"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জল ফুলে ফুলে মোর স্বপ্ন আঁকা
যে নদীর নীল অম্বরে মোর মেলছে পাখা
সারাটি জনম যে মাটির ঘ্রাণে অস্ত্র ধরি।"
(গোবিন্দ হালদার)
আমাদের পাশের গ্রামে কিংবা আমাদের বাড়ির পাশে, কারো কারোর ঘরের পাশে, শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক আবু, শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাহিদ আবু ও শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম সাফু চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ক’জনা তাঁদের খবর রেখেছি। কতটুকুই বা জানি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির জন্য আত্ম উৎসর্গকারী এ শ্রেষ্ঠ শহিদদের সম্পর্কে।
কুমিল্লার গৌরব তিন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মোজাম্মেল হক আবু, আবু জাহিদ আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফু। এই তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গন ও মৃত্যুস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের চারগাছ বাজারের সন্নিকট এবং তাঁদের শেষ আশ্রয় স্থল বা কবর একই উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের জমশেরপুরে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর শহীদ মোজাম্মেল হক আবুর পরিবারের মাধ্যমে কবরগুলো পাকারণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
দীর্ঘদিন ধরে এ তিন শহিদদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কিছু লেখার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করে চলেছি। আমার বাড়ি উপজেলার মেহারী ইউনিয়নের বল্লভপুর গ্রামে হলেও তাঁদের কবরগুলো জিয়ারত করার সৌভাগ্য এখনো হয়ে উঠেনি। আমার বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি পদুয়া গ্রামে। তাই খুবই ছোট্টবেলা এবং কৈশোরে জমশেরপুর ও পদুয়া গ্রামের অধিকাংশ বনবাদাড় ও মেঠোপথে ঘুরে বেড়িয়েছি। ছোট্টকাল থেকে কবিতা ও গল্প লেখায় হাতেখড়ি হলেও সেই বয়সে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু লিখব এমন চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করতে গিয়ে বছর দুয়েক আগে আলোচ্য বিষয়ের সকল প্রকার তথ্য ও লেখাগুলো আমার সংগ্রহে আসে।কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম সময় করে একদিন শহিনগণের কবর তিনটি জিয়ারত করে আসবো।অতঃপর কবরের নামফলকের ছবি দিয়ে আমার লেখাটি প্রকাশ করবো। দুর্ভাগ্য তারও সময় হয়ে উঠেনি। লেখালেখির সুবাদে পরিচয় হল প্রবীন লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক শামীম পারভেজ সাহেবের সাথে।তিনি বাংলাদেশের একজন গুণিজন। তিনি জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুর রউফ সাহেবের নাতি ও গ্রামের কৃতি সন্তান। তিনি সহ এলাকার সুধীজন গতকাল ১৬ই ডিসেম্বর সকালবেলা তিন শহীদের সমাধি বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা ও দোয়া করেন।ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে।
উল্লেখিত তিন মুক্তিযোদ্ধার রণাঙ্গণের সাথী ছিলেন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী। চারগাছের যুদ্ধে তিনিও আহত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের স্মৃতি কোনোদিনই ভুলতে পারেননি তিনি। চারগাছের যুদ্ধে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী হারিয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধা, অপর দুই কিশোর সহযোদ্ধা- আবু জাহিদ আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফুকে। অগ্রজ প্রতিম মোজাম্মেল হক আবুও শহিদ হন সেই যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়তেন আবদুল্লাহ-হিল-বাকী। যুদ্ধ শুরুর আগে শুরু হয়েছিল তার যুদ্ধ ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামের বইটি পাঠ্যতালিকা থেকে বাতিলের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। যার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। এরপর একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম… যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তখন তিনিও প্রস্তুত হয়ে গেলেন। প্রস্তুতিপর্বে নেতৃত্ব দিলেন কুমিল্লা শহরের অগ্রজপ্রতিম ছাত্রলীগ নেতারা। বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান পাখীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ধাপে ধাপে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কাজটি সেরে নিলেন তিনি। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো কসবা, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, মুরাদনগরের অংশবিশেষে দায়িত্ব পালন করার জন্য। সেই অনুযায়ী তারা যুদ্ধ করলেন বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু চারাগাছের যুদ্ধ নিয়ে এসেছিল তাদের জন্য চরম পরাজয়ের গ্লানি।
