অবশেষে হরিদাস পাল মারা গেল। মারা যখন গেল তার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তার একটা তুচ্ছ জিনিস নিয়ে হাহাকার ছিলো; নিজের পিঠটা কখনো তিনি দেখতে পারলেন না। খুব ইচ্ছে ছিলো নিজের সাহিত্য ভান্ডারে নিজের পিঠ নিয়ে লেখা একটা কবিতা যোগ করবেন। পিঠময় সে কবিতা থাকবে সকলের মুখে-মুখে, আবৃত্তি করা হবে ইউটিউব চ্যানেলে, ফেসবুক পেইজে- শেয়ার হবে হাজার হাজার। দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও রুচিশীল আবৃত্তিকার দরাজ গলায় পাঠ করবেন সে কবিতা, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে। সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে দর্শকের চা'য়ে ভেজা বিস্কুট টুপ করে পড়বে কাপে, দুয়েক ফোঁটা চা লেগে যাবে সাদা ইস্ত্রি করা শার্টে কিন্তু কারোর চোখে পলক পড়বে না। এসব হরিদাস পালের নিছক কল্পনা নয়, কবি হিসেবে তিনি সেরাদের সেরা। তার লেখা কবিতা গতমাসে রাষ্ট্রপতি সাহেব পাঠ করেছিলেন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পাঠ্যবইগুলোতে ছাপা হয় তার কবিতা।
অবশ্য এসব প্রাইজ, সংবর্ধনা, সাক্ষাৎকার নিয়ে হরিদাস পাল কখনোই অতটা চিন্তিত ছিলেন না। যতদিন না মার্কেটে ঐ লোকটা আসলো, নিজের বের করা প্রথম বইয়ে লোকটা বেস্টসেলার হয়ে গেল? বইমেলার ভিড়ে দু'চারজন তরুণ-তরুণী গল্প করছিলো, হরিদাস পাল সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন। ওদের কথাবার্তা তার ভালো লাগলো, পাশে বসলেন ১০০ গ্রাম বাদাম নিয়ে। তরুণদের গ্রুপের কেউ তাকে চিনলো না। কারণ ততদিন সবাই হরিদাস পালের কবিতা চেনে, হরিদাস পালকে নয়। হরিদাস পাল ততদিন পর্যন্তই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন জনতার কাছ থেকে। আড়াল থেকে ছেলেমেয়েদের গল্পের বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করলেন। এবং পরিশেষে তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন যে কবিতার বই নিয়ে এত আলোচনা তা আসলে হরিদাস পালকে ঘিরে নয়, নতুন একজনকে ঘিরে, ঐ লোকটা। সুকৌশলে লোকটার স্টল নম্বর জেনে নিলো হরিদাস পাল, পৌঁছালেন নির্দিষ্ট স্টলে। তবে স্টলের কাছে যাওয়া গেল না। দূর থেকে দেখা গেল একজন কুৎসিত দেখতে বেঁটেখাটো লোকটাকে ঘিরে স্টলের সামনে জনস্রোত। সবাই বই কিনছে, ছবি তুলছে আর আপলোড দিচ্ছে। অজানা এক ভয়ে অথবা শঙ্কায় হরিদাস পালের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।
মুহূর্তেই তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, নিজের প্রকাশককে জানালেন তিনি নিজেও প্রকাশিত হবে, পাঠক এবং জনগণের কাছে। প্রকাশক অবাক হওয়ার পরমুহূর্তেই, খুশিও হন।
হরিদাস পাল লোকটার একটা কবিতার বই কখনও পড়েন নি, দেখেনও নি। খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেছেন কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে, কখনো কথাও হয় নি তবুও হরিদাস পাল নিশ্চিত যে ছোটখাটো ঐ কুৎসিত দেখতে লোকটার কোনো লেখাই ঠিক কবিতা হয় না। যদিও হয় তার জন্য এত আয়োজন, শ্রদ্ধা বোধের কোনো উপলক্ষ্য খুঁজে পান না হরিদাস পাল।
সেই বইমেলা, তারপর কেটে গেছে বিশটি দীর্ঘ বছর, বেড়েছে দীর্ঘশ্বাস, জেগেছেন দীর্ঘ রাত, লিখেছেন অজস্র কবিতা। কিন্তু মনের কোণের শঙ্কাটা কখনোই দূর হয় নি। অবশেষে আজ সকালে তার ঘনিষ্ঠজনদের সমানে, মৃত্যুশয্যায় থেকে হরিদাস পালের মনে হল গত বিশটি বছর কোন বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিলো তার কবিতা, মনে হল গত বিশ বছরে নিজের জন্য ও নিজেকে ভালোবাসে তিনি একটি শব্দ পর্যন্ত লিখতে পারেন নাই। সব কবিতা, লাইন, অনুভূতি ছিলো ঐ কুৎসিত দেখতে বেঁটেখাটো লোকটা ছাড়িয়ে যেতে। দুঃখে হরিদাস পালের চোখের কোণে অশ্রু জমলো, সেই অশ্রুতে হৃদয় ভিজে গেল তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। অথচ তারা জানলো না হরিদাস পালের দুঃখ হচ্ছে, নিজের জন্য একটা লাইন লেখতে, একটা কবিতা লেখতে যে কবিতা ছড়িয়ে যাবে দেশ-দেশান্তরে। অথচ নিজের পিঠটাই কখনো দেখা হল না হরিদাস পালের! খুব ইচ্ছে হচ্ছে নিজের পিঠটায় আদর করে দিতে, একবার যদি পারতেন পিঠটা খুলে জড়িয়ে ধরতেন দু'হাতে আদর করতে!
