ে চলতে পারবো আমরা।
মানুষ মরণশীল। কিন্তু দৈহিক মৃত্যুই কি তার চূড়ান্ত মৃত্যু? নাকি মানুষ আসলে অমর? সক্রেটিসের মতো অনেক গ্রীকই মানবাত্মার অমরতায় বিশ্বাস করতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের এই অমরতা প্রাচীন গ্রীসে তর্কাতীত কোনো বিষয় ছিলো না। ডেলফির দেবতা সম্ভবত মানুষের দৈহিক মৃত্যুকেই মানুষের অস্তিত্বের পরম সমাপ্তি মনে করতেন। ইহজীবন অস্থায়ী, তবে অনন্য।)
১২. যদি আগন্তুক হও, আগন্তুকের মতোই আচরণ করো
(গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। রোমে গেলেই রোমানদের মতো করে উঠতে, বসতে ও সঙ্গম করতে হবে, এটা বোধ হয় গ্রীকরা মানতো না। ঘরে হোক আর বাইরে হোক, আগন্তুক আগন্তুকই।)
১৩. হেস্টিয়াকে সম্মান করো/ তোমার ঘরের উনুনকে সম্মান করো
(গ্রীক গৃহস্থের জন্য hearth কিংবা ফায়ারপ্লেসই ছিলো বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ এখানে আগুন থাকতো, এবং আগুন ছাড়া তো খাদ্য-খাবার তৈরী করা সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্ভব নয়। সুতরাং এই আগুনকে সম্মান করা একজন পৌত্তলিকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। হেস্টিয়া হচ্ছেন ফায়ারপ্লেসের দেবী।)
১৪. নিজেকে নিজের বশে রাখো
(আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাবই অধর্মের কারণ, নাকি অধর্মের কারণেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব ঘটে? হয়তো দু’টোই হয়। অ্যাপোলো অবশ্যই চান না মানুষ অধার্মিক হোক।)
১৫. বন্ধুদেরকে সাহায্য করো
১৬. রাগ সামলে চলো
১৭. সুবুদ্ধির চর্চা করো
১৮. দৈবকে/নিয়তিকে সম্মান করো
১৯. অকারণে দেবতাদের নামে শপথ কোরো না
(কথায় কথায় কসম খাওয়া অনেকেরই বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ দুর্বল জীব, সে কথা দিয়ে কথা না রাখতেই পারে। খালি খালি দেবতাদেরকে টেনে আনা কেনো?)
২০. বন্ধুত্বকে ভালোবাসো
২১. সর্বদা শৃঙ্খলা মেনে চলো
২২. মর্যাদার অন্বেষণ করো
২৩. জ্ঞানের আকাঙ্খা করো
২৪. ভালোর প্রশংসা করো
২৫. মানুষের দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না
২৬. সদগুণকে সম্মান করো
( ন্যায়নীতির কদর করা মুখে বলতে যতোটা সহজ, কাজে ততোটা সহজ নয়। মানুষের সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, করুণা, প্রভৃতি সদগুণের যদি কোনো মূল্য থাকতোই, তো পৃথিবীর অবস্থা এতো খারাপ হতো না হয়তোবা। আমরা সততার প্রশংসা করি, কিন্তু পূজা করি সাফল্যের। অন্যায়ভাবে যারা সফল হয়, সমৃদ্ধিশালী হয়, তাদেরকেই আমরা মাথায় করে রাখি।)
২৭. যা কিছু ন্যায্য, কেবল তারই চর্চা করো
২৮. বন্ধুর প্রতি সদয় হও
২৯. দুশমনকে চোখে চোখে রাখো
৩০. চারিত্রিক মাহাত্ম্যের অনুশীলন করো
৩১. মন্দকে এড়িয়ে চলো
৩২. নিরপেক্ষ হও
(যুক্তির মূল দাবি এটাই। যুক্তিবোধ ব্যবহার করে চললে অন্যায় পক্ষপাতের জায়গা থাকতো না সমাজে। তবে মানুষ স্বভাবতই অযৌক্তিক।)
৩৩. যা কিছু তোমার নিজের, তাকে রক্ষা করো
৩৪. যা কিছু অন্যের, তা এড়িয়ে চলো
৩৫. সবার কথায় কর্ণপাত করো
