এই তপ্ত শহরে যখন মারিয়া রহমান মিশুক মনের অজান্তেই তার লাল টুকটুকে পার্সটা বাসের সিটে ফেলে উঠে যাচ্ছিল তড়িঘড়ি করে, তখন পাশেই দাঁড়ানো একটি মধ্যবয়স্ক পুরুষ তাকে ডেকেছিল পেছন থেকে। বাসে মানুষ থৈ থৈ করছে, এক আঙুল পরিমান জায়গা বাকি নাই। তারই মাঝখানে একটি সিট ফাঁকা হচ্ছে এই দেখে সাত আটজন হামলে পড়ছিল প্রায়, যখন নেমে যাচ্ছিল মারিয়া রহমান মিশুক। আর সবচেয়ে অগ্রগামী লোকটা দেখছিল পার্স ফেলে যাচ্ছে মেয়েটি।
- থ্যাংক ইউ, ভাইয়া।
এক. একফালি ফর্সা আলোর রেখা
বিছানা ছাড়তে না ছাড়তেই "উহ!" শব্দে গুঙিয়ে ওঠে রঞ্জু। ফের শুয়ে পড়তে বাধ্য হয় সে। তখুনি বাইরে কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ে, ঝুম বৃষ্টির শব্দে কিছু শোনা যায় না; তবুও সামান্য কিছু হয়ত শুনতে পায় সামিয়া। সামিয়া ছুটে আসে বেডরুমে। এসে দেখে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে রঞ্জু। ধমক দিতেই যাচ্ছিল সে, "এই বেলা অবধি ঘুমালে বাজারটা কে করবে?",এমন একটি ধমক সামিয়ার গলা অবধি উঠে আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং তাকে দেখায় কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন। সে হয়ত ভাবে কী হলো লোকটার, ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায়।
- এই কী হলো?
- কিছু না। শিরদাঁড়াটায় একটু টান লেগেছে মনে হচ্ছে।
এটুকু শুনেই কপালে চিন্তার সিঁড়ি মুছে যেতে দেখা যায় সামিয়ার।
- ওঠো তাড়াতাড়ি।
রঞ্জুও কী মনে করে ব্যথাটাকে আর পরোয়া করতে পারে না, উঠে পড়ে এবং চলে যায় বাথরুমে। এরপর রঞ্জুর অসুস্থতা বাড়তে থাকে। বাথরুমে হড়বড় করে রক্তবমি হয় তার। কোনোমতে বাথরুম থেকে বেরুতে না বেরুতেই লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে, জ্ঞান হারাতে থাকে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে, দাঁতে দাঁত লেগে যায় শক্তমতো। এই সমস্ত দৃশ্যের অবতারণা হয় সামিয়ার সামনেই। কী করবে বুঝে ওঠার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে সামিয়া, চিৎকার করে, পাশের ফ্ল্যাটের দরজার ধাক্কা মারতে থাকে। ততক্ষণে নাকমুখ ছাপিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রঞ্জুর করতল। আর কিছুই সে মনে করতে পারে না।
সরকারি হাসপাতালের ছিমছাম বেডগুলো হয় আধময়লা। একেকজন রোগী নাম কেটে চলে যাওয়ার পর তার ঘাম ও শরীরের চিহ্ন, কিংবা রক্তের ফোঁটা, পুঁজ, এসবেরই দাগ পড়ে থাকে। মরচে ময়লাও থেকে যায় প্রায়শই। আর হাওয়ার ভেতর ঘোরাফেরা করে বিভিন্ন মেডিসিনের গন্ধ, যা কিনা হাসপাতালের নিজস্ব ঘ্রাণ, উৎকট ও নার্ভ দূর্বল করে দেয়। এসবের মধ্যে সুস্থ মানুষেরও গা গুলোতে থাকে, রঞ্জুর তো আরও; কারণ হাসপাতাল বিষয়ক তার পূর্ব অভিজ্ঞতা