আয়োজন
সিয়াম আল জাকি
বাড়িতে যখন ইলিশ মাছ এর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে তখন মধ্যবিত্ত এর লেবাসটা খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয় কিছুক্ষণের জন্য। কিছুটা উচ্চ চিন্তা করার কথা সবসময় ভাবলেও সেই ভাবনা চিন্তা শুধু মাথার মধ্যেই বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে। বাস্তব জীবনে তার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। কিন্তু এই ইলিশ মাছ ব্যাতিক্রমী পরিবেশ তৈরী করে। বাজারের দাম আর চাহিদা এই দুই মিলে আমাদের মতো লোকের ঘরে ঘরে এমন পরিবেশ তৈরী করে।
সময়টা ভালো যাচ্ছে না। রাতে ঘুম হয় কম। পাশের বিল্ডিং এ কার না কার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিলো। সারারাত অতিরিক্ত আওয়াজ এ গান বাজনা চলতে থাকে। হিন্দি বাংলার মিলিত রুপ শুনতে শুনতে প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত আর ঘুম আসলো না। এই সকাল আটটা বাজে বাবার আদেশ এলো যাও বাজার করে নিয়ে এসো খুব ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করছে।
তার আবদার শুনে মাথায় হাত আর বুকে ধুকপুক শুরু হয়। টিউশনির টাকা পায় নি এই মাসের। স্টুডেন্ট বলে দেয় স্যার একটু টাকার সমস্যা চলছে। একটু দেরী হবে দিতে। আমার কিছু বলার থাকে না। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া বাচ্চার সাথে এইসব বিষয়ে কথাবার্তা চালানোর মতো রুচি আমার নাই। থাকলে ভালো হতো৷ মুখের উপর দু তিন কথা শুনিয়ে দিতে পারতাম। যদি আশফাক এর মতো বলে দিতে পারতাম যে কয়েকদিন পর পর পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনার করতে যাও আর বেতন দেওয়ার সময় ঝামেলা করো! এসব চলবে না। কাল থেকে আসবো না আর। এমনকিছু বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু, আমি পারি না আর পারবোও না এমন কিছু বলতে। আশফাক এর মতো চমৎকার বাগ্মী লোক হলে এমন কিছু বলা যায়। আর বড় কোনো ইউনিভার্সিটি তে ভালো কোনো সাবজেক্টে ও পড়তে হয় এমন কিছু বলতে পারার জন্য। আমার সেই যোগ্যতা নাই।
বাবার কথার উত্তরে আচ্ছা শব্দটাই উচ্চারণ করতে পারলাম শুধুমাত্র। ভেজা শার্ট শুকিয়ে গেছে। কাল রাতে ঘুমাবার আগে মশারীর উপরে দেওয়ার কারণে। এইরকম আর ভদ্র দেখতে তিনটা শার্ট আছে। যাতা অবস্থা সবকিছুর।
বাসা থেকে বের হয়ে মনে হলো এখন টাকা ধার চেতে হবে শামীম থেকে। ওর বাসা আমার বাসার কাছেই। দুই বিল্ডিং এর ব্যবধান মাঝখানে। ভালো মানুষ। তা না হলে এতোবার টাকা ধার করার পরেও বিরক্তি প্রকাশ করে না সে। স্কুল জীবনের বন্ধু এজন্যই মনে হয়। অন্য কারণ ও থাকতে পারে তার এতো ভালো হওয়ার। আবার কোনো কারণ ছাড়াই ভালো হতে পারে সে। আমরা যেন আজকাল ভুলেই গেছি যে কেউ কারণ ছাড়াও ভালো হতে পারে। কোনো কাঠামোর ভেতর দিয়ে ভালো হতে হবে এমনটাই এখন স্বাভাবিক। ভালো হওয়া আমাদের কাছে এখন বিচিত্র ব্যপার। সাধারণ ব্যপার না। অথচ ব্যপারটা খুব সাধারণ হওয়ার কথাছিলো। থাক ওসব চিন্তা করে লাভ নাই। ঐ যে বলে না হওয়ার তো কথা ছিলো অনেক কিছুই কিন্তু ঠিকঠাক কিছুই হয় নাই। এজন্যই এই অবস্থা।