৩৬. নীরব হও (ধর্মীয় অর্থে)
(‘তোমার কথা হেথা কেহ তো ভাবে না, করে শুধু মিছে কোলাহল'। এই কোলাহল-হলাহলেই জীবন ভর্তি। আসুন, কিছুক্ষণের জন্য নীরব হই। ভাবি। ভাবা প্রাক্টিস করি। ভাবের প্রাক্টিস করি।)
৩৭. বন্ধুর উপকার করো
৩৮. অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়
(এই বাণীর অতিরিক্ত ব্যবহারও ভালো নয়। কোনো জিনিস আসলেই মাত্রাতিরিক্ত কিনা, সেটা নির্ভর করে কনটেক্সটের উপর। কনটেক্সট না বুঝেই উপদেশ দেওয়া বাঙালির মজ্জাগত অভ্যাস। এই বিশেষ উপদেশটি একটু বিশেষভাবেই বাঙালির বদভ্যাসের শিকার হয়েছে।)
৩৯. সময়ের সংযত ব্যবহার করো
৪০. আগে থেকেই ভবিষ্যতের কথা ভাবো/ পরিণামদর্শী হও
৪১. ঔদ্ধত্যকে ঘৃণা করো
৪২. কৃপাপ্রার্থীদেরকে সম্মানের চোখে দেখো
৪৩. যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে সবাইকেই জায়গা করে দাও
(আমিই সর্বেসর্বা, এই মনোভাব পরিত্যাগ করে সবার জন্যই কথার ও কাজের জায়গা করে দেওয়া উচিত।)
৪৪. তোমার পুত্রদেরকে সুশিক্ষা দান করো
(পুত্রকে শিক্ষাদানের কথাই বলা হয়েছে, কারণ গ্রীক সমাজে নারীর তেমন কোনো মূল্য ছিলো না। প্লেটো অবশ্য নারীশিক্ষার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু নারীর হীনতায় প্লেটোরও স্থির বিশ্বাস ছিলো।)
৪৫. যা তোমার কাছে আছে, তা দান করো
৪৬. প্রতারণাকে ভয় করো
৪৭. সবার ব্যাপারে ভালো কথা বলো
৪৮. জ্ঞানান্বেষী হও
৪৯. দৈবকে বেছে নাও
(দেবতাদের কাছ থেকে ভালো কিছুর আশা করলে ইহজীবনে দেবতাদেরকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। দৈবের হাত তখনই খুলবে, যখন আমরা দৈবের দিকে আমাদের হাত বাড়িয়ে দেবো।)
৫০. যথাযথ জ্ঞান থাকলেই কাজে অগ্রসর হও
৫১. কাউকে হত্যা কোরো না
৫২. যেটা সম্ভব, কেবল সেটার জন্যই প্রার্থনা করো
(সম্ভাব্যতার কোনো সীমা নেই। জীবনের অনেক অসম্ভবই হয়তো সম্ভব হয়, তবু অসম্ভবের স্বপ্ন না দেখাই ভালো।)
৫৩. জ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করো
৫৪. নিজের চরিত্রকে যাচাই করে দেখো
(আত্মসমালোচনার অভ্যাস রপ্ত করা খুব কঠিন। কিন্তু আত্মসমালোচনা যেখানে থাকে না, সেখানে দম্ভের জয়জয়কার ঘটে। যে সমাজে প্রত্যেকেই ‘সঠিক’, সেই সমাজেই দুঃখ-দুর্দশা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি।)
৫৫. যা কিছু পেয়েছো, তার প্রতিদান দাও
৫৬. কাউকে তুচ্ছ কোরো না
৫৭. আপন দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার করো
৫৮. যা করতে চাও, করে ফেলো
(জীবনে বহু কিছু করতে চেয়ে কিছুই না করার চেয়ে ধৈর্য্য ধরে কিছু জিনিস করে ফেলাই ভালো। স্মর্তব্য যে, সময় সীমিত।)
৫৯. মানুষের উপকারকে সম্মান করো
৬০. কারো প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ো না
৬১. আত্মরক্ষা করো
৬২. আশার তারিফ করো
(মানুষ তার যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও হাল না ছেড়ে বেঁচেবর্তে থাকে, এই বিষয়টাকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। মানুষের আশাকে সম্মান করা আমাদের কর্তব্য, তবে আশাই যেনো গত্যন্তর না হয়ে ওঠে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত। অন্ধ আশা নিরাশার চেয়ে ক্ষতিকর।)
