পোস্টস

গল্প

তোমার জন্যে প্রিয়তমা (রোমান্টিক প্রেমের গল্প)

২৪ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

*তোমার জন্যে প্রিয়তমা (রোমান্টিকপ্রেমের গল্প)*

      ▪ পার্থসারথি

         *

হুইসেল দিয়েই ট্রেনটা চলতেশুরু করলো। হালকা ঝাঁকুনিতারপর সর্পিল গতিতে এগিয়েচললো। অরণ্য জানালার পাশেইবসা। প্লাটফর্মের ব্যস্ততায় চোখ আপনমনে ঘুরছে।মনের ভেতর তেমন কোনচিন্তার বসবাস আপাতত নেই।শুধু শুধু আনমনে চেয়েদেখা। ট্রেনের গতির সাথে সাথেঅরণ্যর চোখজোড়াও যেন ক্রমশঃ ব্যস্তহচ্ছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেএমন মুহূর্তেই চোখজোড়া আচমকা নির্বাক ওস্থির হয়ে গেল। মাধবীলতা! ভালো করে উঁকি দিয়েতাকিয়ে দেখল অরণ্য- মাধবীলতাব্যস্ত চোখে এদিক-ওদিকতাকাচ্ছে এবং খুব দ্রুতহাঁটছে ট্রেনের দিকে। আর অরণ্যআপ্রাণ চেষ্ঠা করছে দৃষ্টিতেমাধবীলতার দৃষ্টিকে আটকাতে। না, হলো না! হঠাৎ দৃষ্টি সীমানা থেকেহারিয়ে গেল মাধবীলতা। ট্রেনেরগতি বেড়েই চলল। সাথেসাথে অরণ্যর বুকের ভেতরবেড়েই চলছে কষ্টের হাতুড়িপেটানো শব্দ। ধুক, ধুক! ধুক, ধুক! ধুক, ধুক!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই অরণ্য দু'হাতে চোখ ঢাকল।প্রিয়তমা, মাধবীলতা কেমন আছো তুমি? তোমার সেই চোখ, বাতাসকাঁপানো চুল, জোছনা ছড়ানোহাসির ফোয়ারা আমাকে আজো টানে।তোমার?

মুহূর্তেই মনটা ভীষণ এলোমেলোহয়ে ওঠে অরণ্যর ভেতরজগৎ। দম বন্ধ করাগুমোট হাওয়ার দাপাদাপি অসম্ভব রকমের ক্লান্তকরে দিচ্ছে...

কলেজের প্রথম দিনের প্রথমসাক্ষাতেই অরণ্য মাধবীলতার মনভুবনেহারিয়ে যায়। আহা! চোখজোড়ার গভীরতা থেকে বেরহওয়া কী এতই সহজ! আজো চলছে একই ডুব।যুগ থেকে যুগ। ভালোবাসায়ডুবে যাওয়া অরণ্যর প্রতিটিমুহূর্ত টের পায় মাধবীলতা।আর অরণ্য দিনকে দিনপ্রেমপাখির মতো বিশাল খোলাআকাশে একলা উড়ে। ক্ষণেক্ষণে ভাবনার জালে আবদ্ধহয়ে মাধবীলতার হাতটি ধরে। স্বর্গীয়স্পর্শে মনবাগানে চলে নিত্য আনাগোনা।চোখে চোখ, হাতে হাতকেটে যায় প্রতিটি প্রভাত।অরণ্যর প্রেম বাগানে ভালোবাসারফুলের সৌরভ ছড়াতে ছড়াতেআধিপত্য বিস্তার করে। ইচ্ছের ভেতরইচ্ছেডানা উড়ে বেড়ায় মাধবীলতারনিঃশ্বাসে। মাধবীলতার সাক্ষাৎ প্রত্যাশী  অরণ্য অধীর আগ্রহেঅপেক্ষায় থাকে প্রতিটি মুহূর্ত।মনে মনে চলে কথারফুলঝুরি। কিন্তু মাধবীলতা কাছেএলেই এক ঝলকে অরণ্যরসকল সাজানো কথা এলোমেলোহয়ে ঝিরঝির করতে থাকে।এক চাহনিতেই বুকের ভেতর চলেচোরাস্রোতের তাণ্ডব।