এতোকিছু ভাবতে ভাবতে শামীমের বাসার সামনে এসে পরি। সংকোচ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কলিংবেল বাজাতে ইচ্ছে করছে না। খচখচ শব্দ হচ্ছে ভেতরে। মনে হচ্ছে আটকে গেছি চিরদিনের মতো নিজের কাছে নিজে। কী করছি আমি? নিজের কাছে জানতে চায়। এসবের তোয়াক্কা না করে কলিংবেল এ চাপ দিয়ে ফেলি। পুরনো বন্ধু এতটুকু তো করতেই পারে। যথারীতি জান্নাত আপু দরজা খোলে। আমাকে দেখে তিনি অবশ্যই বুঝতে পারেন কী কাজে এসেছি এই সময়ে। শামীম কোনোকোনো সময় তার থেকে টাকা নিয়ে আমাকে টাকা ধার দেয়। আপুকে বলি শামিমকে ডেকে দিতে। আপু ভিতরে চলে যান। বসতে বলেন না। বলার কথা না। কারণ বেশ কয়েক বছর যাবৎ আসা যাওয়া আছে আমার। আমি দাড়িয়ে থাকি বাইরে। শামীম বের হয়ে আসে। তার চিরচেনা মধ্য বিত্ত মুখ নিয়ে। বইয়ের ভাষায় বললে বলা যায় নির্লিপ্ত ভাব বজায় রেখে। কেমন আছিস? জিজ্ঞেস করি। সেও জবাব দেয় ভালো। কী করছিস আজকাল? তেমন কিছু না আপাতত পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছি একটু। দোস্ত টাকা লাগবে। হঠাৎ বলে ফেলি৷ ভাবনা চিন্তা ছাড়া। এভাবে না বললে অনেকক্ষণ লেগে যেত তবুও বলতে পারতাম না। শামীমের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠে। এক চিলতে হাসি যাকে বলে। পকেট থেকে এক হাজার টাকার মোট চারটে নোট বের করে দেয়। দেখে ভালো লাগে। এখন যদি প্রত্যাখ্যান অথবা অবহেলার মতো কিছু দেখতে পেতাম তবে তা সহ্য করতে পারতাম না। সেই মানসিক দৃঢ়তা নাই আমার। শামীম জিজ্ঞেস করে কী জন্য এতো সকালে টাকা লাগতাছে তোর? বাবার সাধ জাগলো হঠাৎ ইলিশ মাছ খাবে। নিয়ে আনতে বললো। মা মনে করছে টাকা আছে আমার কাছে। তাই দেয় নাই। নিজের থেকে যেহেতু টাকা দেয় নাই তাই আমিও খুজি নাই আর। অনেকদিন ধরে আমারো ইচ্ছে করতেছিলো খাওয়ার। শুনতেছি কয়েকদিন পর নাকি বাজার থেকে গায়েব হয়ে যাবে ইলিশ মাছ। লোকে বলে ইন্ডিয়ায় চলে যাবে সব। এজন্য ভাবলাম তাড়াতাড়ি কিনে ফেলি। অনেক কথা বলা হয়ে যায়। শামীম শুনতে থাকে। তার স্বভাবের সাথে যায় এটা। তারে বলি দোস্ত যায় এখন পরে কথা হবে বিকেলে রফিক ভাইয়ের ওখানে দেখা হবে। প্রায় নিয়মিত দরজায় দাড়িয়ে আমাদের এসব আলাপের শেষ হয় এভাবে।