অপ্রতুল। এমনি সে ডাক্তার দেখিয়েছে বহুবার, সামিয়াকে নিয়ে কিংবা একা, কিন্তু ওয়ার্ডে থাকা কিংবা কাউকে দেখতে যাওয়া এধরণের কাজ কখনো করতে হয়নি তার। এখন জ্ঞান ফিরে যেই না এই পরিস্থিতি দেখছে, অমনি তার অস্বস্তি আরও বাড়ছে আর চারিদিকে অসহায়ের মত তাকাচ্ছে সে। সামিয়া কোথায়? সামিয়া? মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোয় কেবল, কথাটি আর বেরোতে পারে না। একজন নার্স ছুটে আসে, সেদিকে মন নাই রঞ্জুর; সে খোঁজে সামিয়া। তার শরীর অনড়, কতকটাই যার ব্যান্ডেজে আবৃত। সামান্য কাত হতে চাইলেও ব্যথা লাগে। শিরদাঁড়া ভেঙেছে কি? হতে পারে, তা সে এখনও জানে না।
বিশাল এই ওয়ার্ডে ভাগ্য করে মাথার কাছে একটি আধখোলা জানালা পেয়েছে রঞ্জু। জানালার গ্রিলে কফ থুতুর কালো দাগ মোটা হয়ে রয়েছে বোঝা যায়। কপাটটিও ভঙ্গুর, এক কোণা খুলে এসেছে ওপর থেকে। কতদিন যে বন্ধ করা হয় না কে জানাবে! জানালার বাইরে কালিগোলা অন্ধকার ভেদ করে পাশের ভবনের এক ঘর থেকে একটি ক্ষীণ আলোর রেখা বরাবর চোখের ওপর এসে লাগছে। ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে কোথাও। হয়ত ছাদ থেকে নেমে আসা ধারা। সেই আলোর উৎসটির দিকে তাকালে বোঝা যায় এখনও বৃষ্টি। সামান্য ঠান্ডা বাতাস বয়ে আনছে কোনো ময়লা পঁচার গন্ধ যা অতটাও প্রকট নয়। মাথার অনেক ওপরে এক জীর্ণশীর্ণ ফ্যান ঘুরছে ঘড়ঘড় শব্দ করে। শব্দই যা, বাতাস তেমন আর পৌঁছাতে পারছে না মানুষের শরীর অবধি। দূরে দূরে কয়েকটা টিউবলাইট জ্বলছে ক্লান্ত হয়ে, প্রায় নিভু নিভু, দেখে মনে হবে বয়সের ভারে কাবু হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। নার্স নতুন আরেকটা স্যালাইন দিলো। "আমার স্ত্রী কোথায়?", এই প্রশ্নটা রঞ্জুর চোখের ভেতর যেন ফুটে উঠেছিল ফ্যাকাশে হলুদ হয়ে, নার্স মেয়েটিও যেন তা বুঝতে পেরেছিল।
- " উনি একটু বাইরে গেছেন, এক্ষুণি চলে আসবেন।", এটুকু বলে চলে যায় নার্স।
রঞ্জু ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ পাশে তাকায়, যেখানে একটি বৃদ্ধা মহিলা ধবধবে সাদা চুল ও লিকলিকে শরীর নিয়ে শুয়ে আছে নির্বিকার। পরনের বাসি কাপড়খানির কী রং? ফিরোজা না পিংক? রং চিনতে রঞ্জুর সেই স্বাভাবিক ভুল হয়ে যাচ্ছে আবারও তাই সে আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করতে থাকে এবং কিছুতেই বুঝতে পারে না ফিরোজা না পিংক। না-কি অন্যকিছু? শেষবার সে সামিয়াকে যখন দেখেছে তখন সামিয়ার গায়ে ছিল ফিরোজা রঙের থ্রিপিস। থ্রিপিসটা রঞ্জুর কেনা নয়, এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিয়েছিল তাকে; যে জানে সামিয়ার পছন্দের রং ফিরোজা। সামিয়ার ভাষায় বন্ধুটি সুপুরুষ এবং তার নাম রঞ্জু এখন মনে করতে পারছে না। নাহিদ অথবা নাসিম কি? না তা-ও না। ন দিয়েই শুরু এটুকু মনে পড়ে শুধু। তারপর আর মনে পড়ে না কিছু, ভাবনার ভেতর থেকে ওই লোকটার নাম হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ।
