নব্বই দশকে (সঠিক সাল মনে নেই, ১৯৯৬ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি)। ঈদের পরের সন্ধ্যা। কোন ঈদ, সেটাও স্মৃতিতে স্পষ্ট না। তবে সে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা এখনো স্মৃতিতে কাঁচের মতো স্বচ্ছ। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার নূর মসজিদের রাস্তার পাশেই বসে ছিল ফুচকার ভাসমান দোকান। সেখানে বসে কাজিনদের সঙ্গে চটপটি খাচ্ছিলাম। ঠিক সে সময় হাজীপাড়া থেকে ভেসে আসা হট্টগোল টের পেলাম। পুরো ঘটনা তখনো ঠিকমতো বুঝলাম না, শুধু শুনলাম গোলাগোলি হয়েছে আশেপাশেই কোথাও। এ রকম গোলাগোলি তখন নিত্যকার ঘটনা। ঢাকার ওই এলাকা (মগবাজার-ইস্কাটন-রমনা) নিয়ন্ত্রণে তখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে লিয়াকতের ফাইভ স্টার এবং সুব্রত বাইনের সেভেন স্টার গ্রুপের মধ্যে! সেই রাতে বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম, মধুবাগ-মিরবাগে সুব্রত হামলা চালিয়েছে। এর একটা গুলি এসে লেগেছিল আমার নানাবাড়ির জানালার কাঁচে। নানাবাড়ির দিক থেকে একটা ঘটনাবহুল পরিবারে জন্ম নেওয়ায় দুর্ভাগ্যবশত আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছিল এইসব ঘটনার অস্পষ্ট সাক্ষী হিসেবে। আট-নয় বছর বয়সের সেসব ঘটনা এখন আর অত বেশি মনে নেই। যত বড় হয়েছি, তত সেইসব স্মৃতির অস্পষ্টতা একটু একটু করে পরিষ্কার হয়েছে কিংবা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা তৈরি করতে পেরেছি। রাজনীতি আর সন্ত্রাস...ক্ষমতা লাভের দুই প্রধান অস্ত্র!
১৯৯৬-'৯৭ এর সেইসব স্মৃতি আজকে হুট করেই বারবার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। এর অন্যতম কারণ রায়হান রাফী নির্মিত "তুফান"। তুফানে দুষ্টু কোকিল গানটার সময় পর্দায় ভেসে ওঠেছিল ইস্কাটন ক্লাবের নাম, সেখান থেকেই স্মৃতি খুঁড়ে নব্বই দশকের ঢাকার গ্যাংস্টারদের নাম মনে পড়লো। তুফানের ট্রেইলার মুক্তির পর থেকেই সিনেমাটি বেশ জোরেশোরে হাইপ তুলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এলেই " দুষ্টু কোকিল" আর "লাগে উড়াধুরা" র অরজিনাল ভিডিওসহ নানা রকম রিলস দেখা যাচ্ছে। এর আগে রাফীর "সুড়ঙ্গ" দেখেছিলাম। "পরাণ" দেখতে যাবো ভেবেও যাইনি। কাহিনী শোনার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। "পরাণ" আর "সুড়ঙ্গ" দুইটার কাহিনীই আমার নারী বিদ্বেষী মনে হয়েছিল। এটা অবশ্য যার যার সাইকোলজি। কেউ সেটা হলেও তো অন্যের সেখানে কিছু করার নেই, এবং কেউ সেটা ক্যাশ করে সাহিত্য, গল্প-সিনেমা যা কিছু মন চায় করলেও কিছু বলার নেই। যেকোনো সৃষ্টিই যদি সুন্দর হয়, তবে এর অন্যান্য বিষয় নিয়ে কেউ অতটা মাথা ঘামায় না। তবে রাফী বোধহয় তার সেই নারী বিদ্বেষী ট্যাগের বাইরে বের হতে পারলেন তুফানের মাধ্যমে। নিজেকে ভাঙার খেলায় অবশ্যই তিনি সফল হয়েছেন, নিঃসন্দেহে নির্মাতা হিসেবে রাফী সফল হয়েছেন আরো অনেকগুলো ক্ষেত্রেই।
