পোস্টস

গল্প

বাক্স বন্দী ভালোবাসা

২৪ জুন ২০২৪

সাফি আল মেহেদী

নওরিন কিছুটা অবাক হল। সে ভেবেছিল দরজা খুলে দেখবে সায়েম দাঁড়িয়ে। কিন্তু দরজার সামনে দেখল বিরাট বড় একটা বাক্স নিয়ে একজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি বলল ম্যাডাম আমি রেডেক্স কুরিয়ার থেকে এসেছি, আপনার একটা পারসেল ছিল। কাইন্ডলি এখানে একটা সিগনেচার দিন। নওরিন সিগ্নেচার দিয়ে বাক্সটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। এটা নিশ্চয়ই সায়েমের কাজ। আজ নওরিনের জন্মদিন, তাই তাকে চমকে দেয়ার জন্য এই আয়োজন। নওরিন তার ঘরে ঢুকে খুব সাবধানে বক্স টা খুলল। বক্স খুলে সে দেখল আরেকটা বক্স। সেটিও খুলল। আবার আরেকটা বক্স। এভাবে ৪ টা বক্স খুলতেই তার নাকে কেমন একটা বোটকা গন্ধ লাগল। পরের বক্স খুলেই সে যেন ভয়ে লাফ দিয়ে উঠল। বক্সের ভেতর কার যেন কাটা আঙুল এবং আরো কিছু জিনিস। সেগুলোতে এখনও রক্ত লেগে আছে। নওরিন একটা চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস হয়ে গেল। চিৎকার শুনে নওরিনের মা ছুটে এলেন। তিনি নওরিনকে পরে থাকতে দেখে, আর বক্সের ভেতর উকি দিয়ে, নওরিন এর চোখে মুখে পানির ঝাপ্টা দিলেন, নওরিন উঠেই তার মাকে জড়িয়ে ধরল। নওরিন কিছুটা সময় নিয়ে ৯৯৯ এ ফোন দিল।

পুলিশ এসে আবিষ্কার করল বক্সের ভেতর হাত ও পায়ের বিশটি আঙুল, দুটি চোখ, দুটি কান, জিহবা, পুরো হৃদপিন্ড আর নাকের কাটা অংশ। সাথে বক্সের মধ্যে লেখা একটা চিঠি। চিঠিটা পুলিশের বড় কর্মকর্তা আবির শব্দ করে পড়লেন:

 

প্রিয় নওরিন
তোমাকে জানাই সাতাশতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আশা করি তুমি ভালই আছো। আমিও বেশ ভালো আছি। তোমার প্রত্যেক জন্মদিনেই তো তোমাকে উপহার পাঠাই। এই জন্মদিনেও পাঠালাম। আর আজকের উপহার সাতাশ ভাগে ভাগ করা তোমার সবথেকে প্রিয় মানুষ। তুমি আমার হওনি তাই তুমি অন্য কারো হবে না। হাহাহা।

ইতি
তোমার সিমান্ত

 

চিঠির কথাগুলো শুনে নওরিন তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠল। তার বুঝতে বাকি রইল না যে, কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো সায়েমের। আবির বক্স সহ সবকিছু ফরেনসিকের জন্য পাঠিয়ে দিল। আর নওরিনকে কিছু প্রশ্ন করল। সিমান্ত কে সে চেনে কি না? নওরিন পুলিশকে সব খুলে বলল যে, সিমান্ত তার এক্স বয়ফ্রেন্ড। আজ থেকে সাত বছর আগেই তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তবুও সিমান্ত তাকে মাঝে মাঝেই কল মেসেজ দেয়। আবার জন্মদিনে গিফট পাঠায়। আর সে সন্দেহ করছে যে এই কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো সায়েম এর। সায়েম নওরিনের বয়ফ্রেন্ড, যার সাথে প্রায় তিন বছর হল তার সম্পর্ক। এর মধ্যে সে সায়েমকে অনেকবার কল করেছে কিন্তু সায়েম কল ধরে নি। সায়েমের ফোন সুইচড অফ। তার মানে হয়ত সিমান্ত সায়েমকে খুন করেছে। বলে নওরিন আবারও কেঁদে উঠল। আবির বলল, প্লিজ নিজেকে সামলে নিন। আমাদের কিছুটা সময় দিন আমরা বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বে সাথে দেখব।

 

সায়েমকে তার অফিসে কিংবা বাসায় কোথাও পাওয়া যায় নি। তার ফোন টাও আউট অফ রিচ। এদিকে সিমান্ত এর ফোনও বন্ধ, বাসায় গিয়েও দেখা গেল, বাসায় বড় একটা তালা ঝুলছে, যা অবশ্যই খুব স্বাভাবিক। এদিকে কুরিয়ারে খোজ নিয়ে জানা গেল, বক্সটি তারা সিমান্ত এর বাসা থেকে পিক করেছিল। সিমান্ত এর নাম্বার থেকে কল করে বলা হয়েছিল নিচে বক্স রাখা আছে আমরা যেন নিয়ে যাই, এবং মিস নওরিনের বাসায় পৌছে দেই। যেহেতু আমাদের ওয়েবসাইটে মিস্টার সিমান্তের একাউন্ট করা আছে এবং তিনি প্রায়ই জিনিসপত্র দেয়া নেয়া করেন, তাই সন্দেহ করার অবকাশ হয়নি। অনেক খোজাখুজি করেও সিমান্ত কিংবা সায়েম কাউকে পাওয়া যায় নি। ফরেনসিকের তথ্য গুলো ক্রসচেক করে জানা গেছে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সায়েম এর ই। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়াতে নওরিন অনেক ভেঙে পড়েছে।