মাঠের কোণে সবুজ ঘাসেরবুকে মন পেতে বসলঅরণ্য। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়আছে কেউ হয়তো আসতেপারে এমনই প্রত্যাশায়। এসেপাশে বসবে। মনের ওপরমন বসিয়ে দুটো কথাবলবে। নানান চিন্তায় ভরকরে চোখ মেলে ধরেনীল আকাশের বুকে। আহা! কী অপূর্ব এই আকাশেরখোলা বুক। আজকাল সবকিছুতেইভীষণ ভালোলাগা শুরু হয়েছে অরণ্যর; সকালের পাখিডাকা কোলাহল, দুপুরের ঘুঘু ডাকা শান্ত-স্নিগ্ধ দুপুর, সূর্যের ডুবদেয়া পড়ন্ত বিকেল, মনমাতানো আলো ছড়ানো জোছনারাত, ফুলের সৌরভে সৌরভেউড়ে বেড়ানো মৌমাছি-মুহূর্ত আরোকত কী! সবকিছুতেই ভালোলাগার ছড়াছড়ি।

কী ব্যাপার অরণ্য একা একাবসে আছো যে?

মাধবীলতাকে দেখতে পেয়ে অরণ্যহতবিহ্বল সময়ে ডুবে যায়।কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়েবলে- এমনি বসে আছি।তুমি এখানে?

তোমাকে দেখে এলাম।– বলতেবলতে মাধবীলতা অরণ্যর মুখোমুখি হয়েঘাস লেপটে বসে।

খুশীতে আত্মহারা অরণ্য নিজেকে সামলাতেব্যস্ত। মনের ভেতর আলোড়নযেন চোখেমুখে ঢেউ খেলে গেল।মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদজানিয়ে অব্যক্ত উচ্চারণ করে- হে ঈশ্বর! তুমি আমার মনের রাণীকেআমার কাছে এনে দিয়েছো।তোমাকে হাজার ফুলের সমারোহেধন্যবাদ। আমার এই মুহূর্তটুকুজীবনের পাতায় গেঁথে দিও।যেন মাধবীলতাকে বুকের ভেতর লুকিয়েরাখতে পারি সারাজীবন। একদমনিজের করে। কিন্তু উত্তরেবলে- সত্যি বলছো?

একরাশ হাসি ছড়িয়ে মাধবীলতাবলে- হ্যাঁ, প্রকৃতির মাঝেতুমি একা বসে আছো।তাই ভাবলাম আনন্দে ভাগবসাই। আজকের আকাশটা খুবসুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না অরণ্য?- বলে মন-পাগল করাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাধবীলতা।

অরণ্য এতক্ষণ এই সুন্দরআকাশেই মন-পবনের নৌকায়ভেসে বেড়াচ্ছিল। মাধবীলতার উচ্চারণে যেন স্বর্গ হয়েওঠল। চোখে চোখ রেখেঅরণ্য বলল- তুমি আমারমনের কথাটিই বলেছো মাধবীলতা।এতক্ষণ তাকিয়ে তাই দেখছিলাম। আরমনে মনে উচ্চারণ করে- পাশে তুমিও ছিলে।

কী বললে অরণ্য?

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অরণ্যলাজুক হাসি হেসে বলে- বলছিলাম, তোমার মনের চিন্তারসাথে আমার মনের চিন্তাহুবহু মিল। এতক্ষণ আমিএই সুন্দর আকাশেই ভেসেবেড়াচ্ছিলাম।

তুমিতো খুব সুন্দর কথাবলো অরণ্য!- দীঘল-ঘন কালোচুলে আঙুল চালিয়ে মাধবীলতাবলে- তুমি একেবারে কবিরমতো কথা বলো।

অরণ্য নিজেকে একটু গুটিয়েনিয়ে বলে- যার মনসুন্দর তার কাছে পৃথিবীরসবকিছুই সুন্দর।

মাধবীলতা মুগ্ধনয়নে অরণ্যে দেখে। চোখেচোখ রাখতেই অরণ্য চুপসেযায়। কথার বর্ণমালা মনেরভেতর লুটোপুটি খাচ্ছে। হাজারো শব্দের উঁকিবুকি, কিন্তু কোন কথাই আরবেরুচ্ছে না। অরণ্য মনেরআকাশে মাধবীলতাকে কবিতার অক্ষরে অক্ষরেপ্রাণ প্রতিস্থাপন করে মোহময় করেতোলে...

