পোস্টস

গল্প

উপহার

১ জুলাই ২০২৪

ইফান

অফিসের জন্য বের হবো, এমন সময়-ই কেনো বৃষ্টি শুরু হতে হবে!

 

এমনিতে আমার বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। আমি সেকেলে টাইপ মানুষ। যদিও ইয়াং জেনারেশন অনেকেরই এখন বৃষ্টি ভালো লাগে না। সবাই শহুরে হয়ে গেছে। একটা কথার এখানে প্রচলন খুব- ব্যাঙে মুতলেও পানি উঠে। তাই শহুরে কিশোর-কিশোরীদের, তরুণ-তরুণীদের বৃষ্টি ভালো না লাগাটা স্বাভাবিক। বর্ষায় তাদের বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় তাদের আড্ডাটা দিতে হয় রেস্টুরেন্টে। এমনিতেই যে খুব বাহিরে আড্ডা দেয়, তা-ও না। তবুও তাদের বৃষ্টিতে রোমান্টিক হওয়া হয় না। আমার হয়।

 

করোনার সময় যখন বাড়িতে ছিলাম, ভাইপোদের নিয়ে ছাদে গিয়ে ইচ্ছেমতো বৃষ্টিতে ভিজলাম একদিন। তাদের সবারই জ্বর এসেছিলো। মা আমাকে খুব বকলো। কিন্তু ভাইপোদের জ্বর কাবু করতে পারে নাই। তারা সুস্থ হয়ে আবার একি কাণ্ড ঘটাতে চাইলো। দুইজন এই আগ্রহটা প্রকাশ করলো কানে কানে, একজন বললো ফিসফিসিয়ে।  

 

এখন বউ নিয়ে শহরে থাকতে এলাম। এখানে সবকিছুতেই টাকা লাগে। ময়লা নিতে এলে, তাকেও টাকা দিতে হয়। পানি কিনে খেতে হয়, অথবা ভালো ফিল্টার ইউজ করতে হয়। সবকিছুই টাকার খেলা।

 

এতো সব মেনে নিয়েও কাজের জন্য শহরে থাকি। এর মধ্যে বউয়ের এক্সাম শুরু হলো। তাকে তার বাড়িতে দিয়ে এসে আবার একা হয়ে গেলাম। পুরোদস্তুর ব্যাচেলর জীবন যাপন করছি। সারা ঘর এলোমেলো, ময়লা হয়ে আছে। কোনোরকমে রেঁধে খাই, কাপড়-চোপড় ধুই আর বিছানা গুছাই। এগুলো করতেই জান বেরিয়ে যায়। তার উপর ফ্যাক্টরিতে জব। ফিজিক্যাল ওয়ার্ক করা হয় সারাদিন। এরমধ্যে আবার টাকা বাঁচাতে কিছুটা পথ হেঁটে আসা-যাওয়া করি। অনেক খাটুনি।

 

সে অনেক কথা।

 

কিন্তু এইবার ওকে দিতে গিয়ে যে ছাতা ফেলে এলাম ওর বাসায়। বর্তমানে একটা ভালো মানের ছাতা কিনতে গেলে মিনিমাম পাঁচশত টাকা খরচ হয়ে যাবে। এখন অফিসে যাওয়ার সময় যদি বৃষ্টি শুরু হয়, আমারও শহুরে মানুষদের মতো রেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি!

 

সেমিপাকা এই বাসার মালিক ফ্যামিলি পাশেই থাকেন। আন্টিকে আমার বরাবরই সহজ-সরল মনে হয়। একমাস চাকরি না থাকার দরুণ ভাড়া দিতে পারি নাই। ওনাকে বলাতে ওনি বললেন যে, এডভান্স কেটে এডজাস্ট করবেন, কোনো সমস্যা নাই। এডভান্স দিলাম একমাসের। তাও যদি ভাড়া হিসেবে কাটা পড়ে, তাহলে অবশিষ্ট কিছুই তো থাকে না। এই শহরে এমন মানুষ পেলে তাদের মাথায় তুলে রাখতে হয়। আমি হচ্ছি লাজুক প্রকৃতির। তাই খুব একটা ভালোভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। যদিও ঠোঁটে হালকা একটা হাসির রেখা টেনে সেরে ফেলি তা। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না আরকি।

 