অবশ্য এসব প্রাইজ, সংবর্ধনা, সাক্ষাৎকার নিয়ে হরিদাস পাল কখনোই অতটা চিন্তিত ছিলেন না। যতদিন না মার্কেটে ঐ লোকটা আসলো, নিজের বের করা প্রথম বইয়ে লোকটা বেস্টসেলার হয়ে গেল? বইমেলার ভিড়ে দু'চারজন তরুণ-তরুণী গল্প করছিলো, হরিদাস পাল সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন। ওদের কথাবার্তা তার ভালো লাগলো, পাশে বসলেন ১০০ গ্রাম বাদাম নিয়ে। তরুণদের গ্রুপের কেউ তাকে চিনলো না। কারণ ততদিন সবাই হরিদাস পালের কবিতা চেনে, হরিদাস পালকে নয়। হরিদাস পাল ততদিন পর্যন্তই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন জনতার কাছ থেকে। আড়াল থেকে ছেলেমেয়েদের গল্পের বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করলেন। এবং পরিশেষে তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন যে কবিতার বই নিয়ে এত আলোচনা তা আসলে হরিদাস পালকে ঘিরে নয়, নতুন একজনকে ঘিরে, ঐ লোকটা। সুকৌশলে লোকটার স্টল নম্বর জেনে নিলো হরিদাস পাল, পৌঁছালেন নির্দিষ্ট স্টলে। তবে স্টলের কাছে যাওয়া গেল না। দূর থেকে দেখা গেল একজন কুৎসিত দেখতে বেঁটেখাটো লোকটাকে ঘিরে স্টলের সামনে জনস্রোত। সবাই বই কিনছে, ছবি তুলছে আর আপলোড দিচ্ছে। অজানা এক ভয়ে অথবা শঙ্কায় হরিদাস পালের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।
মুহূর্তেই তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, নিজের প্রকাশককে জানালেন তিনি নিজেও প্রকাশিত হবে, পাঠক এবং জনগণের কাছে। প্রকাশক অবাক হওয়ার পরমুহূর্তেই, খুশিও হন।
হরিদাস পাল লোকটার একটা কবিতার বই কখনও পড়েন নি, দেখেনও নি। খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেছেন কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে, কখনো কথাও হয় নি তবুও হরিদাস পাল নিশ্চিত যে ছোটখাটো ঐ কুৎসিত দেখতে লোকটার কোনো লেখাই ঠিক কবিতা হয় না। যদিও হয় তার জন্য এত আয়োজন, শ্রদ্ধা বোধের কোনো উপলক্ষ্য খুঁজে পান না হরিদাস পাল।
সেই বইমেলা, তারপর কেটে গেছে বিশটি দীর্ঘ বছর, বেড়েছে দীর্ঘশ্বাস, জেগেছেন দীর্ঘ রাত, লিখেছেন অজস্র কবিতা। কিন্তু মনের কোণের শঙ্কাটা কখনোই দূর হয় নি। অবশেষে আজ সকালে তার ঘনিষ্ঠজনদের সমানে, মৃত্যুশয্যায় থেকে হরিদাস পালের মনে হল গত বিশটি বছর কোন বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিলো তার কবিতা, মনে হল গত বিশ বছরে নিজের জন্য ও নিজেকে ভালোবাসে তিনি একটি শব্দ পর্যন্ত লিখতে পারেন নাই। সব কবিতা, লাইন, অনুভূতি ছিলো ঐ কুৎসিত দেখতে বেঁটেখাটো লোকটা ছাড়িয়ে যেতে। দুঃখে হরিদাস পালের চোখের কোণে অশ্রু জমলো, সেই অশ্রুতে হৃদয় ভিজে গেল তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। অথচ তারা জানলো না হরিদাস পালের দুঃখ হচ্ছে, নিজের জন্য একটা লাইন লেখতে, একটা কবিতা লেখতে যে কবিতা ছড়িয়ে যাবে দেশ-দেশান্তরে। অথচ নিজের পিঠটাই কখনো দেখা হল না হরিদাস পালের! খুব ইচ্ছে হচ্ছে নিজের পিঠটায় আদর করে দিতে, একবার যদি পারতেন পিঠটা খুলে জড়িয়ে ধরতেন দু'হাতে আদর করতে!