নাতিদীর্ঘ জানালার একটি অংশ বৃদ্ধাও পেতে পারত দুটি বেডের আরেকটু কম ব্যবধান হলেই, কিন্তু পায়নি। না পাওয়ার আক্ষেপে না-কি বাইরের মৃদুমন্দ সেই বাতাসের লোভে, বারবার সে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল জানালার দিকে। রঞ্জু মহিলার দিকে তাকাতেই সে-ও তাকায় রঞ্জুর চোখাচোখি। অপর্যাপ্ত সে আলোর ভেতর ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ে বৃদ্ধা। কেন? কী কারণে, এসব বোঝা যায় না। বৃষ্টির বেগ তখন বাড়তে থাকে, সঙ্গে বাড়ে জানালা দিয়ে আগত বাতাসের বেগও। চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক মানুষের অনেক রকম টেনে টেনে বলা কথা, কখনো নাকিসুরে কান্না, কখনওবা ফুঁপিয়ে, বাচ্চাদের চিৎকার, এরকম হাজারও শব্দের এক বিচিত্র মেলানকোলি তৈরি হয়ে আছে এবং এরই মধ্যে আবার ঘুম ঘুম অনুভূত হয় রঞ্জুর। তবু সামিয়া নামক ভাবনাটি তার মনের ভেতর খোঁচা মারে অনবরত। রঞ্জুকে এরকম একেবারে একা ফেলে সে কোথায় উধাও হয়েছে? এই শহরে আত্মীয় বলতে কিছু নেই তাদের। থাকার মধ্যে তারাই দুজন একে অপরের পরমাত্মীয় হয়ে ছিল। সেই আত্মীয়তা ধীরে ধীরে কেমন মেকিও যে হয়ে উঠেছে তা টের পেয়েছে রঞ্জু; এবং অবশ্যই সামিয়াও। আজ তো উইকেন্ড, অফিস তো নেই, এমনকি কোনো জরুরি মিটিংও থাকার কথা নয় সামিয়ার। যদি থাকেও তার স্বামীর এহেন অবস্থায় কোনোকিছুরই কি পরোয়া করা উচিত? এসব ভাবতে ভাবতে রঞ্জুর মনে হয় এ সব অহেতুক ভাবনা। হয়ত সামিয়া এসে পড়বে এখনই বা একটু বাদেই। ভাবনার এই ঝুড়িটা রঞ্জু তাই একপাশে সরিয়ে রাখে এবং টেনে আনে আরেকটি ভাবনার ঝুড়ি। কিছুদিন আগে এক রাতে সামিয়া ও সে গল্প করছিল বারান্দায় বসে বসে চায়ের কাপ হাতে, অফিশিয়াল জীবনের খানিক মজার এবং খানিক বিরক্তির গল্প যেগুলোই কি-না সারাদিনের সঞ্চয় কে না জানে! সামিয়া বলছিলো,
- গতমাসে আমার পাশের ডেস্কে মাঝবয়সী এক নতুন ভদ্রলোক আসছে বুঝছো। লোকটা এত রসিক আর এত চালাক! কিন্তু এই যুগে এসেও চা পিরিচে ঢেলে খায়।
- কই এর কথা তো এতদিন বলো নাই। নাম কী? বাড়ি কোথায়?
- নাগিব নওয়াজ, বাড়ি সাতক্ষীরা। (এই মুহূর্তে এসে রঞ্জুর সেই হারিয়ে যাওয়া নামটা মনে পড়ে। ভরসা ফিরে পায় সে নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর।) আমার মনে হয় লোকটার মাথায় ডিস্টার্ব আছে। বিয়েশাদি করছে কি-না জিজ্ঞেস করলে খালি হাসে আর কথা ঘুরায়। আবার এমন ভাব করে যেন বিয়ে কী সে জানে না। অথচ প্রতিদিন ইস্ত্রি করা জামাপ্যান্ট পরে আসে, টাই বাঁধে ঠিকঠাক, চুল আঁচড়ানো। ব্যাচেলর পুরুষ মানুষ এত নিখুঁত চলেফেরে বলো?