     আমিতোমাকে কতটুকু ভালোবাসি

     পূর্ণিমারচাঁদ তা জানে,

     প্রতিদিনকারদীর্ঘশ্বাস চাঁদের বুকে গেঁথেছি

     ভালোবাসারপূণ্যস্নানে।

     তুমিযদি প্রতিশ্রুতি দাও;

     ভালোবাসবে,

     জীবনেরপুরোটাই দেবো এবং

     এইআমাকে।

কবিতাটুকু মনে মনে উচ্চারণকরে অরণ্য বলে- আচ্ছামাধবীলতা, তোমাকে একটা প্রশ্নকরবো। সত্যি উত্তর দেবেতো?- বলেই মনের ভেতরসাহস সঞ্চয় করে মাধবীলতারচোখে চোখ রাখে।

এই মুহূর্তে অরণ্য বুঝতে পারেযে, মাধবীলতা ওর মনের বারান্দায়হাঁটছে। এই তো বুকেরপাঁজরে নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনিরা চুপি চুপি বলছে; মাধবীলতা ডুবলো যে আজভালোবাসার এই অরণ্যে।

মাধবীলতা কোকিল কন্ঠে বসন্তেরবাগানে ডেকে বলল- সত্যিবললে তুমি খুশি হবে?

আকাশের দিকে তাকিয়ে দু'হাত প্রসারিত করেঅরণ্য বলে- এই আকাশকেসাক্ষী রেখে বলছি, তুমিসত্যি বললে আমি খুশীহবো!

আমিও আকাশকে সাক্ষী রেখেবলছি- সত্যি বলবো অরণ্য।কথা দিলাম। 

তুমি কবিতা ভালোবাসো?- বলেইঅরণ্য উত্তরের প্রত্যাশায় উদগ্রীব হয়ে থাকে।

প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথেমাধবীলতার চোখ-মুখ খুশীতেউজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবংবলে- খুব ভালোবাসি। বলতেপারো, মনেপ্রাণে ভালোবাসি।

অরণ্যর সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ- আমিও। কবিতায় ডুবেথাকতে প্রচণ্ড ভালোবাসি।

মুহূর্তেই দু'জনার নিঃশ্বাসেনিঃশ্বাসে মুহূর্তগুলো প্রণবন্ত হয়ে ওঠল। এইপ্রাণ কবিতা হয়ে ছড়িয়েপড়লো আকাশে-বাতাসে। তারপরধীরে ধীরে অনুরণনে গড়েওঠল ভালোবাসার প্রাসাদ। কিন্তু এই ভালোবাসারপ্রাসাদ এখনো শূন্য পড়েআছে।

        *

প্রতিদিন মনের ডালিতে কথারমালা সাজিয়ে নিয়ে আসে অরণ্য; মাধবীলতাকে বলবে বলে। মাধবীলতারমুখোমুখি হলেই সব কথাজলীয়বাষ্পের মতো উবে যায়।কথায় কথায় বেলা গড়ায়, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে দীর্ঘায়িত হয় অপেক্ষার প্রহর।দেখতে দেখতে প্রায় দুটোবৎসর পেরিয়ে গেল। এখনো প্রিয়তমামাধবীলতাকে বলা হলো নামনের কথাটি। 

অরণ্যর ভালোবাসার আঙিনায় পদচারণায় মুগ্ধ মাধবীলতা। প্রতিদিননিজেকে নতুন করে প্রস্তুতরাখে প্রিয়তমর কন্ঠ থেকে মধুরকথাটি শুনবে বলে। চোখেচোখে চলে প্রতিনিয়ত ভালোলাগায়আলোড়িত হওয়া। কথায় কথায়চলে সময়ের ভালোলাগার সিঁড়িতেপদার্পণ। কিন্তু আজও প্রস্ফুটিতহয়নি ভালোবাসার বাগানের গোলাপগুচ্ছ।