ট্রেইলার দেখার পরই যে আমার তুফান দেখার প্রতি আগ্রহ হয়েছে, এমনটা একদমই না। বরং অ্যানিমেলের রণবীর কাপুরের লুকের সঙ্গে তুফানের শাকিব খানের সাদৃশ্য থাকায় আশঙ্কা করেছিলাম, কপি কি না। তবে বলতেই হবে, তুফানের যে দুটো গান ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে, দুটো গানই এ কয়দিন আনকনসাশলি অথবা বহুবার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শোনার কারণে আমি নিজেও কয়েকবার গুন গুন করেছি। এই গান দুইটার জন্য কিংবা প্রথমবারের মতো শাকিব খানকে এত এট্রাকটিভ লাগার কারণে হলেও তুফান হয়তো দেখতাম, তবে সেটা আরো কিছুদিন পরে। আজকে সকাল ১১:২০ এ যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টারে তুফান দেখা হলো মূলত আমার পুত্রের পীড়াপীড়িতে। গত রাত একটায় তার হঠাৎ মনে হলো, তুফান দেখবে। এক ঘণ্টা লেগে গেল টিকেট খুঁজতে। সিনেপ্লেক্সে সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা কোনো বেলারই কোনো টিকেট আগামী তিন দিনের জন্য খুঁজে পেলাম না। বাধ্য হয়েই ব্লকবাস্টারে সকালের দুইটা টিকেট কাটতে হলো। সেখানেও বিকাল-সন্ধ্যায় টিকেট নেই। যদিও হলে ঢুকে ভিন্ন চিত্র দেখতে হলো। প্রথম পাঁচটা সারিই ছিল ফাঁকা। সম্ভবত সকালে বৃষ্টি হওয়ার কারণেই এমনটা হবে। নির্ঘুম রাত আর বৃষ্টির মধ্যে এক ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকার পরও পপকর্ন হাতে নিয়ে বেশ ফুরফুরা মেজাজেই যমুনার মন্টেজ হলে ঢুকলাম। ব্লকবাস্টারে এবারই আমার প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা।
তুফান মোটেও কাটপিস কোনো সিনেমা নয়। যারা এ দাবি তুলেছেন, তাদের দাবি সঠিক বলে আমি মনে করি না। তবে তুফান দেখতে গেলে অ্যানিমেলের রণবীর কাপুরকে এক দুই দৃশ্যে মনে পড়তে পারে। বরং ঘটনার দিকে নজর দিলে নব্বইয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদল, সে সময়ের মাফিয়া রাজত্ব, ঢাকার চলচ্চিত্রে মাফিয়াদের সংশ্লিষ্টতা, অভিনেত্রীদের সঙ্গে মাফিয়াদের ঘনিষ্ঠতা এবং এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডের সাদৃশ্যতা পাওয়া যাবে। এসবই এ দেশের ঘটনা। এগুলোকে নিয়ে রাফী তার নিজের মতো করেই একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন, যেখানে সিনেমাটোগ্রাফির কাজ ছিল অসম্ভব ভালো। ভিএফএক্সের কাজও। এর আগে আমি এরকম ভিএফএক্সের কাজ এখানে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, ফলে অবশ্যই এটা প্রশংসার দাবিদার। এ রকম সুন্দর কস্টিউমের কাজ দেখার স্মৃতিও আমার মনে পড়ছে না। এ দেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইনিং সেন্স খুব একটা সুখকর নয়। বিজিএমে আরাফাত মহসিন নিধি ফাটাফাটি। নিধি বরাবরই তার কাজে প্রশংসনীয়, এটা তাই প্রত্যাশিতই ছিল। তুফানের ওভার অল মিউজিকই ভালো। গানগুলো পুরো সিনেমাকেই অন্য মাত্রা দিয়েছে। শাকিব খান এক কথায় দুর্দান্ত! তিনি সুদর্শন, সে নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সুদর্শন, সুঅভিনেতা এবং আকর্ষণীয়- এই তিনটা বিষয়ে পার্থক্য অনেক। সব সুদর্শন অভিনেতাই সুঅভিনেতা এবং আকর্ষণীয় নন। ফলে যে সুদর্শন অভিনেতা অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করতে পারেন না এবং যাকে দেখলে আমার আবার দেখতে ইচ্ছে করবে না, সেসব সুদর্শন অভিনেতায় আমার আগ্রহ নেই। এ কারণেই হবে হয়তো, আমি শাকিব খানের সিনেমার দর্শক না, তার ভক্তও না। নির্মাতা হিসেবে রাফী অসাধারণ একটি কাজ এখানেই করেছেন। উনি সুদর্শন শাকিব খানকে দিয়ে শুধু অভিনয় না, অ্যাটিটিউডও বের করে এনেছেন, আকর্ষণীয় হিসেবে পর্দায় উপস্থাপনও করেছেন। এই অসাধারণ সাফল্যের জন্য তাকে স্যালুট জানাই।
এত ভালো ভালো দিক নিয়ে বলার পরও কেন তুফান আমার ভালো লাগলো না? আমি জানি না কতজনের আমার মতো ভালো লাগেনি বা আমার মতো ভাবার পরে ভালো লাগেনি। অসংখ্য মানুষের ভালো লেগেছে, আমি তাদের ভালোলাগার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই লিখতে চাই যে চিত্রনাট্য আর সংলাপ ছিল অত্যন্ত দুর্বল! আমি একজন লেখক বলেই হয়তো আমার এখানে দুর্বলতাগুলো চোখে পড়েছে। নাহলে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পথে এই আমিই তুফানে উড়ে গেলাম বলে স্ট্যাটাস দিতাম। না দিতে পারায় দুঃখটা আমারই লাগছে। একটা সিনেমার ক্ষেত্রে ডায়লগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আফসোস যে তুফানে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ডায়লগই নেই! অথচ আমি এখনো খলনায়কের "হার খলনায়ক মে এক নায়ক ছুপা হুয়া হোতা হ্যায়", অথবা দ্য গডফাদারের " নেভার হেইট ইউর এনিমি, ইট এফেক্টস ইউর জাজমেন্ট" কিংবা বাস্তবের "মুম্বাই পে রাজ কারতা হু...রাজ", " ট্রিগার দাবায়া অউর খেল খাল্লাস" এর মতো সংলাপগুলো মনে করতে পারি, মনে করতে পারি এর সিকোয়েন্সগুলোও। শাকিব খান, চঞ্চল চৌধুরী, মিশা সওদাগর, গাজী রাকায়েত, ফজলুল রহমান বাবু, সালাউদ্দিন লাভলু অথবা সুমন আনোয়ারের মতো নাটক, সিনেমা আর মঞ্চের এত বড় বড় শক্তিমান অভিনেতাদের কাস্ট করার পরও রাফী কেন তুফানে একটাও শক্তিশালী সংলাপ সৃষ্টি করতে পারলেন না? আমার কাছে অন্তত এটা একটা ব্যর্থতা, দুর্ভাগ্যজনকও। চিত্রনাট্যের দুর্বলতা নিয়ে লিখতে গেলে এই লেখা বিশাল বড় হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে এত পর্যাপ্ত সময় নেই বলেই এই অংশটা নিয়ে কিছু লিখতে পারলাম না। শুধু বলবো, এই সিনেমা আরো অনেক বেশি ডিটেইলিং ডিমান্ড করে। সেখানে ফাঁক রয়ে যাওয়াতে তুফান দেখে আমাকে কিছুটা হতাশই হতে হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল বলেই হতাশাও আছে। সুড়ঙ্গ দেখার সময় প্রত্যাশা ছিল না বলে হল থেকে ফুরফুরে মেজাজে বের হতে পেরেছিলাম।
