কুষ্টিয়া সদরের টাকিমারা গ্রামের মুসলিম নামধারীদের হাতে অপমানিত লালন ভক্ত চায়না বেগমের এক স্বজন সমাজের প্রতি সকরুণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, 'সাধু অপমান হইলে কী করে?' সাধুর কপাল তো অপমানের নয়। যারা হৃদয়ে সবসময় দাস্যভাব বজায় রাখেন, কারো কাছে কিছুই চান না, কারো বিরুদ্ধে এতটুকু অভিযোগ পুষে রাখেন না; নির্বিরোধ গোবেচারা তাদেরকে কেন অপমানের ভয়াল আগুন হজম করতে হবে?
স্বামীহারা নির্বিরোধ সাদাসিধা নবতিপর একজন নারী চায়না বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার আগে তাঁকে নসিহত করে গিয়েছিলেন, কোথাও যদি তোমার থাকার জায়গা না হয়, তবে আমার কবরের পাশে ঘর তুলে থাকবা। বাতাসা দিয়ে হলেও সাঁইজির উদ্দেশ্যে নিবেদিত শিরনী করে মানুষকে খাওয়াইবা।
কিন্তু এই নারী তো বুঝতে পারেননি, দেশ বদলে গেছি অনেকখানি। মহাত্মা লালনও শরিয়তপন্থিদের নানা বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। রীতিমতো বাহাস করে নিজের চিন্তা ও দর্শনকে মহাকালের জন্য জাগরিত করে রেখেছেন। সেই লালনকে নিশ্চিহ্ন করা তো যায়ইনি, বরং মিস্টিক কবি লালন এখন বৈশ্বিকভাবেই বহুল চর্চিত।
অথচ আজকের বাংলাদেশ বিশ্বচেতনা থেকে দিন দিন বাইরে ছিটকে যাচ্ছে। ভাবুন তো শুধুমাত্র লালনের তরিকা মানছেন বলে মুসলিমদের পবিত্র প্রার্থনালয় মসজিদ থেকে মাইকিং করে বৃদ্ধা চায়না বেগমের ভিটেমাটি গুড়িয়ে দিয়েছে এলাকার মাতবর ও নব্য হুজুরেরা। এই ঘটনাটি যখন ঘটে তখন চায়না বেগম ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির বাইরে অন্যত্র ছিলেন। মানুষ যদি ন্যূনতম সভ্যও হয়, কারো অনুপস্থিতে পেছন দিয়ে হামলা করে এমনভাবে জানমালের ক্ষতি করতে পারে?
ভুক্তভোগী ওই নারীর দাবি, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধরেরও শিকার হয়েছেন তিনি। এমনকি রাতের আঁধারে সেখানে তাঁকে পেলে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন অভিযুক্তরা। এলাকায় নতুন বাড়ি করা একজন লেবাসধারী হুজুর তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলেও দেন।
ঘটনা গেল ২৬ জুন বুধবার সকালের। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার টাকিমারা গ্রামের এ ঘটনায় কুষ্টিয়া সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযোগে ওই এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এনামুল হক, মাতব্বর মোশারফ হোসেন, আনার মণ্ডল ও সাইদুল হাজির নাম উল্লেখসহ ৪৫-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিধবা চায়না বেগম গণমাধ্যমকে জানান, 'তাঁর স্বামী আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁইজির অনুসারী ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো স্বামীর কবরে মাথা ঠেকিয়ে কাটিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। আমার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, কোথাও জায়গা নাহলে তুমি আমার কবরের পাশেই থাকবা। প্রতিবছর বাতাসার শিন্নি হলেও করবা। তার কথা রাখতেই ঘরখানা তৈয়ার করি। কিন্তু এলাকার লোকজন আমাকে না জানিয়েই সব ভেঙে ফেলেছে।'
চায়না বেগমের বোন জামাই সাধু শাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, 'আমাদের অপরাধটা কী? আমরা সাধু সমাজ কি নিজের জমিতেও আর থাকতে পারব না? আজকে সাধুর ঘর কেন ভাঙা হলো? সাধু সমাজকে কেন অপমান করা হলো? মসজিদে মাইকিং করে লোক জড়ো করে ঘর ভাঙা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।'
একশ্রেণীর এক্সট্রিমিস্ট মুসলিমের সাথে সহজিয়াপন্থি লালন সাধকের মূল পার্থক্য কোথায়? কোথাও দেখা যাবে না সাধুরা কাউকে আক্রমণ করেছেন। অথচ অহরহ ঘটনা আছে মুসলিমরা লালনের অনুসারীদের চুল দাড়ি কেটে দিচ্ছেন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। এমনটা কেন হয়?