ফাইনাল পরীক্ষা সন্নিকটে তবুও হয়নি বলামনের কথাটি। অরণ্য আহতপাখির মতো ছটফট করে।বুঝতে বাকী নেই,সেযেমন ভালোবাসার ডিঙিতে চড়ে বসেছেমাধবীলতাও বসে আছে ওরপথ চেয়ে। শুধু হাতবাড়িয়ে হাতে হাত রাখলেইদু'জন দু'জনার।চকিতে কলমের আশ্রয়ে অরণ্যনিজেকে আর নিজের ভালোবাসারআঙিনাকে সাজিয়ে তুলল-

প্রিয়তমা মাধবীলতা,

ভালোবাসার গোলাপের রঙ ছুঁয়ে মনেরভেতর সাজিয়েছি এক স্বপ্নময় ভুবন।প্রতিক্ষণ প্রতিদিন আহত হই তোমারনিঃশ্বাসের ছায়ায় অব্যক্ত থেকে। চোখে চোখেকথা হয় প্রতিমুহূর্তে। আকাশেরবুকে মেঘের ভেলায় চড়েবসি তোমার ভাবনায় মশগুলহয়ে। প্রতিক্ষণ ভাবি শুধু তোমারকথা; দোয়েলের শিস হয়ে বলবোমনের কথা। কিন্তু তোমারআঙিনায় এলেই আমার সবকিছুএলোমেলো হয়ে যায়। কোনকিছুইবলা হয়ে ওঠে নাআর!

কলমের চিবুক বেয়ে নেমেএসেছি তোমার ভালোবাসার উদ্যানে।প্রিয়তমা, লিখে দিলাম আমারমিনতি- 

     নিজেকেসপে দিলাম সখি;

     ধ্বংসকরো অথবা

     রোপনকরো;

     এইআমার শেষ মিনতি!

ইতি- তোমার অরণ্য।

         *

দ্বিধাদ্বন্ধে অরণ্য এখন ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিক। যেন দীর্ঘপথপরিক্রমা শেষে বিশ্রামরত। কিন্তুমনের ভেতর শংকা ক্রমশঃকাবু করে দিচ্ছে। কৃষ্ণচূড়াদোলে দোলে জানান দিচ্ছেআনন্দময় মুহূর্তের ছবি। কোনমতেই নিজেকেপ্রবোধ মানাতে পারছে না।কোন কথা না বলে, চোখে চোখ না রেখেশুধু কলমের ভাষায় ছড়ানোআবেগটুকু মাধবীলতার হাতে দিয়েই চলেআসা। একবারও চেয়ে দেখেনিমাধবীলতার চোখের উচ্ছ্বাস, মনেররঙ, ঠোঁটের হাসি। এখনছটফট করছে আহত পাখিরমতো।

অরণ্য তুমি অমন অস্থিরহয়ে আছো কেন?- মাধবীলতাহেসে বলে।

কেন অস্থির, কেন ভাসছি, কেনএমন কিছুই বলতে পারছিনা। শুধু এইটুকুই বুঝি, তোমার কাছে এলেই আমিদিশেহারা মাধবীলতা।– অরণ্য বেশ আবেগতাড়িতহয়ে বলে।

চলো অরণ্য, আমরা ওইমাঠের কোণে সবুজ ঘাসেগিয়ে বসি। দেখবে, ওইআকাশের বুকে মন ভাসিয়েদিলে সব শান্ত হয়েআসবে।

গভীর ভাবনায় মগ্ন থেকে থেকেঅরণ্য এই সাত-সকালেচুপি চুপি চলে আসেকলেজ মাঠের কোণে। অবাকহয়ে তাকিয়ে দেখে, মাধবীলতা হাঁটুতেমুখ গুঁজে ঘাসের বুকেচিমটি কাটছে আপনমনে।

কাছে এসেই অরণ্য উপস্থিতিজানান দেয়। চোখে চোখপড়তেই অরণ্য নিজেকে সামলাতেপারেনি। হাঁটু গেঁড়ে মাধবীলতারসামনে বসে। সাহসের বুকেহাত রেখে মাধবীলতার একটিহাত নিজের হাতে তুলেনেয় অরণ্য। তারপর কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে- মাধবীলতা, আমি কি তোমাকে কষ্টদিয়েছি?