আরেকটা শেষ কথা লিখতেই হবে। যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বলেই কি এতে ভারতীয় শিল্পীদের এত আধিক্য? নাকি সিনেমার লোকেশনের সুবিধার্থে তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে, আমি জানি না। যে কারণেই হোক না কেন, যে নির্মাতা শাকিব খানের লুক থেকে শুরু করে অভিনয়ে এমন ড্র্যাস্টিক চেঞ্জ আনতে পেরেছেন, তিনি কেন তার ভারতীয় শিল্পীদের বাংলাদেশের বাংলা ভাষাটা ভালো করে প্র্যাক্টিস করালেন না? যেহেতু গল্পের প্লট বাংলাদেশ তথা ঢাকার, রাফী কি কলকাতার বাংলা আর ঢাকার বাংলার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না? তুফান ভালো না লাগার ক্ষেত্রে ভাষাগত এই অসামঞ্জস্যতা সবচেয়ে বেশি দায়ী। এত বিগ বাজেটের একটা সিনেমায় এ রকম অসঙ্গতি মেনে নেওয়া যায় না। এডিটিংয়ে গিয়েও কি এই খাপছাড়া বিষয়টা তার চোখে পড়েনি? খুবই হতাশাজনক ঘটনা!
শাকিবের পাশাপাশি চঞ্চল চৌধুরীও তার জায়গায় ভালো কাজ করেছেন। উনি ভালো অভিনেতা, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে মাঝে মাঝে কিছু কাজে তার অতি অভিনয়ও দেখতে পাওয়া যায়, তুফানে সেটা খুব একটা নেই। মিমি আর নাবিলাও ভালো। যদিও স্ক্রিপ্টে তাদের খুব একটা অংশগ্রহণ নেই। বিশেষ করে নাবিলার। তাকে আরো কিছুক্ষণ স্ক্রিণে রাখা যেত চাইলে। গাজী রাকায়েত পুরোটা সময়ই ভালো ছিলেন। ফজলুল রহমান বাবুকে চাইলে আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যেত। কী কী করা যেত, এমন লিস্ট করলে অনেক কথাই বলা যাবে আসলে। তবে তুফান যা যা করতে পারলো, সেটাকেও কম সাফল্য বলে মনে করছি না। শেষ দৃশ্যে তুফান-২ আসার আভাস পাওয়া গেল, আশা করছি সেখানে এই ত্রুটিগুলো শুধরে রাফী আরো ভালো কাজ নিয়ে আসবেন, নিজেকে উৎরাবেন।
তুফানের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, হল থেকে বাসায় ফেরার পথে পুরোটা সময়ই আমার শাকিব খানকে বলতে ইচ্ছে করেছে, তুমি কোন শহরের পোলা গো, লাগে উড়াধুরা! হি ইজ সুপার্ব ইন হিজ "তুফান" ক্যারেক্টার। তার আরেকটি চরিত্র শান্তকে আমার এভারেজ মনে হয়েছে, শাকিব খান অন্যান্য সিনেমায় যেমন থাকেন। তুফান চরিত্রটা ডিফরেন্ট, জাস্ট অন্য লেভেলের! ভালো কথা, তুফানের পরা একটা সাদা শার্ট আমার ব্যাপক পছন্দ হয়েছে। ডায়লগ শোনা বাদ দিয়ে আমি শার্টটা দেখছিলাম খুটিয়ে খুটিয়ে। যাই হোক, সবশেষে তুফান টু এর জন্য অগ্রীম শুভ কামনা জানিয়ে রাখলাম।