Posts

কবিতা

কিছুই বলতে পারিনি

July 2, 2024

জাকারিয়া সিজিয়াম

278
View

১.
পৃথিলা স্যানাল, ধর্মে হিন্দু
গোত্র-বর্ণ আমি সেসব বুঝিনি, 
তাই বোধহয় এর থেকে বেশী জানা হয়নি আর।
ক্লাস সেভেন, মেয়েদের দ্বিতীয়
আর ছেলে মেয়ে মিলে পঞ্চম, 
পৃথিলা স্যানাল বলতে এইটুকুই বুঝেছি আমি।
স্মৃতিতে আছে, জানালার পাশ-
মেয়েদের বেঞ্চের শব্দহীন কোনা,
দ্বিতীয় সারির শেষ মাথার নিয়মিত বাঁধা যায়গা।
এতটাই নিশ্চুপ, এতটাই বেরসিক
কোনদিন তাই হৈহুল্লোর পার্টির 
মনঃসংযোগের কারন হয়ে উঠতে পারেনি মেয়ে।
সেই পৃথিলা, শেষ বার
সাময়িক পরীক্ষার আগে 
স্কুল ছেড়ে দিলো, বিদায়ের দিন একেবারে যাবার আগে।
আমাকে বললো, শোন বারেক
এজন্মে আর আমাদের কোনদিন 
দেখা হবেনা,  তারপর প্রথম ঘটা অবাক ঘটনা-
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে
টপাটপ কেঁদে-কেটে একটা দৌড়ে 
পেড়িয়ে গেলো গেট বারান্দা, পেড়িয়ে সীমানা প্রাচীর।
কতটা পরে, শুনেছি পৃথিলার কথা
পৃথিলা ইন্ডিয়া গেছে, কেন গেছে
জানিনা কিন্তু অসহ্য একটা ব্যাথার জন্ম তখন থেকেই।
তখন থেকেই, সেই আফসোস
কিছুই বলতে পারিনি আমি, 
কিছুই বলা হয়ে ওঠেনা, কিছুই বলা হয়না আমার।

২.
আমার একটা সময়ে চুটিয়ে প্রেম করা প্রেমিকার নাম ছিলো, সোনালি আক্তার রোজি।
ছিপছিপে গড়নের কোন মেয়ে দেখলেই আমার রোজির কথা মনে পরেছে কতকাল।
প্রেম বলতে প্রেমই, কোন গোপন লুকোচুরির বালাই ছিলোনা ক্যাম্পাসের কোথাও।
আমি শেলীকে চিনেছি, মিলটন-বায়রন-কিটস থেকে ইলিয়টে এসে থামলে তারপর..
রোজির বিশ্ব সাহিত্যে আমি আঙুল ছুয়েছি বুদ্ধদেবের, একে একে মিশেছে আরও।
জীবননান্দকে ঢেউখেলানো চুলে মেলে দিয়ে, বিহারীলালের সাথে মেতেছি আবার।
চণ্ডীদাসের পাখায় চেপে মাইকেল-নজরুল-শামসুর রহমান হয়ে শক্তি-সুনীলে ঠেকেছে।
যে স্পর্শ হুমায়ুন আজাদে শুরু তার শেষে হয়েছে মহাসংগমে, তার নাম রবীন্দ্রনাথ।
সেই  আমার সোনালি আক্তার রোজি, স্বামীর হাত ধরে এসেছিলো আমার সাক্ষাতে।
আমার এক হাতেছিলো তখন Simone de Beauvoir, অন্যহাতে আধপোড়া সিগ্রেট।
খালি গায়ে ঘাসে শোয়া এক পুরোনো প্রেমিক, তার সাথে কী কথা হবে বুর্জোয়া বেনিয়ার।
সেদিন আমার প্রেমিকা কুকড়ে গেছিলো, পরিচয়হীনকে পরিচিত করতে না পেরে।
ভদ্রলোকের নাম জানা হয়নি, কিন্তু তিনি পান্ডিত্যবাদ ঝেড়ে আমার বইয়ের দিকে তাকালেন।
বেভোয়ার পড়েন? সেই কবেই পড়েছি, অনেক পড়েছি কিচ্ছু বাদ রাখিনি, সব পড়া শেষ।
এখন ভালো লাগেনা বইপড়া, কী হবে এই সব কবিতায় কী হবে এই সব সময় নষ্টকরা।
রোজি, আমার সেই প্রেমিকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুকড়ে গেছে আরও।
তার ভয় আমি কী বলে ফেলি, তার ভয় আমাদের কেউ একজনও যেন অপমানিত না হই।
তখন আবার, সেই আফসোস
কিছুই বলতে পারিনি আমি, কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি, কিছুই বলা হয়না আমার।

