পোস্টস

গল্প

অর্ণব মিত্রের ছোটগল্প — ছুটি ( রহস্য ও ভৌতিক )

২৫ জুন ২০২৪

অর্ণব মিত্র

মূল লেখক অর্ণব মিত্র

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে আজ তিনদিন। হলের সবাই একে একে বাড়ী চলে গেছে। ৭০৩ নম্বর রুমে আমি একা। চারদিক নিস্তব্ধ। কীসের একটা,শব্দ হচ্ছে, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, স্নানের ঘর থেকে ঝর্ণার জল পড়ার শব্দ আসছে৷ আস্বস্ত হলাম, হলে এখনো কেউ আছে তাহলে। দরজা খুলে দেখার জন্য বের হলাম৷ দেখলাম দরজা খোলা, ভিতরে কেউ নেই। ঝর্ণা থেকে এখনো ট্যাপ ট্যাপ করে জল পড়ছে৷ মাত্রই বন্ধ করা হয়েছে ঝর্ণাটাকে। কিন্তু গেলো কই লোকটা? একটু ভয় পেলাম। চারদিক কেমন ভারী ভারী লাগলো। রাত এখন নয়টা বাজে, এত রাতে কে আসবে এখানে স্নান করতে?

পুরো ফ্লোরের প্রতিটা রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম, সবগুলো রুমেই তালা ঝুলানো৷ তাহলে কে ছিলো ওখানে? গা শিরশির করে উঠলো আমার। জোর পায়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। মাথাটা চিনচিন করছে। সারাদিন বাইরে ছিলাম, রাস্তার জ্যামে আটকে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। চোখ বুজে শুয়ে পড়লাম।

চোখ খুললাম তখন রাত একটার একটু বেশি বাজে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রাতে আর খাওয়াও হয়নি। ফোনটা হাতে নিয়ে ইউটিউবে ঢুকলাম। গান শুনবো। ঠিক তখনই মনে হলো, উত্তর দিকের কোনো একটা রুম থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসছে। ঝট করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আমার বাঁশিটা কোথায় দেখার জন্য টেবিলের দিকে তাকালাম, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না৷ টেবিলে ভালো করে খুঁজলাম, কিন্তু বাঁশিটা নেই। মনে পড়লো, বাঁশিটা সুনিল নিয়েছিলো। তাহলে কি সুনীল বাজাচ্ছে বাঁশিটা? কিন্তু সুনিলের তো বাড়ী যাওয়ার কথা, আর সন্ধ্যায় যখন গিয়েছিলাম, তখনও ওর রুমে তো তালা ঝুলানো ছিলো। এখন আবার গিয়ে দেখবো একবার? কিন্তু এত রাতে যেতে সাহস হচ্ছে না৷ বাঁশির সুর আরো তীব্র হলো, যেন আমার রুমের দিকে এগিয়ে আসছে সুরের উৎসস্থল। ভয় পাচ্ছি আমি৷ রুমের দেয়ালের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছি, ঠিক আমার পেছনে কেউ নেইতো? ভাবলাম এভাবে তো ভয় আরও বাড়বে, একবার গিয়ে দেখে আসি।

দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই মনে হলো ভারী বাতাসে শরীর ভিজে যাচ্ছে। শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে সুনিলের রুমের সামনে গেলাম। রুমের ভেতর থেকেই সুরটা আসছে। ভেতরে কেউ আছে নিশ্চয়ই। আমি ভয়ে ভয়ে দরজায় নক করলাম, সুনিল? সুনিল! ভিতর থেকে কেউ একজন বললো, দরজা খোলা।

আমি দরজায় ধাক্কা দিতেই দেখলাম সুনিল খাটের ওপর বসে আছে। আমার শরীর থেকে ভার কমে গেলো। ওকে দেখে হেসে বললাম, তাহলে তুই বাঁশি বাজাচ্ছিলি?

