Posts

চিন্তা

ভালোবাসা

June 25, 2024

হুমায়রা আফরোজ

Original Author হুমায়রা আফরোজ

174
View
  •  ভালোবাসা

ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচয় নেই এমন কাউকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? সম্ভবত না। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই একটা মানুষ ভালোবাসার পরিচর্যার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, হুট করেই বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়ে ভালোবাসা প্রথম টের পাওয়া যায়। মানুষ ভালোবাসা টের পায় মাতৃস্তনে প্রথম চুমুকেই। চারপাশে নানান রকমের মানুষের আনাগোনা, আদর, কোলে নিয়ে খেলা, একটু বড় হলেই হরেক রকমের উপহারের ভেতর দিয়ে সে ডুব দেয় ভালোবাসার রাজ্যে। জন্মের সূচনা থেকেই সুন্দর সুন্দর উপহার পাওয়াটাই তার কাছে একটা ভালোবাসা। আমার কাছে মনে হয় এই একটা অভ্যস্ততা থেকেই মানুষ কেয়ারিং তত্ত্বের আবিষ্কার করেছে যার সাথে দেওয়া-নেওয়ার বিশাল এক যোগ!


 

ভালোবাসা বড্ড অদ্ভুত। ভালোলাগার মানুষটাকে নিজের করে পেতে আমরা ভালোবাসা নামক শব্দটা জুড়ে দেই সুকৌশলে। 'তোমাকে ভালোবাসি' বলার সাথেসাথেই অলিখিত একটা অধিকার খাটাতে গৌরব অনুভব করি। ভালোবাসা সার্থক করতে ঝাঁপ দেই কত কত বিপদসংকুল পথে। ভালোবাসা না পেয়ে হয়ে যাই দেবদাস! আচ্ছা ,ভালোবাসার পূর্ণতা না পেয়ে দেবদাসকেই পেলাম কিন্তু কোনো দেবদাস টাইপ নারী কেন নেই সাহিত্যে? নাকি নারীরা ভালোবেসে ধুকে ধুকে মরে না? নাকি সাহিত্যে ঠিকই তেমন কালজয়ী কোনো নারী আছে আমি জানি না? 


 

কিছুদিন ধরে ভালোবাসা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। একবার মনে হচ্ছে, ভালোবেসে দেউলিয়া হয়ে যাওয়াটাও কম সার্থকতার না। আবার মনে হচ্ছে, দেউলিয়াই যদি হতে হয় এটা কিরকম ভালোবাসা? মানুষ তো ভালোবাসে পূর্ণতা লাভের আশায়। আচ্ছা, মানুষ কি সত্যিই পূর্ণ হয়? নাকি পূর্ণ হবার চেষ্টা চালায় অথবা অপূর্ণ হয়েও পূর্ণতার ভাণ করে? হতে পারে সবই সত্য। কারণ, শরৎচন্দ্রের মহান বাণী কানে বাজে নিত্য- "বড় প্রেম কেবল কাছেই টানে না, তা দূরেও সরিয়ে দেয়।" কী জানি বাবা এই বড়প্রেমের কি মাহাত্ম্য! 


 

আবার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আজীবন একসাথে থেকে জীবন অতিষ্ট করে দেওয়ার নাম কি হতে পারে? আমরা কি অতিষ্ট করি না একজন আরেকজনকে? সীমানাপ্রাচীর তৈরী করে দেইনা নানারকম চাওয়া-পাওয়ার? দেই, সচেতনভাবেই দেই। আমরা মনে করি, যাকে ভালোবাসি সে কেবল আমার; অন্যকারো না, হতেই পারে না। শুরু হয় গোলযোগ। গোলোযোগ না হওয়া যুগলও যে একেবারে নেই তা বলা যায় না। কারণ কর্মক্লান্ত পার্টনারের সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে স্বামী/ স্ত্রীর  পছন্দের জিনিস তৈরি করা, রাতের আঁধারে চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার চিত্রও সমাজে নিভৃতে বিচরণ করে বেড়ায়। এরা নিভৃতচারী হলেও কোনো না কোনোভাবে ঠিকই মানুষের নজরে আসে এবং হয়ে উঠে অনুকরণীয়। দেবদাস নিয়ে মানুষের ভয়াবহ আকর্ষণ থাকলেও দিনশেষে অইসব নিভৃতচারীর জীবনটাকেই আকাঙ্ক্ষা করে সবাই।


 