- আমি যে বিবাহিত হয়েও এতকিছু পাই না সে কথা একদিন তাকে শুনায়ে দিয়ো।
এটুকু বলে পলকা একটা খোঁচা মারে রঞ্জু। খোঁচা নয় যেন আক্ষেপের মত শোনায়, শুনতে ভালো লাগে না। সামিয়ার হাসি হাসি মুখ তখন কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে আসে।
- কেন তুমি তোমাকে গুছিয়ে চলতে পারো না? আমি একা সব দেখব না-কি? নিজেরটা নিজে ঠিকঠাক করে চলতে শেখো।
এরপর দু'জনেই ছিপ ছিপ শব্দে ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ে চুমুক দিতে থাকে, কথা হয় না কোনো। তখন দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আসে, শোনা যায় পাশের বাসার ছোট্ট মেয়েটির ডাকাডাকি। সামিয়া তড়িঘড়ি করে চলে যায় সেদিকে, রঞ্জুও তাকিয়ে থাকে সেদিকে, মেয়েটির পাওয়া আদরের দিকে।
দুই. ভাঙা বিস্কুটের মত টুকরো টুকরো রোদ
রঞ্জু ভাবছিল সামিয়ার সাথে তার চলমান আপাত দ্বন্দ্বের কারণে একটা ফাটল কি একটা চিড় তৈরি হচ্ছে কি-না। সামিয়া যা চাইছে বা রঞ্জু যা চাইছে, কেউই ঠিক কারোর মনের মতন হয়ে উঠতে না পারার এই দৃশ্য ক্রমেই যে স্পষ্ট আকার ধারণ করছে এবং দূরত্বটা যে বেড়েই চলেছে সে বিষয়ে রঞ্জু নিঃসন্দেহ। সেই ফাটল কিংবা চিড়ের ভেতর থেকে ওই ফর্সা আলোটি এসে পড়ছে কি দু'জনের গায়েই? পড়ছে হয়ত। কারণ রঞ্জুর আবার মনে পড়ছে আরেকটি কথা, আরেকটি মেয়ের কথা তার মনে পড়ছে যার সাথে প্রায়দিনই অফিস ফেরার পথে দেখা হতো গোলচত্বরের মোড়ে। মেয়েটি এমন কিছু নয়, রঞ্জুরই এক বন্ধুর বান্ধবী সেই হেতু একদিন পরিচয় ও পরবর্তীতে যেহেতু একই পথে যাতায়াত প্রতিদিন, সেহেতু মোড়ের দোকানে বসে চা খাওয়া ও অন্যান্য গল্পগুজব চলত প্রায় দিনই। অনেকটাই পরিষ্কার ছবি ও সামনের তিন তিনখানা বাঁকা দাঁতের এই মেয়েটি ভালো গান গায়। বাবা হারিয়ে দুই বোন ও মায়ের সংসারে তার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ছিলো একসময়, কিন্তু এখন ভালো একটা চাকরি করছে বিধায় রক্ষা। রঞ্জু প্রথমদিনই জিজ্ঞেস করেনি মেয়ে বিবাহিত কি-না, সংকোচে। এরইমধ্যে দুয়েকদিন হাই হ্যালো হয়েছে। পরে একদিন সময় করে বসেছে তারা এবং রঞ্জু জেনেছে মেয়েটি বিবাহিত নয়। নাম তার মারিয়া রহমান মিশুক, ডাকনাম ওই মিশুকই। এখন তাদের প্রায় নিয়মিতই যোগাযোগ। প্রথম প্রথম অত গা করেনি রঞ্জু, পরে দেখেছে সন্ধ্যায় ফেরার পথে মিশুকের সাথে দেখা না হলে মনটা আর ভালো লাগছে না কেন জানি। বাসায় ঢুকেই সেই সামিয়ার সাথে পুরাতন খোঁচাখুঁচি কথাবার্তা। রঞ্জু ভেবেছিল তার একারই ভালো লাগছে মিশুককে কিন্তু একদিন সে দেখল তার ফিরতে ফিরতে প্রায় নয়টা অর্থাৎ রাত হয়ে গেছে অথচ এক দোকানের পাশে বেঞ্চিতে বসে আছে মিশুক মেয়েটি। রঞ্জু কাছাকাছি আসতেই সে উঠে দাঁড়ায় ও বলে,
- আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম রঞ্জু ভাই। আজকে এত দেরি করলেন যে?