৩.
জীবনকে বিলাতে না পেরে, জীবন বেচে চলেছি আজকাল,
আমার ঘরে উন্নয়নের আলো আজ, কর্পোরেটের ঝা চকচক।
রোশনাই আর রোশনাইয়ে মেতে আছে আমার বারান্দা।
ঘরে আমার এলো পূর্ণচতুর্দশী, দিনরাত পূর্নিমা ঝলকানী।
একটা সপ্তাহ কেটে গেলো আমার রাই সরিষা খুটে খুটে খেতে ,
আমি বারেক আলী সরকার, কর্পোরেটের কামলা এখন।
এখন আলু ভাজির সাথে রুটি ছোট ছোট কামড় দিয়ে খাই,
বউয়ের সাথে খোশ গল্পের নামে আশেপাশে  সবার কুৎসা করি।
আমার বধূ পৃথিবীর আলো ছোয়নি কোনদিন, এতটাই অধরা।
এমন অসূর্যস্পর্শ্যা, বউকে প্রায়ই শুনতে হয় এমন স্তাবক! 
আমি ভাবি এটা কী করে স্তাবক হয়, এটা কী করে সম্ভব হয়। কোনদিন কোন পুরুষকে দেখা না দিয়ে, কাউকে না দেখে,একটা সুস্থ মাথার নারী পার করেছে এতটা জীবন।
দিন কতক পরেই,
ফোন এলো, ভাইয়া আমি তানজীম বলছি, আমাকে চিনবেন 
না, খুব জরুরী, কোথাও মিট করি কথা আছে ভাইয়া, জরুরী।
দেখা হলো স্মার্ট তরুণের সাথে, দেখা পেলামবউয়ের প্রেমিকের
আমার বালিকা বধু, তার প্রেমিক, থাকুকনা। মিথ্যা বলুকনা।প্রেমিকের অভিযোগ থাক, ওর অভিযোগের মাথায় আমার বালিকা বধুর প্রতি নির্দোষ প্রেম থাক আমার। 
স্মার্টনেস পাইনি আমি, স্মার্ট তরুন ভাবা লোকের কাছে। 
টুকরা টুকরা ছবির ম্যাসেজ, কিছু আপন মুহূর্ত

যা তো তাদের একান্ত নিজস্ব আর গোপনও-

আমাকে আরেকটা খারাপ লোকের ঠিকানা লেখার সুযোগ দেয়, তানজীম হাসান।
সেই কুরূচির পর খেয়ালী আবেগের কথা...
আপনি স্বামী, প্রেমিক নন, প্রেমিক আমিই, আপনি পারবেননা।
আপনি আর কোনদিনই পারবেননা ওর অশ্রুর প্রথম ফোঁটা নিজ করতলে নিতে, প্রথম অনেক কিছুর সাক্ষী আপনি হতে পারবেননা। 
তবুও... বালকের শেষ কথা কানে বাজে, মায়া হয় চোখের জল দেখে...  মানুষ প্রেম কেন করে স্যার?
আমার বালিকা বউ আর তার বালক প্রেমিককে পাঠ দানের ক্ষমতা রেখেও আমি চুপ থাকি, কেন করে সবাই?
অন্তত একটা স্বান্ত্বণা দিতে না পারার আফসোস রয়ে যায়।
কিছুই বলতে পারিনি আমি, কিছুই বলা হয়ে ওঠেনা, কিছুই বলা হয়না আমার।

