দেশি গাব গাছের ফুল গুলো অদ্ভুত। ছোটো ছোটো মার্বেলের মতো দেখতে। সাদা ফুল ফুটে ছড়িয়ে থাকতো গাছের তলায়। আমরা দুই হাতের মুঠোভরে সেগুলো একসাথে কুড়াতাম। ছোটো ছোটো হাতে যতোটুকুন ধরে।
ফুল গুলোর একটা অদ্ভুত ঘ্রান ছিলো। "ঘ্রানে মোহিত" কথাটার সবচেয়ে যথাযথ ব্যাবহার আমার সাথে হয়েছে এই ফুলের ক্ষেত্রে। মাটি থেকে ফুল কুড়ানোর সময়ে সেই ঘ্রান আমায় এমন অবসন্ন করে রাখতো!
ঘ্রানের ক্ষমতা তীব্র। পারফিউম নামে এই নিয়ে চমৎকার একটা সিনেমা আছে।
আমার সবচেয়ে পছন্দের গাছ গুলোর একটা লিস্ট করলে গাব গাছের কথা প্রথম দিকেই আসবে। শুধু ফুল নয়, এই গাছের সবটাই অদ্ভুত আসলে।
আমারা ছোট্ট বেলা থেকেই গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি গাব গাছে ভুত থাকে। ভর দুপুরে অনেকেই নাকি গাব গাছের ওপরে শাদা শাড়ি পরা কাউকে বসে থাকতে দেখেছে। আমি কখনো দেখিনি এটা আমার সে সময়ে বড় আফসোস গুলোর একটা ছিলো।
আফসোস থাকলেও আমরা ভর দুপুরে বা সন্ধার পরে সাধারণত গাব গাছের কাছে যেতাম না। আমাদের বাড়ির সামনেই যেই গাব গাছটা ওটার ভয়ে কতোবার যে আমি অনেকদূর ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে বাজারে গিয়েছি!
এতো কিছুর পরে পাকা গাব দেখলে এই ভয় আমাদের আটকাতে পারে নি। গাব পাকলে গাড়ো হলুদ রঙের হয় দেখতে। গাড়ো সবুজ পাতার ফাকে হুট করে যদি দেখতাম হলুদ কিছু উকি মারছে। ব্যাস আমাদের আর আটকায় কে। বেয়ে বেয়ে সেখানে উঠে যেতাম। পরিনত গাব গুলো খুব শক্ত হতো তাই ঢিল ছুড়ে বা লাঠি দিয়ে সে গাব পারা যেতো না।
গাব পাকলে হলুদ রঙ হয়ে নরম হয়ে যায়৷ দুই হাতের তালুতে নিয়ে চাপ দিলেই ভেঙে যায়। তার ভেতরে থাকে বিচিগুলো৷ আর বিচিগুলোর সাথে লেগে থাকে একটা জেলির মতো। ওটাই খায়। টপ করে একটা একটা করে বিচি মুখের মধ্যে দিয়ে দিতাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাবের কষে মুখের ভেতরে কালো হয়ে যেতো।
গাবের বিচি গুলো খুব পিচ্ছিল ধরনের হয়। যেহেতু বিচিগুলোর ওপরে জেলির মতো আবরন থাকে৷ তো এজন্যে হুট করেই দু একটা ভুলে গিলে ফেলতাম। আর তখনেই শুরু হতো দুশ্চিন্তা। সবাই বলতো যে বিচি গিলে ফেললে পেটে গিয়ে গাছ হবে৷ এক সময় সেই গাছের পাতা নাখ মুখের ভেতর দিয়ে বের হবে৷ তাই এই বিচি গিলে ফেললে সে আর ভয়ে ভয়ে কিছুদিন গাব খেতো না।
গাব গাছের ডালপালা প্রচন্ড শক্ত। চিকন ডাল গুলোও সহজে ছিড়ে যায় না। তাই অনেক মাথাতেও গাব থাকলে আমরা সেটা ছিড়ে আনতাম। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে গাব গাছের ডালপালা এতো শক্ত হবার পরেও প্রতি বছরের নিয়ম করে গ্রামের কিছু ছেলেরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গাব গাছের থেকে পরে হাত ভেঙে ফেলতো। এই নিয়েও একটা জনপ্রিয় ভৌতিক বিশ্বাস আছে। ভুতেরা গাছের উচু ডালে হলুদ মিথ্যা গাব দেখিয়ে বাচ্চাদের আকর্ষণ করে। তারপরে বাচ্চারা যখন সেই গাব পারতে গাছে ওঠে তখন সেখান গিয়ে দেখে আসলে ওমন কোনো গাবেই নেই, আর তখনেই ওই গাছের থেকে ভুতটা তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এই রকম ঘটনা আমার অনেক বন্ধুদের সাথেই ঘটেছে।
যাদের বাড়িতে ঝাকি জাল আছে তাদের গাব বিশেষ দরকার ছিলো। ঝাকি জাল হচ্ছে এমন একরকম জাল যা ডাঙা থেকে পানিতে ছুড়ে মারা হয়, আর ওটা গোল হয়ে পানির মধ্যে গিয়ে পরে মাছেদের আটকে ফেলে৷ এই জাল যাদের ছিলো তাদের গাব দরকার হতো, কাচা গাব। গাব সেদ্ধ পানি দিয়ে জালে "মালামত" দেয়া হতো।
কাচা গাব স্লাইস করে কেটে সেটাকে অনেক সময় নিয়ে পানিতে সেদ্ধ করা হতো৷ এতে একটা ক্বাথ এর মতো হতো। এর পরে সেই পানিতে জালটাকে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হতো। বেশ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপরে উঠিয়ে রোদে শুকিয়ে আবার সেই পানিতে ভেজানো হতো। এরপরে আবার শুকানো। এরকম বেশ কয়েকবার করলেই "মালামত" দেয়া হয়ে যেতো৷ এতে করে জাল শক্ত হয়, আবার জালের রঙ ও কালো হয়৷ ঘুড়ি কাটাকাটি খেলায় যেমন ঘুড়ির দরি শক্ত আর ধারালো করতে দড়িতে মাঞ্জা দেহা হয় অনেকটা ওরকম।
গাব শেদ্ধ পানি গুলো এমন কালো হয় যে অনেকেই এটাকে ব্যাবহার করে কোনো জিনিশ কালো রঙ করবার জন্যে৷ বিশেষ করে কুমার রা মাটির জিনিশ কালো রঙ করতে সেটাকে কিছুক্ষন এই পানিতে ডুবিয়ে রাখে৷ অনেক কাঠের ঘরকেও এই পানি দিয়ে রঙ করা হয়। রঙ যেমন কালো হয় তেমনি এটা কাঠকে ঘূনে পোকার খাওয়া থেকেও রক্ষা করে৷ আমি একবার আমার ক্রিকেট ব্যাট এই প্রকৃয়াতে রঙ করেছিলাম।
গাবের থেকে যেমন কালো রঙ পাওয়া যায়, পুই শাক এর দানা থেকে পাওয়া যায় লাল, কচুরি ফুল থেকে নীল। একবার এই সব প্রাকৃতিক রঙ ব্যাবহার করে একটা ছবি আঁকলে কেমন হয়?
-------
বায়েজিদ ও বৃক্ষ সিরিজ
পর্ব ৪- গাব গাছ
লেখক- মোহাম্মদ বায়েজিদ
পালং, শরীয়তপুর।