হ্যাঁ। তুই কী ভেবেছিলি? কথাটা বলার সময় ওর চোখের দিকে ভালো করে খেয়াল করলাম, একটু কেমন যেন। ওকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই সুনিল তো?  

ও বললো, এ আবার কী কথা? আমি কি দেখতে সুনিলের মতো না? ওর কথার উত্তর দিলাম না আমি, বললাম, বাড়ী যাবিনা তুই? ও বললো, না! এখন থেকে হলেই থাকবো। ওর রুমের দেয়ালে একটা বৃদ্ধ মানুষের ছবি টানানো ছিলো, কিন্তু দেয়ালে ছবিটা দেখছিনা এখন৷ জিজ্ঞেস করলাম, কী রে? এখানে একটা ছবি ছিলোনা?  
ছিলো!  ফেলে দিয়েছি।  
কেন?  
ও বললো, ছবিটা পুরনো হয়ে গেছে, তাই। আমি আর কথা বাড়ালাম না। রুমটাতে অস্বস্তি লাগছে৷ সুনিলকে অপরিচিত লাগছে আমার। ওর কথার ভঙ্গি, গলার স্বর সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে৷ ওর রুমের দরজা টেনে দিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে। ভয় ছাড়েনি এখনো আমার৷ বোতল থেকে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

ভোরে উঠে উপাসনা করার অভ্যাস আমার। উপাসনা শেষে নিচে নামলাম। দেখলাম একজন গার্ড চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা খটকা লাগলো। আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন? আমি লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?  

লোকটা বিরক্তি নিয়ে মুখ আরেকদিকে সরালো৷ আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, কিছু হয়েছে আপনার? 
উনি এবার আমার দিকে একটু অদ্ভুত ভাবে তাকালেন। আমার মুখটা একটু ভালো করে দেখে বললেন, আপনি কালকে রাতে আমার পিঠে কিল মেরে দৌড় দিছিলেন না?

ওনার কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বলে কী লোকটা? আমি ওনাকে কিল মারবো কোন দুঃখে? মধ্য বয়সী একটা লোক, তার পিঠে কিল মারার মতো রসিকতা আমার দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। তাকে বললাম, আমি আপনাকে কিল টিল মারিনি৷ অন্য কেউ মেরেছে হয়তো৷

উনি রেগে গিয়ে বললেন, মিথ্যা কথা কন? পাগল পাইছেন?  আমি স্পষ্ট আপনারে দেখছি৷ ওনার কথা শুনে এবার সত্যি সত্যি ওনাকে পাগল মনে হলো আমার। যত দ্রুত সম্ভব ওনার সামনে থেকে সরতে হবে। ওনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মোটামুটি দৌড়ানোর মতো করেই ফিরে এলাম৷ সারাদিন সুনিলের সাথে কথা হয়নি আর। আমিই যাইনি ওর রুমে।

সন্ধ্যা থেকে টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ল্যাপটপটা স্লিপ মোডে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুম চলে আসে। দরজা ভিতর থেকে লাগানো ছিলোনা। শরীর ক্লান্ত হওয়ায় এখন আর উঠে দরজা লাগাতেও ইচ্ছে করছেনা৷ চোখে লেগে আসে আমার৷

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি। রাত তখন এগারোটার একটু বেশী। হঠাৎ মনে হলো কেউ দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেছে, কিন্তু ঘুমের ঘোর কাটলোনা আমার৷ হালকা পায়ের শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা ধীরে ধীরে আমার কাছে আসছে৷ মনে হলো লোকটা বাক বদলে টেবিলের দিকে গেলো, আমি চোখ খুললাম, কিন্তু কোনো শব্দ করলাম না। রুমের লাইট  অফ ছিলো, আবছা অন্ধকারে লোকটাকে দেখতে লাগলাম। লম্বা ছিপছিপে গড়নের একটা লোক, মুখটা স্পষ্ট নয়। লোকটা আমার টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা হাতে তুলে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলো। তখনি আমি শব্দ করে উঠে বসলাম, আপনি কে?