৬৩. নিন্দুককে ঘৃণা করো
(নিন্দুককে ঘৃণা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিন্দুকের মতো না হওয়া।)
৬৪. ন্যায় পথে সম্পদ হাসিল করো
৬৫. ভালো মানুষকে সম্মান করো
৬৬. বিচারককে আগে থেকেই চিনে রাখো
(গ্রীক গণতন্ত্রে বিচারালয়কে বলা হতো ডাইক্যাস্টেরিয়া। এই ব্যবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের ভেতর থেকেই লটারির মাধ্যমে বিচারকরা নির্বাচিত হতেন। ফলে বিচারকদের আগে থেকে চিনে রাখা গ্রীক নাগরিকদের পক্ষে তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। আধুনিক যুগে এই উপদেশটি আক্ষরিক অর্থে অনুসরণ করা হয়তো অসম্ভব। তবে এর প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। কোর্টের ভেতরে এবং বাইরে, জীবনের প্রায় প্রতি মুহূর্তে, আমাদেরকে যারা বিচার করছে কিংবা কারণে-অকারণে মোরাল পুলিসিং করছে, তাদের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট পূর্বধারণা থাকা উচিত। আমাদের শাসক, প্রশাসক, শিক্ষক, অফিসের বস, মুরুব্বি, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঠিক কতোজন ন্যায়নীতির ধারক ও বাহক?)
৬৭. বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞান রাখো
(আগেই বলা হয়েছে, গ্রীকরা তাদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলো। ফলে এমনকি কারো বিয়েতে গেলেও কিভাবে চলতে-ফিরতে হবে, তা নিয়েও এখানে মাথা ঘামাতে বলা হয়েছে। আমরা অবশ্য একটা জিনিস নিয়েই মাথা ঘামাই: খাওয়া।)
৬৮. সৌভাগ্যের মূল্য দিতে শেখো
(আমরা যতো দুর্ভাগাই হই না কেনো, আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা লোক পৃথিবীতে আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আধুনিক যুগে মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের একটা বড়ো অংশই খুব দৃষ্টিকটুভাবেই মানবসৃষ্ট। আমাদের সৌভাগ্যের কারণ কী এবং অন্যের দুর্ভাগ্যের হোতা কে বা কারা, সেটা একটু ভেবে দেখা উচিত।)
৬৯. কারো প্রতি দায়বদ্ধ থেকো না
(অর্থাৎ, উপকার করো, কিন্তু আগে নিজে স্বাধীন থাকো। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অবশ্য দায়বদ্ধতার দরকার আছে; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমরা যতো স্বাধীন থাকতে পারি, ততোই ভালো।)
৭০. স্পষ্টভাষী হও
৭১. সমকক্ষদের সঙ্গে মেশো
৭২. খরচের দিকে খেয়াল রাখো
৭৩. তোমার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো
৭৪. লজ্জা করতে শেখো
( খুবই দরকারি উপদেশ। কারণ লজ্জা পাওয়ার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। মানুষ স্বভাবতই ভুল করে এবং তার ভুলের কারণে অনেক সময় তার নিজের তো বটেই, অন্যেরও অনেক ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে লজ্জা যার আছে, সে হয়তো পারতপক্ষে ওই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না; কিন্তু লজ্জা যার নেই, সে ঘুরে ঘুরে বেলতলায়ই যাবে। প্রমাণের দরকার আছে?)
৭৫. (দানের) পূর্ণ প্রতিদান দাও
৭৬. সুখের জন্য প্রার্থনা করো
৭৭. সৌভাগ্যকে ভালোবাসো
৭৮. যেটা কানে শুনছো, সেটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখো
(শোনা কথায় কান দিলেও মন দিতে নেই। আমরা অবশ্য মনপ্রাণ সবই দিয়ে দিই। কারণ যাচাই করে দেখার ধৈর্য্য আমাদের নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানবচরিত্রের এই প্রাচীন খুঁতটিকে আরো পাকাপোক্ত রূপ দিয়েছে।)
৭৯. যা কিছু তুমি অর্জন করতে পারবে, তার জন্য কাজ করো
৮০. কলহ-বিবাদকে ঘৃণা করো
৮১. অমর্যাদাকে ঘৃণা করো
৮২. জিহ্বা সংযত রাখো
৮৩. ঔদ্ধত্য থেকে দূরে থাকো
৮৪. ন্যায্য বিচার করো
৮৫. তোমার যা কিছু আছে, তার সদ্ব্যবহার করো
৮৬. দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে বিচার করো
৮৭. কারো উপস্থিতিতেই তার দোষের কথা আলোচনা করো
(এমনকি দেবতারাও পরচর্চা থেকে মুক্ত নন। ফলে মানুষের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বেশি সাফল্যের প্রত্যাশা করা নিতান্তই অনুচিত। তবে, আমরা যদি সবসময় মানুষের মুখের ওপর সত্যি কথা বলতে পারতাম, তবে আমাদের সমাজের অনেক ভণ্ডামি ও নোংরামি অনেকটাই কমে যেতো।)
৮৮. জেনে কথা বলো
( অন্তত, বাঙলাদেশের নেটিজেনদের পক্ষে এটা প্রায় অসম্ভব। কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলে সে বিষয়ে যে একটু হলেও জানা-শোনা-পড়া থাকতে হয়, এটা বোধ হয় তারা কখনোই মানতে রাজি হবেন না।)
৮৯. শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ো না
(শক্তি কিংবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে যে ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়, তা অস্থায়ী ও অনিরাপদ। সুতরাং বল-শক্তির উপর পুরোপুরি নির্ভর না করাই শ্রেয়।)
৯০. আক্ষেপ-অনুতাপ ছাড়া বাঁচো
৯১. একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করো
৯২. পিছনে না তাকিয়ে দৌড় শেষ করো
(আপনার চলায় তেমন গতি না-ও থাকতে পারে, কিন্তু থামবেন না, গন্তব্যের আগে কিছুতেই থামবেন না। আমাদের থেমে যাওয়াতেই জীবনের অমর্যাদা।)
৯৩. সবার সঙ্গে সদয় আচরণ করো
৯৪. তোমার পুত্রদেরকে (সন্তানদেরকে) অভিশাপ দিও না
৯৫. স্ত্রীকে শাসন করো
(গ্রীক পুরুষতন্ত্র ছিলো অত্যন্ত নিষ্ঠুর। নারীকে বলতে গেলে মানুষই মনে করা হতো না। সুতরাং স্ত্রীকে ‘শাসন করা'র কথাই যে বলা হবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।)
৯৬. নিজের হিতসাধন করো
(আপন প্রাণ না বাঁচিয়ে পরের হিতসাধন করাকে নিরুৎসাহিত কটা হচ্ছে। হিতসাধনের যেমন সীমা আছে, তেমনি সীমা আছে আত্মনিগ্রহেরও।)
৯৭. শিষ্ট হও
