পোস্টস

সমালোচনা

তুফানঃ ব্লকবাস্টার সিনেমার কি কোন দায় থাকে?

১ জুলাই ২০২৪

ফারহান আবিদ

মূল লেখক ফারহান আবিদ

ধরেন আজকে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল ৭০ রানে অল আউট হয়েছে। আমরা সবাই স্বাভাবিক ভাবেই আপসেট। এবং এই আবেগটা আমাদের মনে হবে (এবং আদতেও) বহু প্রাচীন। আবার আমরা জিম্বাবুয়ে বা আফগানিস্তানকে সিরিজ হারিয়ে, মূলত সেই আবেগটাকে রিনিউ করাই। আমাদের বাংলা সিনেমার অবস্থাও ঠিক একই রকম। ঢাকা শহরের সিনেপ্লেক্স বাস্তবতায় ২০০৯এ মনপুরা ২০১৬তে আয়নাবাজি, এই হল আমাদের টেবিল টার্নার সিনেমার সংখ্যা এবং তার ফ্রিকোয়েন্সি। ২০২৪এ এসে তুফান কি জিম্বাবুয়ে বা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা সিরিজ মনে হচ্ছে? না, হ্যাঁ, কনফিউজড? চলুন, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি।


 

২০২৩এর হলিউড ব্লকবাস্টার সিনেমা বার্বি, দি সুপার মারিও, ওপেনহাইমার, গার্ডিয়ান্স অফ দা গ্যালাক্সি ভলিউমঃ৩ এবং আরও দশটা নাম নিলেও হলিউডের গল্পটা বদলে যাবে না। জনরার বৈচিত্র্য, সিনেমার ব্যাপ্তি, স্টোরি লেআউট, স্টোরি টেলিং, লজিক, প্রগ্রেশন, স্ক্রিপ্ট ক্রাফটিং, ডিরেকশন, প্রোডাকশন ডিজাইন, অভিনয়, পোস্ট প্রোডাকশন কোন জায়গায় তারা তাদের মুনশিয়ানা দেখাতে ভুল করেন না। তাদের একটা নিজস্ব প্যারামিটার তারা সব কাজেই মেনটেইন করেন। আবার ধরেন ঠিক এতখানি আপ্লুত না হলেও চলে, যখন মেইন স্ট্রিম হলিউড নিয়ে কেউ কথা বলবেন। মেইন স্ট্রিম হলিউডের সাথে বলিউডের কোথাও পার্থক্য নেই, শুধুমাত্র প্যাকেজিং ছাড়া। কিন্তু, এইযে হলিউড মেইন স্ট্রিম, এর সাধারণ প্যারামিটার প্র্যাকটিস কি আমরা চাইলেই করতে পারি না? ধরেন স্ক্রিপ্টে, নির্দেশনায়অভিনয়ে? অন্তত যেই সমস্ত জায়গায় কাজ করতে চাইলে, করা সম্ভব? যেই সমস্ত কাজ করতে গেলে অজুহাত না দিলেও চলে? যেই হলিউড মেইন স্ট্রিমের কথা বললাম বলিউডও তাদের মতোই, প্রতিটা কাজ অর্গানাইজড, ভাবনার জায়গা থেকে সর্টেড, এগজিকিউশনে ডিস্টিংক্ট, অসাধারণ ডিসিপ্লিন, কন্টিনিউয়েশন এবং সততা মেন্টেইন করে কাজগুলো করে।ঠিক যেই কারণে বলিউড মেইন স্ট্রিমও বিগত / দশকে অস্বাভাবিক রকম মার্কেট তৈরি করেছে নিজেদের সিনেমার, বলা যায় গোটা বিশ্বে। অথচ আমাদের মেইন স্ট্রিম সিনেমা হতে আজ হলিউড দুরস্থান, বলিউডের দূরত্বও বিস্তর। এই দূরত্ব সিনেমার সার্বিক ভাবনার জায়গা থেকে। ২০২৩এ বলিউডের ব্লক বাস্টার সিনেমার মধ্যে জাওয়ান, পাঠান, এনিমেল অন্যতম। এইখান থেকে একরকম বলিউডের সিনেমার চিত্র বোঝা সম্ভব। ওদের কাজ আপনার আমার রুচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হোক অথবা না হোক, ওদের কাজগুলো কেমন করে হয় অর্থাৎ তৈরির প্রসেস, সেই ধারণা পাওয়া যায় কাজগুলো দেখলে। বলিউডের মেইন স্ট্রিম সিনেমার প্রস্তুতির জায়গাটাও বেশ শক্ত। একই রকম না হলেও কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে পোক্ত। ১৫/২০ বছর আগেও তাদের অবস্থা আমাদের সিনেমার চাইতে মাজুল ছিল। কলকাতা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির এই সময় বদলের পরিক্রমা কি আমাদের দেশের সিনেমা এবং সব রকম ভিডিও ফিকশন নির্মাতারা দেখার চেষ্টা করেন? এসব নিয়ে কি তারা ভাবেন?