লোকটা ল্যাপটপটা রেখে মুহুর্তের মধ্যে আমার দিকে চলে এলো৷ গলা টিপে ধরলো আমার। আমাকে চেপে ধরেছে বিছানায়, আমি তার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিনা৷ লোকটার মুখটা ঠিক আমার মুখের ওপরে। ভয়ংকর দানবের মতো দেখাচ্ছে তাকে। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শক্তি রহিত হয়ে আসছে, লোকটা বিভৎস চেহারায় দাত কিটমিট করে আমার গলা চেপে রেখেছে। মনে হচ্ছে এখনি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে, আর পারছিনা।

শেষবার চিৎকার করে উঠলাম প্রাণপণে, কিন্তু কোনো শব্দ হলোনা। ঠিক তখনি কিছু একটা শব্দ পেলাম। কারো মাথায় ধাতব কিছু দিয়ে মারলে যে শব্দ হবে ঠিক তেমন একটি শব্দ। আমার গলার ওপর থেকে লোকটার হাত হালকা হয়ে সরে গেলো। আমি জোরে জোরে শ্বাস নিলাম, প্রাণ ফিরে পেলাম। লোকটা দৌড়ে আমার রুম থেকে পালিয়ে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম, আবছা অন্ধকারের মাঝে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আরও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, একটি রড হাতে দাঁড়িয়ে আছে সুনিল৷ ও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আমি উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, ভাই, বাঁচালি আমায়। তুই না এলে, এখনই আমার প্রাণটা যেতো। ও কিছু বললোনা, শুধু নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর হাত থেকে রডটা মেঝেতে পড়ে ঢং করে শব্দ হলো। ও আমাকে ছাড়িয়ে, ধীর পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। আমি পেছন থেকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

_______

বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে গতকাল৷ সবাই ফিরেছে হলে৷ সবাই সুনিলকে নিয়ে কী যেন বলাবলি করছে। সুনিলের রুম থেকে জিনিসপত্র বের করছে কয়েকজন। একটা লোক জিনিসপত্র গুলো নিয়ে নিচে রেখে আসছে৷ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব কোথায় নিচ্ছেন?

লোকটা বললো, বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি৷

আমি বললাম, বাড়িতে কেন নিচ্ছেন? সুনিল এখানে থাকবেনা আর?  

লোকটা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আপনি জানেন না? সুনিল নেই আজ উনিশ দিন। বাড়ী যাওয়ার সময় রোড এক্সিডেন্টে.....  তখনই আরেকজন ডাকলো লোকটাকে। উনি চলে গেলেন।

আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, সুনিল নেই আজ উনিশ দিন, সুনিল নেই আজ উনিশ দিন। 
মনে পড়লো সেই রাতের কথা, যে রাতে ও বাঁশি বাজাচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাড়ী যাবি না? ও বলেছিলো, 'এখন থেকে হলেই থাকবো'। তখন বুঝিনি ওর কথা, ও এখন থেকে হলেই থাকবে!

আমি ওই লোকটাকে আবার ডাকলাম, জিজ্ঞেস করলাম, ওর রুমে একটা বাঁশি পেয়েছেন? লোকটা উত্তর দিলো, না তো!

ওর রুম থেকে বইখাতা গুলো বের করে সামনে রাখা হয়েছে। স্তুপ করে রাখা বই খাতার পাশে পড়ে থাকা একটা কাগজে চোখ আটকে গেলো আমার৷ কাগজটা হাতে তুলে নিলাম, তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা,  আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু অমিত। আমার ভেতরটা হুহু করে উঠলো। অমিত আমারই নাম।

 

লেখা কপিরাইট: অর্ণব মিত্র

গল্পটি কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না৷ আপনাদের মন্তব্যের প্রত্যাশায় — আমি।