পরস্পরের দিকে অপলক তাকিয়েথাকে দু'জন। কোনভাষা নেই, কোন উচ্চারণনেই, কোন মুহূর্ত নেই; ওরা যেন মহাকালের যুগলযাত্রী।

নীরবতা ভেঙে মাধবীলতা বলে- তুমি আমাকে এত কষ্টদিতে পারলে!

অরণ্য আকাশ থেকে ছিটকেযেন মহাসাগরে পতিত হলো। অবাকনয়নে তাকিয়ে আছে ভাষাহীন। কষ্টেরাবুকের ভেতর কুঁরে কুঁরেখাচ্ছে- আমি কি তাহলে  মাধবীলতাকে কষ্ট দিলাম?

হাতে হাত আঁকড়ে ধরেমাধবীলতা আবারো বলে- তোমারএই একটি মাত্র উচ্চারণেরজন্য আমি চাতকিনীর মতোতাকিয়েছিলাম। এতদিন পর তুমিবললে! আমি কষ্টের সিঁড়িতেঅপেক্ষায় থেকে থেকে ভীষণক্লান্ত অরণ্য। তোমার এইচিঠি আমার আরাধ্য ধন।তুমি আমার প্রাণ নতুনভাবেপ্রতিষ্ঠা করলে। আমি তোমারপ্রাণে গান সঞ্চার করেবেঁচে থাকতে চাই। 

সত্যি বলছো মাধবীলতা!- অরণ্যরঘোর কাটেনি এখনও।

হ্যাঁ অরণ্য। তুমি আমারপ্রাণ, তুমি আমার গান, তুমি আমার কবিতা, তুমিইআমার প্রেম-ভালোবাসা- সব, সব, সব!

হাতে হাত রেখে দু'জন নির্বাক। ভালোবাসারশান্ত কপোত-কপোতী। দু'জনের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসেআকাশের রঙ মেঘের আনন্দেমিশে ভাসতে থাকে।

         *

পরীক্ষা শেষে অরণ্য বাড়িতেচলে আসে। মায়ের দিকেতাকালেই মনটা বিষন্ন হয়।পৃথিবীর সবকিছু মলিন হয়েযায়। যার গর্ভে দশমাস দশ দিন থেকেপৃথিবীর আলোয় বেঁচে থাকা।যার প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে এই দেহেরউদ্ভব সেই মা এখনপ্রকৃতির স্বাভাবিকতা থেকে ছিটকে আছে।শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখেতাকিয়ে থাকে। সহোদর তারুণ্যহঠাৎ করেই পৃথিবীর মায়াত্যাগ করে মাকে কষ্টেরসাগরে ভাসিয়ে রেখে চলে গেল।

প্রথম সন্তানের প্রতি মায়েদের থাকেএক অগাধ টান। এইটানেই পুত্রশোকে মা আজ কিছুটাঅপ্রকৃতিস্থ। অরণ্য এখন একমুহূর্তের জন্যও মায়ের চোখেরআড়াল হতে পারে না।পুত্রহারা মা এখন অন্যপুত্রকে বুকের ভেতর সবসময়আগলে রেখে কিছুটা অবলম্বনখোঁজে। অরণ্যও মায়ের ছায়ায়ছায়ায় থেকে একটু সান্ত্বনাদেবার চেষ্ঠা করে। সামান্যতমকষ্টও যেন আর ভরনা করে সেই চেষ্ঠায়নিজেকে সমর্পন করে অরণ্য।

মাধবীলতার চিঠিটা এখনও হাতেলুটোপুটি খাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে চিঠিতেদৃষ্টি বুলাচ্ছে অরণ্য। আর কষ্টেরনীল সাগর যেন দীর্ঘথেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চিঠির ওপরদৃষ্টি রেখে  অপলক তাকিয়ে থাকেঅরণ্য-

