পোস্টস

প্রবন্ধ

উৎপাদনশীল হতে...

২৫ জুন ২০২৪

ড. মো. আব্দুল হামিদ

মূল লেখক ড. মো. আব্দুল হামিদ

এক সুউচ্চ আবাসিক ভবনের লিফটে খুব ভিড় হচ্ছিল। কর্তৃপক্ষ খেয়াল করল, সেখানে বসবাসকারী সবাই লিফটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি দোতলা বা তিনতলার লোকেরাও সেটা সবসময় ব্যবহার করছে। তাই সবাইকে সিঁড়ি ব্যবহারে উৎসাহ দিতে সচেতনতামূলক পোস্টার সাঁটানো হলো। সিঁড়ি ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। লিফট ব্যবহারে বিদ্যুৎ অপচয় হয়। কাজের ফাঁকে সিঁড়ি ব্যবহার শরীরচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে...এমন সুন্দর সুন্দর কথা লেখা হলো। তাতে কি লিফট ব্যবহারের প্রবণতা কমেছিল? 

 

না, সবাই সেটা লক্ষ করেছে, ওই বিষয়ে পরস্পর কথাও বলেছে। কিন্তু আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তখন আবাসন কর্তৃপক্ষ লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য চায়। এমন সমস্যার কথা আরো কিছু ক্রেতা বলেছিল। তাই বিষয়টা নিয়ে তারা সিরিয়াস হয়। প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করে। কিন্তু তারা এর কোনো সমাধান দিতে পারে না। কারণ সমস্যাটি পণ্যের গুণগত মান বা সেবার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। 


তখন তারা মানুষের আচরণ বিষয়ে গবেষণা করে এমন এক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য চায়, যারা ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ দেয় লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি স্লো করার জন্য। আগের বেশকিছু রিসার্চের ভিত্তিতে সেটা নির্ধারণ করা হয় ১৬ সেকেন্ড। অর্থাৎ বাটন চাপার পরেও দরজাটি বন্ধ হতে বেশ সময় লাগে। এতে বিরক্ত হয়ে যারা কাছাকাছি ফ্লোরে যেতে চায় তারা সিঁড়ি ব্যবহার শুরু করে। অনেকে দৌড়ে লিফটের আগেই গন্তব্যে পৌঁছার জন্য গর্ববোধও করতে থাকে! 

 

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কয়েক মাস পর লিফটের দরজা বন্ধের সময় আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া হলেও কিছু মানুষ সিঁড়ি ব্যবহার অব্যাহত রাখে। তারা অন্যদেরও তেমনটা করতে উৎসাহ দেয়। কাছাকাছি লেভেলে হেঁটে ওঠানামা করা লোকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে! পাঠক এবার বলুন, মানুষের কোনো অভ্যাস বদলাতে কত সময় লাগে? স্থান-কাল-পাত্রভেদে অবশ্যই এর তারতম্য হয়। তবে এ গবেষণা বলছে, মাত্র ১৬ সেকেন্ডেও মানুষের একটা অভ্যাস বদলে ফেলা সম্ভব! 

 

আমরা নিজেদের অসংখ্য অভ্যাস বদলাতে চাই। বিশেষত যেগুলো অন্যদের কাছে ‘বদভ্যাস’ বলে পরিচিত সেগুলো তো খুবই বদলাতে চাই। কারণ সেটা করা সম্ভব হলে আরো সাশ্রয়ী, উৎপাদনশীল ও গ্রহণযোগ্য মানুষ হওয়া সম্ভব। পাশাপাশি নিজের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়। কিন্তু আমরা চাইলেও অভ্যাস বদলাতে পারি না কেন? অনেকে ভাবেন আন্তরিকভাবে চাই না বলেই সেটা হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো অনেকে সত্যি সত্যি চাওয়ার পরেও সেটা হয় না। কারণ তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো কার্যকর পন্থায় ও আন্তরিকভাবে নিতে পারি না। পরিকল্পিতভাবে সেটা চেষ্টা করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব। 

 