আবদুল্লাহ-হিল-বাকী বলেন, "সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই জানতে পারেন তাদের যেতে হবে মুরাদনগর এলাকায়। তাদের কমান্ডার ছিলেন নাজমুল হাসান পাখী। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ তাদের বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল। অনিবার্য কারণে দেরি হয়ে যায়। পরে রওনা হলেন ১২ তারিখে। রওনা হওয়ার পর আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণে উজানিসার ব্রিজ পর্যন্ত আসতে দেরি হয়ে যায় তাদের। একপর্যায়ে গভীর রাতে নৌকায় রওনা হন জামসেদপুরের দিকে। রাজাকারদের উৎকোচ দিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।
খালের পাড়ঘেঁষে নৌকা চলতে থাকে পশ্চিমে চারগাছের দিকে। নিশ্চিন্ত তখন নৌকার অন্যরাও। কারণ একটু আগেই চলে গেছে ঢাকার মোস্তফা মহসীন মন্টুদের একটি নৌকা। কোনো গুলির শব্দ হয়নি। তার মানে তারাও নিশ্চিন্তেই পাড়ি দিতে পারবেন পথটুকু। নৌকায় ছিলেন নাজমুল হাসান পাখী, মমিনুল হক ভূঁইয়া দানা মিয়া, মোজাম্মেল হক আবু, নৃপেণ পোদ্দার, আবদুল্লা-হিল-বাকী, আবু জাহিদ আবু, সাইফুল ইসলাম সাফু, নাবালক মিয়া, নুরুল ইসলাম, মেহরাব হোসেন ও রকিব হোসেন। ১১ জনকে নিয়ে যেন একটি পরিবার। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে আবু ও বাকীর আবার আদর বেশি। কমান্ডার নাজমুল হাসান পাখী থেকে শুরু করে সবাই তাদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন_ কোনোভাবে যেন ছোট এ দু’জনের কোনো অসুবিধা না হয়। তাদের দিকে থাকে বড়দের সজাগ নজর।
নৌকা চারগাছ বাজারের কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ আবদুল্লা-হিল-বাকীর নজরে আসে বাজারে কে যেন সিগারেট টানছে। সহযোদ্ধাদের বললেন, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। ওখানে রাজাকারা পাহারা বসিয়েছে নাকি? দেখতে পেলেন অনুসন্ধানী বাতি জ্বলে উঠেছে। বাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে শুরু করে বাজারের দিক থেকে। গুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার ভেতরে থাকা সাইফুল ইসলাম সাফু ও মোজাম্মেল হক আবু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
কমান্ডার নাজমুল হাসান পাখী সবাইকে নৌকা থেকে পাল্টা গুলি চালানো এবং আত্মরক্ষার জন্য পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। কমান্ডারের নির্দেশে আবু জাহিদ হাঁটুপানিতে নেমে পাল্টা গুলি করছিলেন। শত্রুপক্ষের একটি গুলি এসে আবুকে ঘায়েল করে দেয়। তিনি সেখানেই শহীদ হন। আবদুল্লাহ-হিল- বাকী ও মমিনুল হক ভূঁইয়া দানা মিয়া গুরুতর আহত হন।
বাকী জানান, আহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে থাকেন। ফজরের আজানের পর একটি নৌকায় করে যান চারগাছ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। তার ধারণা সেটি ছিল শিকারপুর। সেখানে এক গৃহবধূ তাকে আশ্রয় দেন। তিন দিন ছিলেন সেখানে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ওই নারী তাকে আগরতলায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
যে তিন দিন বাকী তার আশ্রয়ে ছিলেন, প্রতিদিন খবর পেতেন পাকিস্তানি সৈন্যরা চারগাছের আশপাশের গ্রামগুলো তছনছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছে।
✪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবু জাহিদ
আবু জাহিদ নাম তার। তবে কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা তাকে চিনতেন আবু নামে। পড়ত কুমিল্লা জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে। খুব ইচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে যাবে। বাড়ি থেকে অনুমতি মিলল না। শেষে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাল ও। সাঁতরে গোমতী নদী পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া টিলার কাছে মুক্তি শিবিরে এসে হাজির হলো। সময়টা তখন ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। কম বয়সের কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই ওকে দলে নিতে চাননি। কিন্তু ওর অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানলেন সেক্টর ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি। প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন আবুকে। প্রশিক্ষণের পর অপারেশন। একাত্তরের ১২ সেপ্টেম্বর। নাজমুল হাসান পাখির নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার চারগাছ বাজারের এক অপারেশনে যায় আবু। ৯ জন মুক্তিযোদ্ধার দল রওনা হলেন নৌকায় করে। কিন্তু মাঝপথেই আলবদর বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানী বাহিনী গুলি চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান দুই মুক্তিযোদ্ধা। দলের সবচেয়ে ছোট মুক্তিযোদ্ধা আবু গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। এরপর নদী থেকে উদ্ধার করা হয় আবুকে। ততক্ষণে দেশের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করে ফেলেছেন।হয়েছে শহীদ।