- এক্সট্রা কিছু ফাইল জমে ছিল ওগুলো রেডি করতেই এত দেরি। তুমি এখনও কী করছো?
- কিছু না, এমনি বসে ছিলাম। ভালো লাগছিলো না, ভাবলাম আপনি তো যাবেনই এ পথে, একসাথে নাহয় যাব।
- কতক্ষণ বসে আছো?
- ঘন্টাখানিক হবে, বেশি না।
- বাসায় চলে যেতে পারতে।
- একদিন দেরি করে গেলে কী আর হবে! চলেন এগোই।
সম্পর্কটা একদিক থেকে আপনি এবং অপরদিক থেকে প্রথমে আপনি ও পরে তুমিতে নেমে এসেছিল রঞ্জুর কারণেই। রঞ্জু যে বিবাহিত এ কথা মিশুক জানে যদিও সামিয়ার সাথে কখনো দেখা হয়নি, কিন্তু রঞ্জুর ফোনে তার ফোটো দেখেছে। দেখে বিশ্বাস করেছে রঞ্জু ভাই মাটির মানুষ এবং তার স্ত্রীও তাই। মিশুকের ওই ভাবনা ভুল প্রমাণ করতেই ভাগ্যবিধাতার এ খেল শুরু হয়েছিল কি? তাদের ভিতরকার স্নায়ুযুদ্ধের মত কিছু একটা চলছে, চলতে চলতে সেটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অবশেষে মনোযোগ বিচ্ছিন্নের পথ বেছে নিয়েছে এমন একটা ভাব। সংসার চলছে কিন্তু সামিয়ার মন নেই, রঞ্জুরও মন নেই। দু'জনের মতের অমিলগুলো প্রকট হতে হতে একেকটা সুবিশাল বৃক্ষের মত ছায়া ফেলে দিয়েছে নিজেদের মাঝে৷ সেই ছায়ার ভিতর নিজেদের তারা খুঁজে খুঁজে ফিরছে বারবার।
এইসব ভাবতে ভাবতে মাথার ভিতর অদ্ভুত এক যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় রঞ্জুর। তার বাকশক্তি মনে হয় একটু সবল হয়, নার্সকে লক্ষ করে সামান্য শব্দে সে ডাকতে থাকে। নার্স আসে, নার্সের কাছে আবার, এবার মুখেই জিজ্ঞেস করে,
- আমার স্ত্রী সামিয়া কোথায়?
- উনি বাইরে গেছেন কিছুক্ষণ হলো। খাবার ও ঔষধ নিয়ে আসবেন বলে গেলেন।
- কয়টা বাজে এখন?
- আটটা সতেরো। ওই যে ঘড়ি আছে।
বলে নার্স হাতের ইশারায় দূরের দেয়ালে একটা ঘড়ির অবয়ব দেখায়। রঞ্জুর চোখের অত পাওয়ার নাই যে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে, তবুও সে আর কিছু বলে না। কেবল চেয়ে থাকে খসে পড়া প্লাস্টারওয়ালা ছাদের দিকে। বৃষ্টির গতি ততক্ষণে আরও বেড়েছে যার ফলে বৃষ্টির ছাঁট আসতে থাকে জানালা দিয়ে, গায়ে অনুপম এক প্রশান্তির মত লাগে সামান্য সেই ভাঙা ফোঁটাগুলো। তার ঘুম ঘুম ভাবটা এতক্ষণে উধাও হয়ে গেছে।
এরপর সে দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অল্পক্ষণ, এরইমধ্যে দেখে খুব চেনা চেনা একজন। ঝাপসা। কাছাকাছি আসতেই রঞ্জু চিনে ফেলে তাকে। মিশুক মেয়েটি। নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে কোনোভাবে তাই ছুটে এসেছে। প্রথমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, পরে রঞ্জুর চোখে চোখ পড়তেই দ্বিধা কেটে গেল। শশব্যস্তে এসে দাঁড়াল বেডের পাশে, চোখেমুখে উৎকণ্ঠার উচ্চ পারদ। বলল,
- কী হইছে আপনার রঞ্জু ভাই?
রঞ্জু তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না মিশুক চলে আসার ঘটনাটি। না-কি সে কোনো ঘোরের ভিতর চলে গেছে, স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন! না, স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই মারিয়া রহমান মিশুক তার বেডের একপাশে বসেছে এবার। রঞ্জুর তাই বাকরুদ্ধ অবস্থা আবারও ফিরে আসছে। ব্যতিব্যস্ত মিশুক আবারও জিজ্ঞেস করে,
- কী হইছে আপনার? কেমনে এক্সিডেন্ট করলেন?
রঞ্জু তখন ক্ষীণ কণ্ঠটি ধীরে ধীরে ফিরে পায় এবং সামান্য শব্দে বলতে থাকে,
- বাথরুম থেকে বের হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই।
- ইশশ! ভাবী কোথায়? কাউকে দেখছি না কেন? আপনার সাথে কে আসছে?
বলে আশেপাশে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাতে থাকে মিশুক। কতগুলো লোকের পায়চারির মধ্যে চেনাজানা কাউকে সে দেখতে পায় না।
- সামিয়া আসছে। সে একটু বাইরে গেছে না-কি। চলে আসবে। তুমি জানলা কেমনে আমি হাসপাতালে?
- জহির (রঞ্জুর সেই বন্ধু, যার বান্ধবী মিশুক) বললো। থাক আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকেন। কথা বলতে কষ্ট হইতেছে আপনার।
তিন. আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
যখন রাত প্রায় নয়টা, রঞ্জুর পাশে নির্বিকার বসে আছে মারিয়া রহমান মিশুক, যখন হাসপাতালের পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করেছে, আর যখন থেমেছে বৃষ্টি; তখন আকস্মিক এসে পৌঁছায় সামিয়া হক, তার হাতে অনেকগুলো ঔষধের একটি ঠোঙা, এবং সে একা নয়; একজন অপরিচিত পুরুষ তার সাথে। রঞ্জুর পাশে বসা মেয়েটিও তো অচেনা যে এইমাত্রই তাদের দেখে অপ্রস্তুত ভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। ফলে ওখানকার চারজোড়া চোখই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় পরস্পরের দিকে। লোকটাকে দেখে মিশুকের চেনা চেনা লাগে। পরক্ষণেই মনে পড়ে বাসে দেখা সেই লোকটা যে তার পার্স ফেলে আসা খেয়াল করেছিল। সে কি চিনেছে মিশুককে? মিশুক মনে করে তার পরিচয়ই আগে দেয়া উচিত এবং সে নিজেকে রঞ্জুর বন্ধু বলে সংক্ষেপে পরিচয় দেয়; মিথ্যা কিছু বলে না। সামিয়া হয়ত আরও ডিটেইলস আশা করছিলো কিন্তু ততক্ষণে নার্স এসে পড়ায় নানারকম ব্যস্ততা বাড়ে, সামিয়া নার্সের সাথে যায় ডাক্তারের সাথে দেখা করতে৷ ওই লোকটা দাঁড়িয়ে থাকে, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মিশুকও। সে হয়ত মিশুককে অতটা খেয়াল করেনি। রঞ্জু ওদের ধীরকণ্ঠে বলে বসতে। লোকটা পাশে রাখা একটা টুলে বসতে বসতে বলে,
- আমি নাগিব নওয়াজ। সামিয়ার কলিগ। আপনার কথা অনেক শুনেছি সামিয়ার মুখে। আজকে এরকম বিপদ শুনে আর থাকা গেলো না, চলেই এলাম দেখতে। কেমন লাগছে এখন?