৪.
অফিসপাড়া লাগোয়া থিয়েটার পাড়া,
কখনও চোখ ফেড়ানো হয়না আর, 
সময় বড় বেইমান হয়ে ফিরে আসে।
জুথিকা,
আমার থিয়েটার করা তুখোর বন্ধু
সাহস যেমন, তেমন ওর গলার স্বর।
এখন কোনএক বেসরকারী চ্যানেলের
সংবাদসংগ্রাহক আমার বন্ধু যুথীকা।
একটা মুগুরের মত মাইক্রোফোন নিয়ে
এর মুখে ওর মুখে ধরে বেড়ায় দিনরাত।
কয়েকদিন হবে বোধহয়, একটা কামড়ায়
ঢাকায় ফিরছিলাম চট্রগাম থেকে একা।
স্টেশনে দেখা হয়ে গেলো যুথিকার সাথে,
তিনজনের একটা ছোটদল, ব্যাগের সাইজ
লোকবলের চেয়ে বেশী তবু ফুর্তিতে বেজায়।
এতদিন পরে, ঠিক মনে নেই কতদিন তবুও
হিসেবের খাতার বছর পাঁচেক হবেই হবে।
জুথিকার চিৎকারে ততক্ষনে প্লাটফর্মের
সব মানুষের জানা হয়ে গেছে আমার নাম,
মোহাম্মদ বারেক আলী সরকার।
চেয়ার ছেড়ে কামড়ায় উঠে এলো ওরা,
গানে আর ছন্দে মেতে উঠলো এ ঘড়।
রাতের সাথে ক্লান্তি বেড়ে চলেছে সবার
ছন্দে মাতাল কামড়া একসময় নিরব হয়।
শব্দ, নিরবতা কিংবা অন্ধকার শুধু
আমায় ছুতে পারেনা, আমি একা 
আমি শুধু একা দরজার কাছে দাড়িয়ে,
পাশে এসে দাড়ায় জুথিকা ক্লান্ত চোখে।
কি সব ভাড়ে কফি চা হুইস্কি ভরে রাখে
তারই এক কাপ কফি নিয়ে জুথিকা খানম।
কফি আমি খেতে পারিনা, অনেক আগে
যখন খেতে-বসতে-বেড়াতে কফি লাগতো।
তারপর বায়ু বয়ে গেছে অনেক বসন্তের।

সেই যে ক্যাফেটেরিয়ার ফাঁকা টেবিল, 

এই সেই যুথিকা- সেই তার উন্মুখ অধরে ধরা

গরমাগরম কফি, সেই আমার অধরা পানপাত্র।
কফির কাপ আর রাঙা অধর, কোনটারই
দাগ যায়নি বলে আমি ঠোঁট ভেবে আজও
কফিতে চুমুক দিতে পারিনা অনেকবছর।
‘নে কফি খা’ বলে যত তাড়াতাড়ি যুথিকা
পারে, আমি পারিনা তত তাড়াতাড়ি ভুলতে।
কাপ আজ একটা হতে পারতো দুইঠোঁটের
আজ হতে পারতো ক্যামেলিয়া বনে গমন।
কিছুই হয়নি পাওয়া, আফসোস ফের আসে
তুই সেদিন হ্যাঁ বলতে পারতি বারেক,
আমাকে ফাঁকি না দিলেও তুই পারতি। 
আমি, মোহাম্মদ বারেক আলী সরকার।
কিছুই বলতে পারিনি আমি, কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি, কিছুই বলা হয়না আমার।

১১.০১.২০২১
আশকোনা

Comments

    Please login to post comment. Login