নিজের একটা উদাহরণ দিই। স্মার্টফোন ব্যবহার শুরুর কিছুদিন পর লক্ষ করলাম এ যন্ত্রটা আমার অনেক সময় ও মনোযোগ নষ্ট করছে। তাছাড়া অপ্রয়োজনীয় সব জিনিস প্রতিনিয়ত মাথায় ঢুকছে। তখন কোন কোন খাতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয় সেটা খুঁজে বের করলাম। দেখলাম আমার সিংহভাগ সময় ফেসবুক ও ইউটিউবে যায়। দুটোর মধ্যে ফেসবুক তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজনীয় মনে হলো। তাই তখনই সেটা ফোন থেকে আনইনস্টল করলাম। সেদিন থেকে শুধু কম্পিউটারের মাধ্যমে লগইন করি। ইচ্ছে করেই পাসওয়ার্ড এত জটিল রেখেছি যে মনে রাখতে পারি না। ফলে বাসার কম্পিউটার ছাড়া অন্য কোনো কম্পিউটারে চাইলেও ঢুকতে পারি না! 

 

অন্যদিকে ইউটিউব ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি সহজ নীতি অনুসরণ শুরু করি। সেটা হলো নির্দিষ্ট বিষয়ে ভিডিও দেখার জন্য সেখানে ঢুকি। অর্থাৎ সেখানে প্রবেশের আগেই আমি জানি কোন কোন বিষয় দেখার জন্য ঢুকছি। আগের দিনে যেমন টেলিভিশনে নাটক বা সিনেমা দেখতে বসতাম। দেখা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাই। 

 

এক্ষেত্রে আমার খুব সহজ উপলব্ধি হলো খাওয়া, ঘুম, পড়ালেখা সব কাজেরই সীমা রয়েছে। তাই বিনোদনেরও সীমা থাকা উচিত। সুযোগ থাকলেই সবসময় বিনোদন নিতে থাকলে বিষয়টা একসময় ‘পানসে’ হয়ে যাবে। তখন ভালো জিনিসেও মজা পাওয়া যাবে না। যা হোক, এ পন্থা অবলম্বন করায় এখন প্রতিদিন অনেক সময় বাঁচে। নিজের কাজে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগী থাকতে পারি। 

 

আবার আপনার চারপাশে দেখবেন এমন কিছু মানুষ আছে যারা বিরতিহীনভাবে গল্প করতে পছন্দ করে। আপনার কর্মব্যস্ততা বা মানসিক অবস্থা তোয়াক্কা না করেই তারা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে নিজের ভেতরে বুদ্বুদ সৃষ্টি করা কথাগুলো দ্রুততম সময়ে আপনার মাথায় ট্রান্সফার করা। সেটা সামনাসামনি সম্ভব না হলে অন্তত ফোনে সারতে চায়। 

 

এক্ষেত্রে অতি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো চারপাশের মানুষগুলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা নিরলসভাবে তাদের নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। এমন টক্সিক ব্যক্তিরা আপনার কাজের ক্ষতি করে হলেও তাদের সব কথা বলতে চায়। অথচ সেই কথাগুলো থেকে তার নিজের বা আপনার উপকৃত হওয়র ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই। বরং এটা নিশ্চিত যে আপনার অনুপস্থিতিতে তারা আপনার সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে মুখরোচক আলাপ জুড়বে। সেটা করতে না পারলে তাদের পেটের ভাত হজম হবে না। 

 

নিজেকে উৎপাদনশীল রাখতে এমন লোকদের এড়িয়ে চলতে হবে। আপনি শতসহস্র ঘণ্টা তাদের পেছনে ব্যয় করেও মন পাবেন না। সামান্য নেতিবাচক পরিস্থিতিতে আপনার আগের অবদান শূন্য হয়ে যাবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় তাদের সাক্ষাৎ বা ফোন রিসিভ করা থেকে বিরত থাকুন। নইলে তারা শুধু সময়ই নষ্ট করবে না, বরং আপনার মন-মেজাজও বিগড়ে দিতে পারে, যা আপনার পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের অতিরিক্ত খাতির করা থেকেও সতর্ক থাকতে হবে। 

 

অনেকে ফেসবুক বা অনলাইনে পড়াকে বই পড়ার বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। ‘ফেসবুক পড়েও অনেক কিছু শেখা যায়’—এমন ধারণায় তৃপ্তি লাভ করেন। যুক্তি আপাতত ঠিকই আছে। কোনো বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা লাভ বা ভাসা ভাসা জ্ঞানের জন্য সেটা উৎস হতেই পারে। কিন্তু কোনো বিষয়ে গভীরভাবে জানার জন্য অনলাইন উৎস খুব কার্যকর নয়। কারণ ওইসব উৎসে সাধারণত মানুষ ক্ষণিকের ভাবনা সহসাই শেয়ার করে দেয়। সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা, তুলনা বা গবেষণা করা হয় না। 