প্রিয়তম অরণ্য,

একরাশ ভালোবাসা তোমার জন্য। আশাকরি বাড়ির সকলকে নিয়েকুশলেই আছো। কামনাও তাই।তোমার ভালো থাকাই আমারভালো থাকা। তোমাকে ছাড়াআমার অস্তিত্ব কল্পনাহীন জগৎ। কিন্তু একটিবাঁধা আমাকে কুঁরে কুঁরেখাচ্ছে। জানি না প্রিয়, তুমি ব্যাপারটা কীভাবে দেখ; ধর্মেরবাঁধাটাকে আমি মূখ্য কিংবাগৌণ কোনটাই নির্ধারণ করতেপারছি না। কিন্তু কিছুটাটের পাচ্ছি যেহেতু আমরাসামাজিকভাবে বসবাস করি। মা-বাবার দুঃখ কষ্টেরকথাটাও আমাদের ভাবতে হবে।কিন্তু আমি তোমার ভালোবাসায়বাঁচতে চাই।

যদি সম্ভব হয় তবেচিঠি পাবার পর যথাশীঘ্রচলে এসো। সাক্ষাতে বিস্তারিতকথা হবে।

ইতি-

তোমার কাছে সমর্পিতা মাধবীলতা।

চিঠি পড়েই দ্বন্ধের দোলাচলেভাসতে ভাসতে অরণ্য এখনভীষণ একাকি। একদিকে প্রাণপ্রিয়পুত্রহারা  অসুস্থ মা আরঅন্যদিকে ভালোবাসার জন মাধবীলতা। অস্থিরসময়ের সাথে পাল্লা দিতেদিতে অরণ্য এখন ভীষণক্লান্ত। সমস্যায় পরিসমাপ্তির রেখা টানতে বারবারব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিটি সূর্যোদয়েহাঁটি হাঁটি পা পাকরে কষ্টেরা হানা দেয়। তারপরদিনভর কষ্টের অনুভব তীব্রথেকে তীব্রতর হয়। গোধূলী বেলায়শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে ঢলে পড়ে।কিন্তু কষ্টেরা ফিরে আসে বারবারপ্রতিটি সূর্যোদয়ে।

কষ্টের ভেতর কষ্ট চাপাদিয়ে অরণ্য চাঁদের আলোয়চাঁদের ভেতর শূন্যে ভাসে।ভাসতে ভাসতে নিজের ভেতরহারিয়ে যায়। ভালোবাসার সাজানোবাগানে চুপি দিতে সাহসপায়নি অরণ্য। আর এগিয়েযায়নি মাধবীলতাকে কষ্টের ভেতর টেনেআনতে। এভাবেই কষ্টের নীলপাথরহয়ে কেটে গেল একাকিএক যুগ।

মাধবীলতা প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতেযীশুর চরণে নিজেকে সপেদেয়। সময়ের স্রোতে ভেসেচলা অপেক্ষমান গন্তব্যহীন এক যাত্রী। সবকিছুভুলে ডুবে থাকে কর্মব্যস্ততায়।সবকিছু ভুলে যেতে চায়কিন্তু ভুলে থাকা কিযায়! তবুও কষ্টের ভেতরসুখী মানুষের অভিনয় করে বেঁচেথাকা।  

        *

হাত থেকে ব্যাগটা রেখেমাধবীলতা তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে।সীটটা দখল করে বসেদিব্যি আরামে ভাবের সাগরেভাসছে। তাই বলে অন্যেরসীটে বসতে হবে। অনেককষ্ট করে এই সীটটাম্যানেজ করা হয়েছে। কাউকেবিরক্ত করতে সত্যি খারাপলাগে। তবুও নিজেকে ডিঙিয়েমাধবীলতা বলে- এক্সকিউজ মী!

লোকটার মাঝে কোন ভাবান্তরনেই। দু'হাতে চোখ-মুখ ঢেকে চুপচাপবসে আছে। 

মাধবীলতা আবারও বলে- এক্সকিউজমী, সীটটা আমার!

চোখ-মুখ থেকে দুঃখভরাহাত সরিয়ে অরণ্য তাকায়- ইয়েস প্লীজ।– বলে তাকিয়েই অরণ্যভাষাহীন। অপলক তাকিয়ে থাকে।

মাধবীলতা আর অরণ্য নির্বাকসময়ে স্থির হয়ে গেল।

           শেষ

 

রচনাকাল: ১০.১০.২০২০

 

*এমন আরও গল্প পড়তে PLEASE CLICK: বইটই-এ প্রকাশিত অসাধারণ রোমান্টিক প্রেমের গল্পগ্রন্থ 'যে কথা হয়নি বলা তোমাকে ছুঁয়ে’ এর লিংক