 

বেশ কিছুদিন পর সায়েমের ফোনের লোকেশন ট্র‍্যাক করা গেছে। শহরের দক্ষিণ কোনে এক পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তন্য তন্য করে খুঁজে সেপ্টিক ট্যাংক এর ভেতর একটা অর্ধ গলিত কাটাকুটি করা পরিত্যাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। লাশের বুকপকেটে ছিল ফোনটি। আবির লাশটি ফরেনসিকের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। লাশটা যে সায়েমের তা তো বোঝায় যাচ্ছে। তবুও ফরেনসিক করে যদি কিছু পাওয়া যায়।

 

আবির ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে নিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়েছে। লাশটি ক্রস চেক করে জানা গেছে লাশটি সায়েমের না বরং সিমান্তের। সিমান্তের ফোন ট্র‍্যাক করে সেই জমিদার বাড়ির পাশেই মাটির নিচে পাওয়া গেছে আরেকটি লাশ। যেটির মালিক সায়েম। এত গোলমেলে কেস আবির তার আট বছরের ক্যারিয়ারে কখনও দেখেনি। শুরুতে যা এত সহজ মনে হচ্ছিল, পরে এসে যে তা এত গোলমেলে হয়ে যাবে তা সে ভাবতেও পারেনি। এরপরে আর এই কেইস নিয়ে বেশি দূর এগোতেও পারেনি সে। ক্লোজ করে দিতে হয়েছে।

নওরিন ও বিষয়টার কোন সমাধান করতে পারে নি। এই ট্রমা থেকে বের হতে তার প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। এরপর সে তার বাবার বন্ধুর ছেলে জারিফকে বিয়ে করেছিল। আজ ২৪শে জুন। নওরিনের ৬৪তম জন্মদিন। তার বর জারিফ গত বছর মারা গেছেন। তাদের দুই ছেলে মেয়েরাও বিয়ে করে একজন অস্ট্রেলিয়া আরেকজন ফিনল্যন্ডে সেটেল্ড। নওরিন তাদের পুরনো বাক্সটা বের করেছে। জারিফ বলেছিল আমার মৃত্যুর পর তোমার জন্মদিনে তুমি আমাদের পুরনো বাক্সটা বের করবে, সেখানে তোমার জন্য আমার একটা উপহার তোলা রইল।  কথা মত,  বাক্স থেকে একটা চিঠি বের করেছে। চিঠিটা এরকম,

 

প্রিয় নওরিন,
তুমি যখন এই চিঠিটি পড়ছ তখন আমি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছি। আমার একটা কনফেশন ছিল। তুমি হয়ত জানো না যে, স্কুল লাইফ থেকে আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসতাম। এত বেশি ভালোবাসতাম তবুও কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি, বোঝাতেও পারিনি। তোমার বাবা আমার বাবা বন্ধু হওয়াই প্রায়ই তোমাদের বাসায় যেতাম, তুমিও আমাদের বাসায় আসতে। আমি মুগ্ধ হয়ে তোমায় দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। কিন্তু ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারিনি। এরপরেই হুট করে তোমার জীবনে সিমান্ত এর এন্ট্রি। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেইনি। দূর থেকে তবুও তোমাকে ভালোবাসতাম। অনেকদিন পর জানলাম সিমান্ত তোমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে, অনেক খুশি হলাম। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হল না, আমারই ক্লাসমেট সায়েমের মুখে যখন তোমাদের ভালোবাসার কথা শুনলাম। এরপর রাগে ক্রোধে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। সায়েমকে সিমান্ত আর তোমার ব্যাপারে বলে ওকে রাগিয়ে তুললাম। আবার সিমান্ত এর সাথেও যোগাযোগ করে উল্টাপাল্টা বুঝালাম। তারা দুজন দুজনকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করল। ভাঙা জমিদার বাড়িতে একদিন দুজন একসাথে হয়ে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলল, আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী। তারপরের কাহিনী তুমি জানো। এই সুযোগে তোমার পাশে দাঁড়ালাম। যেহেতু পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিলই তাই, তোমায় বিয়ে করতে কোন বাধাই এল না। আমি যা করেছি, কেবল তোমাকে পাওয়ার জন্য, তোমাকে ভালোবাসি তাই। হ্যা হয়ত অন্য পথেও করা যেত কিন্তু তখন এতটাই আবেগে অন্ধ ছিলাম যে আর কোন পথ চোখে পড়েনি। তবুও আমি তো তোমাকে ভালোই বেসেছি। আর জানোই তো "এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার"। আর প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।

ইতি,
তোমার অধম স্বামী
জারিফ

 

 

চিঠিটা পড়ে নওরিন এর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বাইরেও বৃষ্টি হচ্ছে, আষাঢ় মাসের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বৃষ্টি।