 

তাছাড়া ভাইরাল বা ট্রেন্ড কয়েকদিনের মধ্যেই বদলে যায়। অথচ একটা বই লেখার সময় বছরের পর বছর শ্রম দেয়া হয়। ধারণাগুলো নানাভাবে যাচাই করা হয়। অনেকগুলো হাত ঘুরে সেগুলো ছাপার অক্ষরে প্রতিভাত হয়। হয়তো সে কারণেই একটা বই থেকে কয়েক প্রজন্ম জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়। তাই মেধা, সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেটা থেকে দীর্ঘমেয়াদে ফল পাওয়া যাবে সেটাই তো বেছে নেয়া উচিত, তাই না? 

 

প্রডাক্টিভ মানুষও মাত্র ২৪ ঘণ্টার দিন পায়। কিন্তু তারা এত কাজ কীভাবে করে? কারণ তারা ভালো কিছু অভ্যাস গড়ে তোলে। ডিউক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রতিদিন তার মোট কাজের অন্তত ৪০ শতাংশ অভ্যাস থেকে করে। অর্থাৎ নিত্যদিন যে কাজগুলো করতে হয় সেগুলোর ব্যাপারে যদি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া থাকে তবে অনেক সময় সেভ হয়। যেমন অনেকে চাবি, চশমা, মানিব্যাগ খুঁজতে প্রতিদিন অনেক সময় ব্যয় করে। অথচ বাসা ও অফিসে যদি এ জিনিসগুলো রাখার নির্দিষ্ট স্থান থাকে তবে বের হওয়ার সময় অটো সেগুলো হাতের কাছে পাওয়া যায়। 

 

এখন কথা হলো কোনো অভ্যাস গড়ে উঠতে ঠিক কতদিন সময় লাগে? এটা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, কাজের ধরন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদির প্রভাবে তারতম্য হয়। এটার পরিমাণ ১৮ থেকে ২৫৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। তবে বেশকিছু গবেষণা বলছে, একনাগাড়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে একই কাজ করতে থাকলে তা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে তা ৬৬ দিন। আমরা প্রার্থনা বা শরীরচর্চার ক্ষেত্রে বহু চেষ্টা করেও তা নিয়মিত করতে পারি না। কারণ সেটা অভ্যাসে পরিণত হওয়ার আগেই নানা কারণে বিঘ্ন ঘটে। 

 

তাছাড়া অভ্যাস গঠনের ক্ষেত্রে রিওয়ার্ড বা স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি না করে তা ছোট ছোট ভাগে বেঙে ফেলা উচিত। যেমন অনেকে শুক্রবার জুমার খুতবা শোনার সময় ভাবে, আজ থেকে জীবনে আর এক ওয়াক্ত নামাজও মিস করব না। অথচ আসরের নামাজের সময় হতে না হতেই সেটা ভুলে যায়! কারণ সারা জীবন ধরে সেই কাজ করার পরে সফলতা পাবে। সেই পর্যন্ত এটা টেনে নেয়া কঠিন মনে হয়। অথচ যদি শুধু পরের ওয়াক্তের নামাজকে টার্গেট করত তবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই সেটা অর্জনের তৃপ্তি পেত। এর পরের ওয়াক্ত খুব সন্নিকটে থাকায় সেটাও করত আর সফল হওয়ার আনন্দ পেত। 

 

ঠিক তেমনিভাবে শুধু আজকের শরীরচর্চার টার্গেট ঠিক করলে তা করা সহজ হয়। সেটা শেষ করার পরে শরীর ও মনে দারুণ তৃপ্তি পাওয়া যায়। সেটা পরবর্তী দিনের শরীরচর্চাকে উৎসাহিত করে। একসঙ্গে অনেকগুলো অভ্যাস বদলের চেষ্টা না করে একটা করে টার্গেট করা উচিত। তাতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা সহজ হয়। রুশো বলেছিলেন, সুঅভ্যাস গঠনই শিক্ষা। তাই আমরা সুঅভ্যাস গঠন ও চর্চার মাধ্যমে নিজেদের আরো প্রডাকটিভ করতে সচেষ্ট হই। পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি।