আলাদিনের চেরাগ আরব্য রজনীর গল্প রোশনাই করে রেখেছে। যুগে যুগে ওই রূপকথার গল্প পড়ে আবাল বৃদ্ধ বণিতা আপ্লুত হয়েছে। সেই চেরাগের দৈত্য যে এই কালে বাংলাদেশের কারো বন্ধু হয়ে যাবে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে না দেখলে জানাই হতো না।
আমাদের উপমহাদেশের মানুষ বংশ পরম্পরায় দুর্নীতিবাজ। এজন্য হার্মাদ, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা আমাদেরকে শোষণ করে মজা লুটতে পেরেছে। নৈতিকতার সাধুতায় বলিয়ানদেরকে সহজে পরাস্ত করা যায় না। যে দেশে ঘরে ঘরে এত বিভীষিকাময় বিভীষণের বসবাস সে দেশে শুভবোধ ফিরতে পারে না।
মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি করে তাই বলে এতটা? একজন বেতনভোগী সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া, সারাদেশে জমি, পার্ক, কারখানা বা রিসোর্ট দখল। তুরস্ক বা স্পেনে সেকেন্ড হোম বানানো -এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। ইতোপূর্বে কোনো পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধানের নামে এমন ভয়াল অর্জনের কথা শুনিনি আমরা। এদেশে ব্যাংক লুট করে বিদেশে পালিয়ে থাকা যায়, বিচারহীনতার সুখে আয়েশ করে ঘুমানো যায়। কিন্তু কোনো বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাকে ঘিরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের এমন বিস্তৃত জাল অভিনব ও অভাবনীয়। সারাদেশের যে জায়গায় মিস্টার বেনজীর তাঁর নেক নজর ফেলেছেন সে জায়গাটিই তাঁর হয়ে গেছে। এ যেন ঐশ্বরিক হয়ে যাও বললেই হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। অতঃপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ আওয়ামী লীগের লোক নয় বলে দাবি করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, তাঁরা যদি কোনো অপকর্ম করে, এদের বিচার করার সৎ সাহস শেখ হাসিনা সরকারের আছে।'
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশ কার্যকারিতা শুরুর আগেই সাবেক পুলিশপ্রধান সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। যিনি দুর্নীতিকে রোজকার অভ্যাসে দাঁড় করাতে পাসপোর্ট জ্বালিয়াতিরও আশ্রয় নেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে লাল পাসপোর্টধারী হওয়ার কথা থাকলেও তিনি সবুজ পাসপোর্টেই বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন। সরকারের অনুমতি ছাড়া যাতে সহজে দেশ বিদেশে গমনাগমন করা যায় সেজন্য তিনি বেসরকারি সার্ভিস দেখিয়ে জ্বালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেসরকারি পাসপোর্ট নিয়েছেন যা ফৌজদারি অপরাধ। মুশকিল হলো সরকারি কোনো সংস্থাই তাঁর কাছে এসব অন্যায্য কায়কারবারের জবাবদিহি চায়নি। অথবা ভয়ে চাইতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ বলছে, বেনজীর আহমেদ তাদের লোক নয়। টানা তিন টার্ম আওয়ামী লীগই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তাহলে দেশের আপামর জনসাধারণ সেই দেশের শাসকগোষ্ঠীর না হয় কেমনে? সরকার তো সবার। অভিযুক্ত হয়েও বেনজীর আহমেদ দেশ থেকে ভেগে যেতে পারল, এর দায়ভার সরকারের ওপর বর্তাবে না কেন? চাইলেই একসময়ের আপনজনদের পর করে দেয়া যায়?
রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরষ্কারপ্রাপ্ত বেনজীর আহমেদ দুর্নীতিতে এতটাই আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন যে, তাঁর বদনামে পুলিশবাহিনীর অনেকেই মুখ দেখাতে পারছেন না। বিশ্বাস করি এখনও পুলিশ বাহিনীর হাজারো সদস্য সহজ সরল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করেন। অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন এবং সরকার নির্ধারিত বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয় সেবক হিসেবে সুনাম কুড়ান। এর বাইরে অন্য চিন্তা করেন না। ঠিক এইসব সদস্যদের মাথা হেঁট করে দিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। নেতৃত্বে থাকা একজন মানুষ একাই যদি সব দুর্নীতি করে ফেলেন তাঁর অধস্তনদের মুখ লুকানোর আসলে আর জায়গা থাকেও না। পুলিশের একশ্রেণীর অসাধু সদস্যের নানা কর্মকান্ডে পুরোবাহিনী এমনিতেই ঢালাওভাবে নানা নিন্দামন্দের শিকার হয়। বেনজীর আহমেদের তরফ থেকে এবার যেসব থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ছে তাতে বাহিনীটির ম্যুরাল স্ট্যান্ডার্ড তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর দায়ভার আওয়ামী লীগ গ্রহণ করবে না কেন?
