খানিকটা সময় আমি দাঁড়িয়ে ছিল লঞ্চঘাটে। মুখে মাস্ক। তারপরও গন্ধটা একদম পেটের গভীরে চলে গেল। কিন্তু সবুজ মিয়া, ফোরকান জব্বার, সোবাহান এদের নামের মত লোকেদের কি নাক নাই? আমি পানি থেকে অনেকটা দূরে। আর ওরা তো ছোট নৌকায় কালো পানির উপরে ভাসে। হাতে ওদের দার। মনে আছে ওদের পেটের চাওয়া। ঐ দার দিয়ে গোটা পরিবার চলে। নৌকার ব্যক্ত্যর্থের হিসাব করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। মনে হলো আকাশের তারার মতো নৌকা। গণনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি কিন্তু হচ্ছে না। এদিক থেকে ওদিকে তারা নৌকা চালাচ্ছে। গণনা বাদ দিলাম। বেঁচে থাকার দাগিতে মানুষ মরে যায় না, মানুষ বাঁচে সবাইকে নিয়ে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখি চিঠি বিহীন প্রেমিক প্রেমিকা আসছে। আগে প্রেম হতো চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু এখন প্রেম হয় অনলাইনে। সেকালের প্রেমে নদী আর নৌকার দৃশ্য থাকতো। দেখে ভাবলাম এরা অনলাইনে প্রেম করলেও এদের ভাবনা আগের মতো। ঠিক তাই। ছেলে আর মেয়েটা বুঝি আমাদের সময়ের প্রেমের গল্প ওদের মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনেছে। আজ আমার বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই করে। এককালে আমি যুবক ছিলাম। প্রেমের বাতাস আমার আলয়েও এসেছিল। থাক বাদ দেই ঐ কথা। তবে চিঠিতে প্রেম আবেগের ছিল। সে যখন আমাকে চিঠি লিখতো তখন শুরুটা করতো 'প্রিয় ইমু' লিখে। সেই থেকে আমি তার কাছে প্রিয়ই থেকে গেলাম।
ওদের কথা বলি, মেয়েটা ছিল লাল রং এর একটি শাড়ি পরা আর ছেলেটা হলুদ পাঞ্জাবি পরা। আমার কখনই লাল পছন্দ ছিল না। টার্মিনালের পাশেই ফারুক নামের এক লোক আইসক্রিম বিক্রি করে। ছেলেটা বলল, রুপসি তুমি আইসক্রিম খাবে? রুপসি একটু চুপ থেকে বলল, তুমি খাবে তো? লিমন বলল, তুমি খেলে আমিও খাবো। লিমন চলে গেল আইসক্রিম কিনতে। কিনে নিয়ে আসলো। লিমন রুপসিকে বলল, তুমি এটা রাখো আমি তোমার আইসক্রিম ছিড়ে দেই। রুপসি বলল, আচ্ছা দাও। লিমন খুব যত্ন করে আইসক্রিম খুলে দিল। কিন্তু রূপসি আইসক্রিমটি খেলো না। কারণটি ছিল লিমন আইসক্রিমের প্যাকেটটি পানিতে ফেলেছে তাই। আমি এই দৃশ্য দেখে মুচকি একটা হাসি দিলাম। রুপসি তিন পা সামনে গিয়ে ডাস্টবিনে আইসক্রিমটা ফেলে দিল। তারপর লিমনকে অতি রাগে বলল তুমি পানিতে ময়লা ফেলেছো কেন? লিমন তাকে বুঝাতে চেষ্টা করল পানিতে তো অনেক ময়লা আছে, তাই সেও পানিতে ফেলেছে। রুপসি কোনো মতেই তার কথা মানল না। লিমনের হাত ধরে রুপসি নিয়ে গেল নৌকোর দিকে। আইসক্রিমের প্যাকেট তখনও পানিতে ভাসছে। রুপসি সবুজ মিয়াকে বলল, মামা যাবেন? সবুজ মিয়া বলল, কোন ঘাটে যাইবেন ম্যাডাম? রুপসি বলল, মামা ঐ প্যাকেট দেখেন না ওখানে নিয়ে যাবেন। সবুজ মিয়া বলল, আচ্ছা উঠেন ম্যাডাম। তবে কিন্তু ২০ টাকা লাগবো। রুপসি আর লিমন উঠে পড়ল নৌকায়। রুপসি লিমন কে বলল, শোনো তুমি হয় তো বা ওই পানিতে একটা প্যাকেট ফেলেছ। দিনশেষে দেখো কত মানুষ ওই পানিতে ময়লা আবর্জনা ফেলে এতে তো পানি নষ্ট হয়ে যায়। আজকের পর থেকে কখনো যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবো না ঠিক আছে। সবুজ মিয়া নৌকা চালিয়ে প্যাকেটের কাছে গেল। রুপসি লিমনকে বলল, ওই ময়লাটা উঠাও। সবুজ মিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তারপর বলল, স্যার আমি উঠিয়ে দি। রুপসি অতি রাগে বলল, মামা আপনি চুপ করেন। ও এই ময়লা ফেলেছি ওই উঠাবে। তাহলে দ্বিতীয় বার এ কাজ করবে না। ময়লা উঠিয়ে তারপর নৌকাটি তীরে নিয়ে আসলো। এবং সবুজ মিয়াকে ২০ টাকা বের করে দিতে চাইল রুপসি। কিন্তু সবুজ মিয়া বলল, ম্যাডাম আপনার কাছ থেকে টাকা নেয়া ঠিক হবে না। আপনি যে ভালো কাজটি করলেন এতে আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। রুপসি বলল, না না মামা এইটা তো আপনার পাওনা। আর ওই কাজটি তো আমার নিজেরই। তারপর রুপসি টাকা দিয়ে চলে আসে। লিমন আর রুপসি চলে যায় ডাস্টবিনের কাছে সেখানে প্যাকেটটি ফেলে দেয়। রুপসি লিমনকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'তুমি তাকিয়ে দেখো এই শহরের বুকে একটি মাত্র নদী, এই নদী তো আমাদের প্রাণ। আমরা এই ময়লার ভিতরে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যদি কোন এক সুন্দর শহর বা গ্রাম থেকে এই নগরীতে কেউ আসে তবে তারা কি বলবে আমাদের দেশের রাজধানী কে? তুমি আমি সচেতন হলে সুন্দর হবে বাংলাদেশ।'
লিমন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলে আচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল। আর কখনও হবে না। এখন থেকে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলবো।
আমি এরকম প্রেম দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারলাম না। মন চাইলো আবার ফিরে যাই যৌবনে। যৌবনে গিয়ে ওই সবুজ মাঠের উপরে আমার ফেলে আসা বাদামের ছোলা গুলো তুলে আনি। তারপর রেখে আসি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে। হোক না আমার শহরটা সুন্দর। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলে আমিও বলতাম, 'তুমি আমি সচেতন হলে সুন্দর হবে আমাদের বাংলাদেশ'।
গল্প: নগরীতে।
লেখক: মুহাম্মদ আল ইমরান।