৯৮. যথাসময়ে প্রত্যুত্তর দাও
৯৯. মর্যাদার সঙ্গে লড়াই করে যাও
১০০. ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না
১০১. পাপের জন্য অনুতপ্ত হও
(অনেক ভাবিয়া পাপ করিলেও অনুতপ্ত হইতেই হইবে। ভাবিয়া করিও পাপ, করিয়াও ভাবো।)
১০২. চক্ষু সংবরণ করো
১০৩. সময় থাকতেই মানুষকে সুপরামর্শ দাও
(আমরা সেটা করি না। আমরা পারি খালি রায় দিতে। কোনো জিনিস ভালো না খারাপ, খারাপ হলে কতোটা খারাপ, এইটা নিয়েই আমরা রসালো আলাপের সূচনা করি। প্রতিটি বাঙালিই আসলে একেকটি চলমান হাইকোর্ট।)
১০৪. দ্রুত কাজে নেমে পড়ো
১০৫. বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলো
১০৬. কৃতজ্ঞ হও
১০৭. সঙ্গতির সন্ধানে থাকো
১০৮. গোপন কথা গোপন রাখো
১০৯. শাসনকে ভয় করো
(শাসন কোনো ভালো জিনিস নয়; না শাসকের পক্ষে, না শাসিতের পক্ষে। গ্রীকরা একটু জানতো, তবে আধুনিক যুগের মানুষ এ ব্যাপারে একটু বেশিই জ্ঞান রাখে। )
১১০. যা কিছু লাভজনক, তার পেছনে ছোটো
১১১. মাত্রা বজায় রেখে চলো
(অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়)
১১২. শত্রুতা মিটিয়ে ফেলো
১১৩. বার্ধক্যকে মেনে নাও
( গ্রীকদের কাছে জীবনের আদর্শ সময় ছিলো প্রবীণ বয়স। বালুকাবেলায় এসে ঠেকেছে জীবন; যৌবনের অস্থিরতা আর নেই, শৈশবের আনাড়িপনা আর নেই- হাজারো অভিজ্ঞতায় সম্পন্ন ও ঋদ্ধ হয়ে বৃদ্ধ মানুষ দক্ষ মাঝির মতো পথ দেখিয়ে যান বয়োকনিষ্ঠদের। আধুনিক যুগে আমরা পূজা করি তারুণ্যের; এখন এমনকি বৃদ্ধরাও চায় তরুণ হতে, তরুণ থেকে যেতে।)
১১৪. শক্তির বড়াই কোরো না
১১৫. নীরবতার অনুশীলন করো
১১৬. শত্রুতা থেকে পালিয়ে যাও
(আপনি যেচে কারো শত্রু হতে না চাইলে কেউ আগ বাড়িয়ে আপনার সঙ্গে শত্রুতা করতে আসতেই পারে। এরকম বুঝলেই আপনার উচিত হবে ওই মানুষটার সামনে থেকে যথাসম্ভব হাওয়া হয়ে যাওয়া। কারণ ঠোকাঠুকি বাঁধলেই শত্রুতার শুরু।)
১১৭. ন্যায্য উপায়ে সম্পদ অর্জন করো
( যারা এই উপদেশ মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো নজির স্থাপন করা তাদের পক্ষে একান্তই অসম্ভব।)
১১৮. মর্যাদাকে পরিত্যাগ কোরো না
(সম্মান অর্জন করার চেয়ে সম্মান রক্ষা করা কঠিন। এটি ভুলে গেলে চলবে না।)
১১৯. মন্দকে ঘৃণা করো
১২০. দূরদর্শিতার সঙ্গে বিপদের মুখোমুখি হও
১২১. শেখার বেলায় ক্লান্ত হয়ো না
১২২. মিতব্যয়ী হওয়া বন্ধ কোরো না
১২৩. দৈববাণীর প্রশংসা করো
১২৪. যাদেরকে প্রতিপালন করেছো, তাদেরকে ভালোবাসো
(একটি গোলাপের জন্য তুমি যে সময়টুকু খরচ করেছো, তার জন্যই গোলাপটি মূল্যবান, বলেছেন স্যঁ এক্সুপেরি। যার পরিচর্যা করেছি, তাকে ভালোবাসবো না কেনো?)