 

নির্মাতা রায়হান রাফির পরিচালিত ৬ষ্ঠ সিনেমা তুফান। নির্মাতার নিজের জবানিতে জানা গেছে তিনি কেজিএফ, পুষ্পার মত সিনেমা বানাতে চেয়েছেন। একটা লজিক, রেশনালিটি সিদ্ধ গল্প, ক্যারেক্টার বিল্ডিং, ক্যারেক্টারের পূর্ণাঙ্গ অথবা কনভিন্সিং সিনেমাযাপন যে কোন সিনেমার প্রাথমিক চাওয়াগুলোর মধ্যে পড়ে। আপনি যদি কেজিএফ অথবা পুষ্পা দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই জানবেন গল্পটা কি? একটা দুই থেকে আড়াই অথবা তিন ঘন্টার সিনেমা শেষে আপনার মাথায় একটা গল্প থেকে যাবে। সিনেমা দর্শকরা সেই গল্পটা নিয়েই বাড়ি ফেরেন। তুফান মোটাদাগে ঝা চকচকে বড় বাজেটের মত "দেখতে" সিনেমা হয়েছে। যেখানে ভিজুয়াল ট্রিট দারুণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু বলবার মত কোন গল্প কি আছে? আমার কাছে মনে হয়েছে এবং হচ্ছে আমাদের সিনেমাগুলোতে আমরা কিছু ক্যারেক্টার দাঁড় করাচ্ছি, যাদের গল্পের গাঁথুনিতে কোন অবস্থান তৈরি হচ্ছে না। গল্পের এক রকম প্রগ্রেস দেখা যাচ্ছে ঠিকই, তবে সেই ফ্লোতে ক্যারেক্টারগুলো আলগা, ভেসে বেড়াচ্ছে। তুফানেও ঠিক তাই। আপনারা যদি ওয়ান্স আপন টাইম ইন মুম্বাই দেখে থাকেন, দেখবেন অজয় দেবগন অভিনীত সুলতান ক্যারেক্টারটা তার নামটাকে কত অল্প স্ক্রিনটাইমের মধ্যে কত ইফেক্টিভলি দর্শকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অথবা যদি শাহরুখ খান অভিনীত রাঈস সিনেমাটা দেখে থাকেন, দেখবেন টাইটেল ক্যারেক্টারকে কেমন ট্রিট দিয়ে দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই সমস্ত বিষয় ঘটানোর জন্য কি বাজেট খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? না, স্ক্রিপ্ট, স্ক্রিপ্ট প্ল্যানিং, স্ক্রিপ্ট ডিজাইনিং, ক্যারেক্টার ব্র্যান্ডিং এই সমস্ত বিষয় থাকা জরুরি। চাইলে উদাহরণগুলো হলিউড থেকে দেয়া যেত, তবে বলিউড আমাদের জন্য অধিকতর রিলেটেবল। তুফানে টাইটেল ক্যারেক্টার, মানে তুফানের ক্যারেক্টার বিল্ডিং দেখানো হয়েছে সেকেন্ড পার্সন ক্যারেক্টার পারসপেক্টিভ থেকে। সেটা বেশির ভাগটাই ক্যারেক্টার অভিনীত। খুব অল্প অংশ ছিল সেকেন্ড পার্সন ভয়েস ওভার। এই ক্যারেক্টার বিল্ডিংটা একদম শুরু থেকেই ভয়েডের উপর তৈরি হয়েছে। যতই সময় গড়িয়েছে ক্যারেক্টার তার মত দাঁড়িয়েছে ঠিকই, তবে সেই ভয়েডের উপর। যে কোন সিনেমার প্রতিটা ক্যারেক্টারের নিজস্ব একটা যাপন থাকে। কোন ক্যারেক্টারের ক্ষেত্রে যাপন না দেখালেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় না। আবার বহু ক্যারেক্টারের ক্ষেত্রে যাপন অথবা আংশিক যাপন অথবা কনভিন্সিং ইনাফ সিনেমা যাপন জরুরী। তুফান সিনেমার মোটামুটি কোন ক্যারেক্টারের ক্ষেত্রেই এই ট্রিটমেন্টটা ছিল না। শুধুমাত্র শান্ত ক্যারেক্টারের এক রকম আংশিক যাপন আমরা দেখতে পাই। অতটুকু যদিও কনভিন্সিং ছিল সিনেমার পরবর্তী গল্পের ফ্লো বোঝার জন্য। তবে অন্য কোন ক্যারেক্টারের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায়নি। যার ইমপ্যাক্ট অবশ্যই পড়েছে পুরো সিনেমাতে।