আফ্রিকায় ইউএন মিশনে কাজ করছেন এমন এক মিড লেভেলের ঝানু পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা হলো কাল। তিনি খুব হতাশা প্রকাশ করেই সাবেক পুলিশপ্রধান প্রসঙ্গে বললেন, 'তিনি পুরো বাহিনীর ইজ্জত ধুলিসাৎ করেছেন। যার প্রভাব আমাদের মতো নগণ্য অফিসারদের ওপরও পড়ছে। গ্রামের বাড়িতে বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল দুইতলা বাড়ি করার। গত হাইতি মিশনে গিয়ে নিচতলা করেছিলাম। এবার ভাবছি বাড়ি গিয়ে দু'তলা করব। কিন্তু কষ্টের হালাল টাকায় করলেও লোকজন ভাববে সাবেক পুলিশপ্রধানের মতো টাকা হয়ত আমিও কামাচ্ছি। এই কষ্টের কোনো সীমা নেই। আরেকজনের দুর্নীতির দায় পরোক্ষভাবে হলেও আমাদের ওপর পড়বে।'
বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঘাপটি মেরে আছে বলেই ফি বছর এমন লজ্জাজনক রিপোর্ট আমাদের বিরুদ্ধেই আসে। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা মুখে বলে তাঁরা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এই কি তার নমুনা?
সরকারে থাকা অনেকেই বলছেন, এখন যেসব খবর বের হচ্ছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো আগে কেন তা বের করেনি? এর উত্তর হলো দেশে কি ওই স্ট্যান্ডার্ডের মিডিয়া রাখা হয়েছে যাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট আমলে নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের শোধরে নিয়ে অসাধুতার নীতি বদলাবে? ভয়কাতুরে দেশের গণমাধ্যম না হোক ভয়ডরহীন বিদেশি মিডিয়াতে অতীতে যেসব সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে সেগুলো কি সরকার আমলে নিয়েছে? না নেয়নি। বরং অস্বীকার করবার 'থোড় বড়ি খাড়া- খাড়া বড়ি থোড়' প্রবণতার শাক দিয়ে মাছ ঢেকে গেছে। অথচ এখন অভিযুক্তের ক্ষমতা নেই বলে আগের অভিযোগগুলোরই সত্যতা মিলছে।
পুলিশ প্রধান কিংবা সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে এমনতর নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা কোনো মতেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য ভালো নয়। আর রাষ্ট্রকে সম্মানহানিকর পরিস্থিতিতে ফেলবার প্রধানতম দায়ভার অতি অবশ্যই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ওপরই বর্তায়।
ডিনায়াল কোনো সমস্যার সমাধান করবে না। পরিস্থিতির বাস্তবতার নিরিখে দায়ভার স্বীকার করে নিয়ে আওয়ামী লীগের উচিত হবে আইনের শাসন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দুর্নীতিতে নিমজ্জিতদের মূলোৎপাটন করা। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা এখন একমাত্র আওয়ামী লীগেরই আছে। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সব বদলাতে পারে। নচেৎ যা আছে তাই। নিন্দা, বদনাম, লজ্জা ও ভোগান্তি।
অবকাঠামো উন্নয়ন সবই ভেস্তে যাবে যদি না আমরা মানবিক উন্নয়নে মনোযোগী হই। মানুষের নৈতিক মানের উন্নয়ন না ঘটাই। অগণন দুর্নীতি, অসাধুতা, স্বার্থপরতা, অর্থগৃধ্নুতা, গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার যে মেলবন্ধন ঘটে চলেছে বাংলাদেশে, তাতে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নাম সবার তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পৃথিবীতে আমরা কেউই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে আসিনি। আজকে যিনি ক্ষমতার গরিমায় ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন কালই তার সাড়ে তিনহাত মাটির ঘর পোকামাকড়ের ঘরবসতি হতে পারে। আমরা কেন কিংবদন্তি লেখক লিও তলস্তয়ের 'How Much Land Does a Man Need?' গল্পটি মনে রাখি না?
লেখক: সাংবাদিক
২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ৫ জুন ২০২৪
#দুর্নীতি
#Corruption
#Bangladesh
#শুদ্ধাচার
#sanctity