১২৫. কারো অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধাচারণ কোরো না
১২৬. বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান করো
১২৭. তরুণদেরকে সুশিক্ষা দাও
১২৮. সম্পদ-সম্পত্তির উপর ভরসা কোরো না
১২৯. নিজেকে সম্মান করো
(নিজের যোগ্যতাকে জানা ও সেই মোতাবেক নিজের মূল্যায়ন করার কথা বলা হচ্ছে। এই আত্মসম্মান যেনো দম্ভ কিংবা আত্মমুগ্ধতায় পর্যবসিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।)
১৩০. দম্ভের পথে পা বাড়িও না
(একবার দম্ভের পথে পা বাড়ালে দম্ভের ঢালু পথেই মানুষের অধঃপতন হয়। সুতরাং প্রথম পা-টা দেওয়া যাবে না কোনোক্রমেই)
১৩১. পূর্বপুরুষদেরকে মুকুট-শোভিত করো
( পূর্বপুরুষ মাত্রেই ভালো, এরকম নয় অবশ্য। পাঠকদের এই উপদেশটি না মানার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।)
১৩২. দেশের জন্য প্রাণ দাও
( বাঙলাদেশের জন্য প্রাণ দিলে প্রাণদান বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল)
১৩৩. জীবনের প্রতি হতাশ হয়ো না
১৩৪. মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে মজা কোরো না
১৩৫. দুর্ভাগার দুর্ভাগ্যের বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নাও
(বিভিন্ন বৈধ ও অবৈধ উপায়ে মানুষ সচরাচর ভাগ্যবানের সৌভাগ্যে ভাগ বসাতে চায়। অন্যের বোঝা ঘাড়ে তুলে নেওয়ার মতো বোকামি করে নিজের স্মার্টনেসের অভাবকে কি প্রকট করে তোলা উচিত?)
১৩৬. ক্ষতি না করেই সাহায্য করো
( কাউকে বেশি সাহায্য করলে সে যদি এক পর্যায়ে পরনির্ভর হয়ে পড়ে, তো সেটা তার ক্ষতিই। এই ধরনের ক্ষতি যাতে কোনো ক্রমেই না হয়, সেটা দেখতে হবে)
১৩৭. কারো শোকে কাতর হয়ো না
১৩৮. অভিজাত পরিবারে বিয়ে করো
(গ্রীকরা নীল রক্ত ভালোবাসতো৷ চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও অভিজাত্য যদিও সাধনা করেও অর্জন করা যায়, তবু গ্রিক সমাজে আভিজাত্যকে মূলত রক্তবাহিত ব্যাপার মনে করা হতো৷ বাপ অভিজাত হলে ছেলেও অভিজাত হবে, এরকম আর কী। বেশি টাকা হলেই কেউ অভিজাত হতে পারতো না।)
১৩৯. কারো সঙ্গে ওয়াদা কোরো না
১৪০. মৃত ব্যক্তিকে অসম্মান কোরো না
১৪১. মরণশীল মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধিশালী হও
(কথাটা দু’ভাবেই নেওয়া যায়। এই জীবনই তো একমাত্র জীবন। সুতরাং সমৃদ্ধিলাভের ইচ্ছা থাকলে আরো কর্মঠ হও, সচেতন হও৷ আবার এভাবেও ভাবা যায়- শেষ পর্যন্ত তো আমরা মরেই যাবো। তাহলে এতো দালানকোঠা দিয়ে কী হবে? একদিন মাটির বুকেতে হবে ঘর...)
১৪২. নিয়তিকে বিশ্বাস কোরো না
(নিয়তির ব্যাপারটা চিরকালই বেশ গোলমেলে। যা হওয়ার, তা হবেই- এ কথাই যদি সত্যি হয়, তাহলে আমরা এতো কষ্ট করছি কোন দুঃখে? যাই হোক, কী হবে, তা যেহেতু জানি না, সেহেতু নিয়তির অপেক্ষায় বসে না থেকে আমরা যেনো আমাদের কাজ করে যাই, সেই কথাটাই এখানে বলা হচ্ছে।)
১৪৩. শৈশবে সদাচারী হও
১৪৪. যৌবনে আত্ম-নিয়ন্ত্রক
১৪৫. মধ্যবয়সে ন্যায়পরায়ণ
১৪৬. প্রবীণ বয়সে বিচক্ষণ
১৪৭. এবং, চিরবিদায়ের আগে আক্ষেপহীন, অনুযোগহীন হও।
[সমাপ্ত]