 

রায়হান রাফি কি সাউথ ইন্ডিয়ার সিনেমার এসথেটিক্স রিক্রিয়েট করতে চেয়েছেন শুধুমাত্র? নাকি সাউথ ইন্ডিয়ার আদলে বা ফরম্যাটে সিনেমা বানাতে চেয়েছেন? তিনি যদিও বলেছেন কেজিএফ, পুষ্পা বানাতে চান। তবে তার কাজের রিফ্লেকশন বলছে তিনি শুধুমাত্র এসথেটিক্স রিক্রিয়েট করতে চেয়েছেন। ৯০ দশকের ঢাকা শহর রিক্রিয়েট করার বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং ছিল। ছোটখাট কিছু বিষয় ছাড়া রিক্রিয়েশনের কাজটা নেহাত মন্দ হয়নি। গোটা সিনেমার ভিজুয়াল ট্রিট ভাল ছিল। কস্টিউম, স্টাইলিংয়ে মোটামুটি ভাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর্ট ডিরেকশনে বেশ কিছু লুপহোল ছিল। তারপরও মন্দ হয়নি।


 

অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরি, মিমি চক্রবর্তী যেরকম করেন, কনভিন্সিং কাজ করেছেন। আমাদের দেশে আমরা যেটাকে টিভি নাটক বলি, তার চাইতে সিনেমার অভিনয় যথেষ্ট ভিন্ন। মাসুমা রহমান নাবিলাকে সেই হিসাবে খুব একটা কম্ফোর্টেবল মনে হয়নি শুরুর দিকে। তার মানে এই নয় যে তিনি খারাপ কাজ করেছেন। পরের দিকে তিনি যথেষ্ট পুল অফ করেছেন। সালাহউদ্দিন লাভলু, ফজলুর রহমান বাবু, গাজী রাকায়েত তাদের চরিত্র অনুযায়ী ডেলিভার করেছেন। স্ক্রিপ্টে তাদের ক্যারেক্টারের আগে পরে সেরকম কোন কন্টিনিউয়েশন টেইল বা ট্রেইল না থাকায় খাপ ছাড়া লাগার দায়িত্ব অবশ্যই তাদের না। তবে সিনেম্যাটোগ্রাফির কথা না বললে রীতিমত গর্হিত অপরাধ হবে। একটা সময় ছিল যখন আমরা সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং সাউন্ড রেকর্ডিং-মাস্টারিংয়ের জন্য ইন্ডিয়ার কলাকুশলীদের দ্বারস্থ হতাম। তাহসিন রহমান আমাদের দেশের একজন সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসাবে দারুণ কাজ করেছেন। নিঃসন্দেহে আরও বহু সম্ভাবনাময় মানুষদের তিনি অনুপ্রাণিত করলেন তার অসাধারণ কাজ দিয়ে।


 

আজকাল অনেকেই বলেন, আমাদের সিনেমা, বিশেষত মেইন স্ট্রিম সিনেমা কিছুটা ছাড় দিয়ে দেখা উচিত। আমি বুঝি না সেইটা কেন করবো? এই মুক্ত পৃথিবীর ফিকশন দুনিয়ায় তো কোন বর্ডার নেই? আমরা একই দেশে বসে সব দেশের কাজ দেখতে পাচ্ছি।থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া যদি গোটা দুনিয়াকে দেখানোর মত কাজ করতে পারে, আমরা কেন পারবো না? আমাদের কাজ কেন কম্প্রোমাইজড ভাবে দেখতে হবে? কেন একজন পনের বছর, বিশ বছর অথবা আরও বেশি দিন কাজ করা অভিনেতার ক্ষেত্রে আমাদের বলতে হবে, তিনি ইম্প্রুভ করেছেন বা করছেন? কেন আমরা নিজেদের কাজে পূর্ণ সততা এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারবো না? কবে আমরা একটা সহজ সুন্দর গল্প বলতে পারবো আমাদের সিনেমায়? যেই গল্পটা সময়ের পরেও রয়ে যাবে? আমরা মনে প্রাণে চাই আমাদের সিনেমা সম্পূর্ণ হোক। আমাদের সিনেমা বিশ্ব নন্দিত হোক। আমাদের সিনেমা আবার শিল্প হয়ে উঠুক।