এই দেশে সাংবিধানিকভাবে সকল ধর্ম পালনের অধিকার সবার আছে। একজনের কাছে যা একত্ববাদের বিরোধিতা, অন্যজনের কাছে তাই ধর্মাচার। বহুত্ববাদী পৃথিবীতে আমরা তো শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দিয়ে নির্দিষ্ট একটি ধর্মকে রেখে দিতে পারব না। মহান স্রষ্টা চাইলে এটা যখন তখন করতে পারতেন। তিনি চান না বলেই বহুধর্মের মিলিত ফল্গুধারা পৃথিবীজুড়ে বয়ে চলে। কে লালনের অনুসারী হবে, কে মাটির বিগ্রহ পূজা করবে, কে ধর্ম পালন করবে না সেটা দেখবার দায়িত্ব মসজিদের মাইকম্যানদের না। দেশে রাষ্ট্র আছে, সংবিধান আছে, শৃঙ্খলা বাহিনী আছে, ওই বিধিবিধান অমান্য করবার বেআইন যারা হাতে তুলে নেয় রাষ্ট্রীয় কড়া আইন তাদের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হতে হবে।
সভ্য সমাজের বিধান একটাই। ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সর্বমানুষের আছে। তেমনি নির্দিষ্ট একটি ধর্ম না পালন করবার অধিকারও সংরক্ষিত রাখতে হবে। লালন ফকির তৎকালীন মুসলিম সমাজের এমন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই মানবতার জয়গান করে গেছেন। সর্বধর্মের সমন্বয়বাদী তিনি এখন থাকলেও চায়নার ভিটায় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ করতেন না। ভালোবেসে বলতেন, ওরা অবুঝ তাই এমন রাগ দেখাচ্ছে। গৌতম ঘোষের অনন্য বায়োপিক 'মনের মানুষ' দেখে নিলে চোখের সামনে এমন লালনকেই পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রকে আমরা আইন প্রয়োগের কথা বলতে পারি। কিন্তু যারা ঘৃণাবাদের চর্চা করে ক্রমাগতভাবে ইউটিউব ফেসবুকে ভিন্নধর্মী মানুষের প্রতি বিভেদ উস্কে দিচ্ছে, তাদেরকে পাকড়াও করা না গেলে গণমানুষের হিংসা কমানো যাবে না। সাধুর মনকে যদি ইসলাম ধর্মের অনুবর্তী করে মুনশি মৌলভিদের প্রাণ জুড়ায়, সেটি করতে গেলে সবার আগে ভালোবাসা ছড়াতে হবে। যে অন্যের ভিটা বিনষ্ট করে, যে অন্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে চায়; তার পালিত ধর্মকে সাধুরা ভালো বলবে কেমন করে?
আমরা সাধু চায়না বেগমের প্রতি সহমর্মিতা জানানোর পাশাপাশি তাঁর দাবিগুলোর প্রতিও পূর্ণ সংহতি জানাই।
তাঁর স্বামীর ভিটায় তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব নিতে বলব। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশ সমানভাবে তাঁরও। রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা ফকির লালন শাহ'র ফিলোসফি নিশ্চয়ই ভালো জানেন, 'সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।' আমরা সর্বমানুষের সমান সহাবস্থানের সুন্দর বাংলাদেশ চাই। যেখানে বাউলেরা একতারা হাতে সবুজ ধান ক্ষেতের আইল ধরে গাইতে গাইতে নিজের গন্তব্যে ফিরতে পারবেন।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে, তুই মূল হারাবি।
লেখক: সাংবাদিক
২৯ জুন ২০২৪