স্লাইডিং গ্রিলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আন্টি বের হয়ে বললো,
-ছাতা লাগবে?
আমি সেই মার্কামারা হাসি দিয়ে জানালাম, 
- না আন্টি। ভাবছি আজকে অফিসে যাবো না। 
- আরেহ সমস্যা নাই। ছাতা নাও। আমি দিচ্ছি, দাঁড়াও।
- লাগবে না আন্টি। এমনিতে অফিস অনেক দেরিতে। আমি একটু তাড়াতাড়ি বের হই। হেঁটে যাই কিছুটা। আজকে না হয় গাড়িতে গেলাম, সমস্যা নাই। 
- হেঁটে যাও কেন?
- ঘরে একা একা ভালো লাগে না। তাড়াতাড়ি বের হয়ে হাঁটি। হাঁটাও হলো, কিছুটা সেইভও হলো। আর মনও ভালো হয় হাঁটলে। 
- বউ ছাড়া ভালো লাগে না, তাই না। বুঝি আমি। তোমাদের ছোট্ট সংসারটাও অনেক সুন্দর। অল্পতেই তোমরা সব মানিয়ে নাও। এটা দেখতেও ভালো লাগে।

 

আমি আবারও একটা হাসি দিলাম। এতো দীর্ঘ আলাপ আমাদের কখনো হয় নাই। সর্বোচ্চ তিন বাক্যে আমার কথা শেষ হয়ে যেতো। আজকে বৃষ্টির কারণে এতো হলো।

 

- তা বাবা, তোমার কোনোকিছুর দরকার হইলে বইলো।
- জ্বি আচ্ছা।
- তোমার বউকেও আমার মেয়ে বলছে এই কথা। তাও তুমি কিছু বলো না। 
- তেমন কিছু তো লাগে না আন্টি। 
- তুমি বলবা বলেও মনে হয় না।
- (আবার হাসি)।
- শুধু হাসি দিয়েই দেখি মানুষের মন জয় করে ফেলার কসম খাইছো! তোমাকে আমার নিজের ছেলেই মনে হয়, তাই বলি। আমার ছেলে তোমার মতো কর্মঠ হইলে হইতো। (দীর্ঘশ্বাস ফেললো মনে হয়)।
- আন্টি, একেক মানুষ একেক রকম। ওনার হয়তো সময়টা একটু বেশি লাগতেছে। আমারও কম সময় লাগে নাই। যদিও পরিশ্রম আগেও করতাম। কিন্তু জীবনরে গুরুত্ব দিতেছি বিয়ের পর। 
- তুমি ভালো ছেলে। এইটাই যথেষ্ট। বাকিগুলা দেরিতে হইলেও সমস্যা নাই।
- তা ঠিক। 
- বউও ভালো পাইছো। জীবনে আর বেশি কিছু লাগবে না। এখন শুধু সন্তান ভালো হইলেই তোমার হয়ে যাবে।
- দোয়া করবেন।
- তোমারে বলা লাগবে না। আমি করিই।

আমি আর কি বলবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

- তোমার জন্য ফ্রিজে ঠান্ডা পানি রাখা আছে। অফিস থেকে আইসা নিয়া নিও। কয়টায় আসবা? 
- ঠিক নাই আন্টি। ছয়টাও হইতে পারে,  আটটাও হইতে পারে। কাজের উপর নির্ভর। ওভারটাইম করায় তো, তাই
- তাহলে মনে কইরা নিয়া যাবা কিন্তু। 
- জ্বি আচ্ছা।

 

আবারও চুপ হয়ে গেলাম, দুজনেই। বৃষ্টি দেখছি। আমি ভাবছি, কখন থামবে? কথা বাড়ানোর মতো কিছুই তো আর অবশিষ্ট নাই। তিনিও বৃষ্টি দেখতে দেখতে কিছু ভাবছেন সম্ভবত। হয়তো জীবন নিয়ে গভীর কিছু। সবাই তো ভাবে। যদিও সবাই প্রকাশ করতে পারে না।

 

একটু পর বৃষ্টি থেমে গেলো। আমি আন্টিকে বিদায় জানিয়ে বের হলাম। কাদা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কোনোভাবে মেইন রোডে এলাম। বৃষ্টি পড়লে কি গাড়ি চলাচল কমে যায়? নাকি মানুষ হাঁটাহাঁটি বাদ দিয়ে আমার মতোই গাড়ি খুঁজে উঠে পড়ে কে জানে! মানুষ কি আমার মতোই একাকীত্ব কাটাতে হাঁটে? হতেও পারে। মানুষ তো অদ্ভুত হয়-ই। আমিও!

 

একটা গাড়ি পেয়ে উঠে পড়লাম।

 

গাড়িতে, রাস্তায়, অফিসে- সারা শহর জুড়ে কত্তো রকমের মানুষ। এতো মানুষের ভীড়ে একজন মায়ের মমতা নিয়ে আমাকে দেখে, খোঁজ নেয়। এটা স্রষ্টার একটা উপহার। অনেককিছু একত্রে না দিলেও তাঁর দেয়া এইসব ছোটছোট উপহার আমি খুব আনন্দের সাথে চোখে পানি নিয়ে গ্রহণ করি। সুখ আমি অল্পতেই খুঁজে পাই। স্রষ্টা খুব না দিলেও কিন্তু কম দেন না। তার প্রতিও আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।