আবু জাহিদ একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি রণাঙ্গণে শহীদ হন। তিনি “আবু” নামে কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন।
➤জীবন:
কিশোর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু জাহিদের জন্ম ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে কুমিল্লা শহরের মগবাড়ী চৌমুহনীতে। বাবা আবুল হাসেম দুলা মিয়া ও মা ভেলুয়া বিবির পাঁচ পুত্রসন্তানের একজন আবু। ১৯৬৭ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল এ পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি।
➤মুক্তিযুদ্ধে অবদানঃ
কুমিল্লা জিলা স্কুলের নবম শ্রেণীতে থাকার সময় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আবু গোমতী নদী সাঁতরে পার হয়ে কুমিল্লা শহরের অদূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া টিলার কাছে মুক্তি শিবিরে এসে উপস্থিত হন। তখন তার শরীরের সব কাপড় ছিল ভেজা। সেখানে উপস্থিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে বয়স কম বলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে বারণ করেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর সেক্টর ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি তাকে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে আবু অবস্থান করছিলেন নিমবাগ বাদাম ঘাট হেড কোয়ার্টারে।
➤মৃত্যু:
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ রাতে নাজমুল হাসান পাখীর নেতৃত্বে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার চারগাছ বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি ঝটিকা অপারেশনে বের হন। নয়জন মুক্তিযোদ্ধার একটি বহর নৌপথে ওই অপারেশনে রওনা হয়। ওই দলে ছিলেন শিব নারায়ণ দাস, নৃপেণ পোদ্দার, মুমিনুল হক ভূঞা, মোজাম্মেল হক, সাইফুল ইসলাম, আবু জাহিদসহ আরও অনেকে। রাতের অপারেশন, তাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর এ দেশের আলবদর বাহিনীর সহায়তায় মাঝনদীতে দলটির ওপর গুলি চালায়। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে মারা যান মোজাম্মেল হক ও সাইফুল ইসলাম। কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা আবুও গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সঙ্গী এবং মুক্তিকামী জনতা নদী থেকে কিশোর আবুর মরদেহ উদ্ধার করে। অতঃপর তাকেসহ তিন মুক্তিযোদ্ধাকে নিকটস্থ জমশেরপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
➤স্বীকৃতি:
আবু জাহিদের নামে কুমিল্লা জিলা স্কুলে মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে।
✪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সাইফুল ইসলাম সাফু
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম সাফু ( জন্মঃ ১৫/০৬/১৯৫২ খ্রিঃ , শাহাদাৎ বরণঃ ১২/০৯/১৯৭১ ) ডানে … তারা দুই ভাই একই সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । একজন ( সাইফুল ইসলাম সাফু) সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন মাত্র ১৯ বৎসর বয়সে।
১৯৫২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা শহরের উজির দিঘির পাড় রাজবাড়ি কম্পাউন্ড এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল গনি, মাতার নাম করিমুননেসা, ১০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম রূপকার মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম সাফুর আপন ভাই। কানাডা প্রবাসী রফিকুল ১৯৯৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষাশীহদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রফিক তাঁর সহযোদ্ধা আবদুস সালামকে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি সংগঠন দাঁড় করান এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থনের প্রচেষ্টা শুরু করেন।
ইউনেস্কোভুক্ত বিভিন্ন দেশের কাছে রফিকুল ইসলামের অনুরোধপত্র ইউনেস্কোর সহযোগিতা ও বাংলাদেশের কূটনীতিকদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ফলে বিশ্বের ২৮টি দেশ এ প্রস্তাবের সহ প্রস্তাবক হতে রাজি হয়। পরে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কোর হেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ১৮৮ সদস্য দেশের বিনা আপত্তিতে ও স্বত:স্ফূর্ত সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। এভাবে ঘটনালো রফিকুল ইসলামের স্বপ্ন বাস্তবায়ন বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশাল উত্তরণ। এ গৌরবময় অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাঁদের সংগঠন একুশে পদক লাভ করে।