আমি জানি শামীমের আব্বা আমাদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনে। বুড়া বয়সে আর কী বা করার থাকে মানুষের। ছেলের উপর তার বোধহয় রাগ হয়। বন্ধুদের এমনভাবে টাকা দেওয়া কোনো মা বাবার পছন্দ হওয়ার কথা না। আমি বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে ভাবি আমার বাবা আর মা হলে এসব কিছু দেখতে পারতো না একদমই। মা কয়েকবার বলতো একই কথা যে এতো টাকা হাওলাদ দেওয়া ঠিক না বন্ধুদের। বাবা গজগজ করতেন নিয়মিত। তারা এমনই। তাদের দোষ দেওয়া যায় না এজন্য যদিও। যেভাবে দিন পার করেছি আমরা সে হিসাব করলে এমন ভাবে ভাবাটা অস্বাভাবিক না।
বাজার কাছেই। এইসময়ে ভীর বেশী থাকবে। বারোটা বাজার সাথে সাথেই এই বাজারের সব ভালোকিছু শেষ হয়ে যায়। ভীড় ঠেলে মাছের বাজারের দিকে যায়। আজ আর তেলাপিয়া মাছ কিনতে হবে না বলেও এত আঁশটে গন্ধের মধ্যেও ভালো লাগ কাজ করছে। মাছ এর দিকে এগিয়ে যায় এককেজির দুইটা দিতে বলি। দুইটার দাম তিনহাজার টাকা। বেঁচে থাকবে একহাজার আর। যাক কী আর করার। অদ্ভুত, এতো দাম কেন সবকিছুর বুঝে আসে না। বাজার করা আর যুদ্ধ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই আজকাল। যে যেভাবে পারে দাম বাড়াবেই সবকিছুর। দাম বাড়ানোর প্রতিযোগীতা চলছে যেন। থাক এখন আপাতত নিজের টাকা না ধার করা টাকা বলেই হয়তো তেমন খারাপ লাগছে না। পরে যে এই টাকা শোধ করার সময় ভীষণ খারাপ লাগবে এই কথাও মাথা থেকে বের করা যায় না। ইলিশ মাছ কেনার পর আর কিছু কিনতে ইচ্ছে হয় না। বাকী সব বোধহয় বাসায় আছে। বাজারে নানা ধরনের মানুষ আছে। চোর- বাটপার থেকে শুরু করে ঝানু মধ্যবিত্ত সবাইকেই পাওয়া যাবে। দু তিনটা বড়লোক পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। সুপার শপের জিনিস খেতে খেতে গাল পঁচে গেছে এমন লোক আবার খরচ বেশী হয়ে যাচ্ছে বলে এসব বাজারে বাজার করতে এসেছে এমন বড়লোক কয়েকটাকেও পাওয়া যাবে খুজলে। নাহ অতো খুঁজে কাজ নাই। ইলিশ মাছ নিয়ে হেটে হেটে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। রিকশা একটা নিয়ে ফেলি৷ আয়েশ যেহেতু করছি একটু ভালো ভাবেই করি। আজ বোধহয় অনেকদিন পর রিকশায় উঠছি তা না হলে বাস আর টেম্পোই একমাত্র ভরসা আমার।
বাসায় আজ একটা উৎসবের আমেজ আছে। ছোট বোন রিমিকে দেখে মনে হচ্ছে স্কুলের পরীক্ষার কথা সে ভুলে গেছে আজ। মাকে দেখে বোঝা যায় না যদিও তার ভেতরে কি চলছে। তবে আপাতত দেখে মনে হচ্ছে তার মন মেজাজ যথেষ্ট ভালো। বাবার সাথে তেমন কথা হয় না। কথা খুঁজে পাই না তার সামনে গেলে। আর তিনি কথা শুরু করলেও যথেষ্ট বিরক্তি লাগে আমার। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়েই তিনি শুধু কথা বলেন। বাড়িতে কিছু জায়গা জমি আছে আবার শহরের একদম শেষ ভাগে কিছু জায়গা জমি আছে এসবকিছু বেঁচে একটা দোকান দেয়ার জন্য তার আগ্রহ অনেক বেশী। অথচ ধার শোধ করার কথা তার মনে থাকে না। মামারা দশ লাখ টাকার মতো পান এখনো। মাকে প্রায় কথা শোনায় মামি আকারে ইঙ্গিতে। এসব দিকে তার খেয়াল নাই। দোকানে আবার তিনি নিজের ভাইয়ের ছেলেকেও বসাতে চান। অদ্ভুত মানুষ এক। নিজেদের ঠিকমতো চলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে এর মধ্যে তিনি এসব নেকামি দেখান! এরপর আছে বিভিন্ন সময় জেগে উঠা তার নানান কিসিমের শখের টেনশন।
বাসায় একটা কাজের লোক থাকলে ভালো হতো বোধহয়। মায়ের এখন সাহায্য দরকার। রিমিরও পড়াশোনার ক্ষতি হয় মাকে সাহায্য করার কারণে।কিন্তু, কিছু করার নাই। কাজের লোকের পেছনে টাকা খরচ করার মতো অবস্থা আমাদের নাই। তো কী আর করার, বেশ কিছুদিন যেভাবে চলছে এভাবেই চলতে থাকবে সব। ভাবছি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে ভালো হতো। যদিও পড়া অবস্থায় তেমন ভালো মাইনে পাবার কোন আশা নাই। তাহলে বোধহয় এক্সট্রা টিউশনি করতে হবে। আর কোচিং এ ক্লাস নেওয়া উচিত আমার। কিন্তু টাকা আদায় করে নিতে হয় অধিকাংশ জায়গায়। এ আরেক ঝামেলার কাজ। মানুষজন জঘন্য কীটে পরিণত হয়েছে বলতেই হয়। আর নিজের পড়াশোনার ও বারোটা বাজবে এভাবে অন্যদের পড়াশোনা করাতে গেলে।
মাছ রান্না শেষ। বাবা ডায়েবিটিস পেশেন্ট। তার জন্য কিছু সবজিও রান্না করা হয়েছে বোধহয়। দেখলাম বাবা হাসিমুখে বের হয়েছে রান্নাঘর থেকে একটু আগে। মাঝে মাঝে রান্নার তদারকি করতে বাবা ভালোবাসেন। মা বিরক্ত হয় সবসময় তার এই কাজে। তবুও তিনি কাজটা করেন। তবে আজ বোধহয় আর মা রাগারাগি করবেন না। তার মুখেও হাসি লেগে থাকবে।
মাকে দেখতে পাচ্ছি। এখন তিনি সবার প্লেট রেডি করছেন। আজ বেশ তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলছি আমরা। এই ফ্যানটা ছাড় তো, মা রিমিকে বলেন হাসিমুখেই। বাবাও এসে পড়েছেন খাবার টেবিলে। সবার এই হাসিখুশী অবস্থা দেখে ভালো লাগছে। তারা কিছুটা নিজেদের আড়ালে নিতে পারছে নিজেদের আসল অবস্থা থেকে।
আমিও হাটা শুরু করি। নিজের রুম থেকে ঐ রুমের দুরত্ব অনেক বেশী মনে হয় প্রায়। কিন্তু, আজ বেশী বলে মনে হচ্ছে না। সময় আর পরিস্থিতি সব সমীকরণ বদলে দেয়। ক্লান্ত চেহারাতে একটু মেকি হাসি ঝুলিয়ে রওনা দি। মনে পড়ছে ছোটোবেলায় কোথাও যাওয়ার আগে একটা কিছু পড়তে বলতো মা। তা কি পড়ছে না এখন। বেমালুম ভুলে গেছি। এতোসব ভাবতে ভাবতে খাবার টেবিলে বসে পড়ি। মা সবাইকে খাবার বেরে দিচ্ছেন। তার মানে তার মন আজ অত্যাধিক ভালো। এই ভেবে আমার মন ও ভালো হয়ে উঠে। সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দেখি হাসি মুখে। সেই আদি লেবাস যা আমার বাবা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমি পেয়েছি তা কিছুক্ষণের জন্য খুলে রাখি একটু সময়টা উপভোগ করার জন্য।