মানুষ খুব অদ্ভুত। মুখে মুখে বলে বেড়াবে, আমার খুব একটা চাহিদা নেই আমি অল্পতেই তুষ্ট। অথচ ঠিক উল্টা ঘটনাই চোখে পড়ে বেশি। মানুষ যত পায় তত চাহিদা জন্মায়। এ যেন অর্থনীতির চাহিদা ও যোগান বিধির চিত্রের মতই স্পষ্ট - "মানুষের ভালোবাসার যোগান সীমিত কিন্তু চাহিদা অসীম।" ভালোবাসার যোগান কিন্তু কোন এবস্ট্রাকট কিছু না। অথচ আমরা ভালোবাসা শব্দটাকে এবস্ট্রাকট থিউরি দিয়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। ভালোবাসা যদি সত্যিই কেবল মনের কোন ব্যাপার হতো তাহলে একগুচ্ছ ফুল পেলে কেন মানুষটাকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে? ইচ্ছা করে বুকের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে গন্ধ নিতে? সে গন্ধ ত হতে পারে ঘাম কিংবা সিগারেটের অথবা সারাদিন চুলার আঁচে দাঁড়িয়ে রান্না করে ভিজে চুপসে যাওয়া শরীরের! তবুও এই ইচ্ছা কি প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই তৈরি হয় না? নাকি দিনের পর দিন কোনকিছু না পেয়েই আমরা মাতাল হই প্রেমের দুনিয়ায়? বিভোর হই চোখের ইশারায়? হই না। এটাই শাশ্বত সত্য। কারণ, দীর্ঘ অপ্রাপ্তির পর শুরু হয় অভিযোগ - "সে আমায় ভালোবাসে না, ভালোবাসলে ত দশ টাকার একটা গোলাপ আনতে পারত; কমপক্ষে একটা মিস্টার ম্যাংগো!" অর্থাৎ ভালোবাসার সাথে লেনাদেনার সম্পর্ক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। আর লেনদেনকে আমরা সঙ্গায়িত করেছি 'সারপ্রাইজ গিফট' নামক আশ্চর্য সুন্দর এবং মার্জিত শব্দযোগে! 


 

ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমরা কি দিনের পর দিন গিফট শপে দৌঁড়ে বেড়াই না? কিংবা কঠিন নিয়মানুবর্তিতার অফিস ফাঁকি দিয়ে ছুটে আসি না, একটু দেখতে? সবই করি, কিন্তু পরম আরাধ্য পেয়ে গেলে মনে করি এতদিন ইনভেস্ট যা করার করেছি, এখন আমি ক্লান্ত ,এখন শুধুই পাব। মানুষ ভুলে যায় বহু ইনভেস্টমেন্টের পর সে একজনকে পেয়েছে আর এই ইনভেস্টমেন্টকে বাড়িয়ে কয়েক ডাবল করার জন্য এখন তার উচিত বাড়তি মনোযোগের। তখনই একটু সারপ্রাইজ প্রত্যাশা মনে হয় নেকামি।


 

 আমরা এমন অনেক গল্প-নাটক-সিনেমা সম্পর্কে জানি যেখানে প্রণয় পরিণয়ে পরিণত হওয়ার আগে অনেক অনেক গিফটের নজির দেখি কিন্তু পরিণয়ের পর এই যত্নটা দেখি না। এইটাকে তখন আর যত্নও মনে হয় না, মন হয় আধিখ্যেতা। অথচ মানুষ যদি জানতো যে, মানুষ অল্পেই খুশি; তাহলে হয়ত মন ভাঙার ঘটনাগুলো ঘটতো কম। অনেকেই বলবে, ভালোবেসে দিয়ে দিয়ে ফতুর হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও ত কম নেই। আসলেই কম নেই। এটা ঠিক বিয়ের  পর সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়ার পরেও মানুষ করেছে বিশ্বাসঘাতকতা। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে যা দেখি- মানুষ উপহার, অর্থ পেলে পায়না মানুষ নামক মহামূল্যবান পরশপাথরকে, আবার মানুষ পেলে পায় না মনের মত উপহার কিংবা যত্ন। কেউ কেউ আবার কিছুই পায়না, কেবল জীবন অতিবাহিত করে একটা সম্পর্কের কারণে। অথচ মানুষ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে একটু যদি খেয়াল করতো তাহলে হয়তোবা বিপত্তি একটু কম বাঁধতো। ও আচ্ছা, একটা কথা ত বলাই হয়নি। সমাজে কেউ যদি ভালবাসার সর্বোচ্চ উদাহরণ তৈরি করে সময়-যত্ন-উপহার দিয়ে তাহলে সমাজ থেকে শুনতে হয়- "তোমাকে ত তোমার জামাই/বউ জাদু করেছে, জীবনের সব বিসর্জন দিয়ে টের পাবা এই বোকামির ফল।" অর্থাৎ মুখে মুখে আমরা যতই সামঞ্জস্যের কথা বলি না কেন, সমাজ আমাদের মুখে ঝামা ঘষবেই সব সুন্দর করে মেইনটেইন করলেও। মেইনটেইন না করলে ত কথাই নেই, তখন চলবে শুধু আগুন - হয় মুখে, নাহয় মনে। 


 


 

Comments

    Please login to post comment. Login