- নড়াচড়া না করলে ব্যথা লাগছে না অত।
- আচ্ছা।
শোকে না অনভ্যস্ততায়, কারোরই আর কথা এগোয় না। তিনটি প্রাণী বোবা হয়ে থাকে ডাক্তার না আসা পর্যন্ত।
ডাক্তার এলেও বা কী, প্রেসক্রিপশনে দ্রুতহাতে কিছু লিখে ও নার্সকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে চলে যান তিনি। সামিয়ার মুখ থমথমে হয়ে আছে। এরপরও কয়েকজন মিলে বিভিন্ন কথা হয়, কীভাবে কী হলো না হলো। রঞ্জুকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, যেন তার অসুখ অত গুরুতর কিছু নয়। তবুও অস্বস্তিটা কাটে না কারোরই। সামিয়ার কথাগুলো কাটা কাটা শোনায়, মিশুক থাকে নিস্প্রভ আর নওয়াজ জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়। একসময় দোতরফা তর্কাতর্কি লেগে যায় অসুস্থ রঞ্জুর সাথে সামিয়ার। রঞ্জুর মন অস্থির হয়ে ওঠে, খুঁতখুঁত করে। তার মনে হয় আজ রাতেই বীভৎস কোনো নাটকের অবতারণা ঘটবে কারণ তাদের মধ্যকার লুকায়িত ঝামেলাগুলো কী অবলীলায় সবার সামনে বলে বলে রঞ্জুকে সামিয়া কতই না দোষারোপ করছে! রঞ্জুর সব কথার প্রতিউত্তর দেয়ার ক্ষমতা নাই, ইচ্ছাও নাই, কারণ তার সামিয়াকেই মনে হয় বিদগ্ধ, বিরক্তিকর এবং টক্সিক। এমনকি মিশুককে ইঙ্গিত করেও অনুমানে খোঁচা দিয়ে বসে সামিয়া। তখন মিশুক কী বলবে? সে চলে যাবে ভাবে আবার এ-ও ভাবে চলে গেলে রঞ্জুর অসহায়ত্ব, নিজের স্ত্রীর কাছেও সে যে একা হয়ে পড়বে! মিশুক পূর্ববৎ চুপই থাকে অতঃপর। লজ্জায় অবনতমস্তক আর তুলতে পারে না। এরকমই চলে ঘন্টাদুয়েক, অতীতের সমস্ত আমলনামা একে-অপরের সামনে আসে। ঘুর্ণিঝড়ের বাতাস যেমন দমকে দমকে এসে দূর্বল করে দিতে থাকে বৃক্ষের শেকড়গুলো এবং একপর্যায়ে উপড়ে ফেলে, অমনই পরিস্থিতি তৈরি হয় ক্রমেই। একসময় সামিয়া চুপচাপ হয়ে পড়ে, কী যেন ভাবে বিড়বিড় করে। শেষে বলে ওঠে,
- থাকো তুমি তোমারে নিয়া। আর তোমার যা ভালো লাগে। তোমার সাথে আমার আর কিচ্ছু সম্ভব না রঞ্জু।
হাসপাতালের এই দূষিত বাতাসের ভিতরে তাদের সমস্ত বাক্যগুলো দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে প্রত্যেকের কাছে, আর থাকা যায় না। সামিয়া উঠে পড়ে, সাথে নওয়াজও। গলার স্বর একটু নেমে আসে সামিয়ার; বলে,
- আমারে মাফ করো প্লিজ। আমি আর পারলাম না।
ওদের নিষ্ক্রান্ত পথের দিকে রঞ্জু আর ফিরেও তাকায় না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মিশুকের দিকে; যে এতক্ষণ এতকিছু সহ্য করে বসে ছিল। হঠাৎই এক শীতল ছায়া নেমে আসে তাদের মুখের ওপর, খোলা জানালাপথে আগত হাওয়ায় চোখেমুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম শুকিয়ে যেতে থাকে উভয়ের; নিশ্চুপ, নিস্প্রভ দুই পাখি। নার্স দূর থেকে দেখেছে হয়ত কিছুটা এই রঙ্গলীলা, দেখে কাছাকাছি আসেনি। এখন সে আসে, স্যালাইন বদল করে, ঔষধ খাইয়ে চলে যায় আবার। রঞ্জুর চোখের সামনে পৃথিবীটা কেমন দুলছে। এই বৃষ্টিমুখর রাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার সমস্ত উপায় হারাতে হারাতে তার জ্ঞান লোপ পেতে থাকে।
হাসপাতালের ওই সাদা বেডের ওপর মুহ্যমান তারা পড়ে থাকে যেন অনন্তকাল ধরে, একজন জীবিত, অন্যজন অর্ধমৃত।