রফিকুল ইসলাম ১৯৫৩ সালের ১১ এপ্রিল কুমিল্লা শহরের উজির দিঘির পাড় রাজবাড়ি কম্পাউন্ড এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর পিতার নাম আবদুল গনি, মাতার নাম করিমুননেসা, ১০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। উজির দিঘির পাড় হরেকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুমিল্লা হাইস্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজে তিনি লেখাপড়া করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায় তাঁর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সাফু সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ কে স্বাধীনতা দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং বাঙালি জাতির তরফ থেকে বিশ্ব মানবকে দিয়েছেন এক অনন্য সাধারণ উপহার , বাঙালির ত্যাগ এবং গৌরবে গাঁথা একুশকে এনে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি … আজ পৃথিবীর সকল বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষাগুলো একুশকে ঘিরে তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে , একুশই তাদের বেঁচে থাকার উৎস … তাদের দুই ভাইকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম … আপনারা যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন বাঙালিদের হৃদয়ে।
✪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ মোজাম্মেল হক আবু
কুমিল্লা মহানগরের ১৯নং ওয়ার্ডের ঢুলিপাড়া,চৌমুহনীতে ১৯৫০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আব্দুল মজিদ মাস্টার।কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ রোড থেকে দক্ষিণ দিকে কিছুদূর গেলে রাস্তার ডান পাশে লাল-সবুজ রঙের ইংরেজি(M) বর্ণ খোদাই করা একটি স্থাপনা চোঁখে পড়বে। এটি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোজাম্মেল হক স্মৃতিস্তম্ভ।
কুমিল্লা জিলা স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মোজাম্মেল হক আবু স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে আনতে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর কমান্ডার নাজমুল হাসান পাখির নেতৃত্বে নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা হয়ে মুরাদনগর যাওয়ার পথে চারগাছ নামক জায়গায় পাক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ১১ জনের ওই দলের মধ্যে তিনজন শহীদ হন। শহীদ মোজাম্মেল হক আবু তাঁদেরই একজন।ঢুলিপাড়ার প্রয়াত আব্দুল মজিদ মাস্টারের ছেলে এ কে এম মোজাম্মেল হক আবু সহ ঐদিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের চারগাছের পাশের গ্রাম জমশেরপুরে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে কবর তিনটি শহীদ মোজাম্মেল হক আবুর পরিবারের সহযোগিতায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
এই মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য (কুমিল্লায়) এলাকাবাসীর উদ্যোগে ১৯৭২সালে শহীদ মোজাম্মেল হক স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয় যা ১৯৯৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন(কুমি ৭০৫/৯৭) লাভ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি কুমিল্লা পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সমাজ কল্যাণ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। বর্তমান যে স্মৃতিস্তম্ভটি আছে তা নির্মিত হয়েছে ২০১০ সালে। স্থানীয় প্রশাসন (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে) নিজস্ব নকশা ও অর্থায়নে এ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করে দেয়।
বাংলাদেশের মানুষের যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার মানসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তৎপরতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজে সৃষ্ট হতাশা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাঁথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা-বোন, আমাদের সমাজ এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে- এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
➤তথ্যসূত্র:
১. ↑দৈনিক সমকাল: আরেক যুদ্ধের কথা বললেন আবদুল্লাহ-হিল-বাকী
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪
২. ↑মুক্তি যুদ্ধকোষ,ষষ্ঠ খন্ড।। মুনতাসির মামুন
৩. ↑দৈনিক প্রথম আলো, “মুক্তিযোদ্ধা আবুর কথা বলছি”, গাজীউল হক | তারিখ: ১২-০৯-২০০৯
৪্ ↑মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা।
৫.↑উইকিপিডিয়া
🖊️লেখক::কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।