পোস্টস

গল্প

গন্তব্য

২ জুলাই ২০২৪

ইফান

বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আর দুপুরের খাবার খেতেই হুট করে একটা হোটেলে ঢুকে গেলাম। এগুলোকে বলে ভাতঘর। সস্তায় ভালো খাবার। পরিবেশ নিয়ে সন্দিহান হলেও এটা নিশ্চিত থাকতে পারবেন যে, খাবার বাসি না। এটা কি গরীবের সান্ত্বনা নাকি তা জানি না। সে যাই হোক, আমরা আরাম-আয়েশ করে এই সস্তা হোটেল বা ভাতঘরে পেট ভরে সুখাদ্য খাই বলেই জানি।


'বৃষ্টি থেকে বাঁচতে'- কথাটা অদ্ভুত! বৃষ্টি তো আমাদের বাঁচায়। শহরের মানুষদের গরমে স্বস্তি দেয়। তাও আমরা শহুরে মানুষরা তা অস্বীকার করে উল্টো দোষারোপ করি। মানুষ বরাবরই অকৃতজ্ঞ প্রাণী।


তাড়াহুড়া করে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। আজকে মোটামুটি ফাঁকা। অফ ডে হওয়াতেই সম্ভবত। নয়তো এই কমার্সিয়াল এরিয়া এতোটা নীরব থাকে না দিনে। মানুষ গমগম করে সন্ধ্যা অবধি। তারপর শুরু হয় স্ট্রিট ফুড আর মানুষের ভালোবাসাবাসি। সেটা শুরু হতে এখনো ঢের দেরি। এখন উদরপূর্তি হোক আগে। তারপর বৃষ্টি দেখতে দেখতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া যাবে আরামসে। যদিও সরকার এই একটা জিনিসের উপর প্রতি বাজেটে কর বৃদ্ধি করে আমাদের মতো চেইন স্মোকারদের দমন করতে চান। কিন্তু ব্যর্থ হন। কারণ, আমি প্রতি বছর-ই সিগারেট চেইঞ্জ করে ফেলি। এখন নেমেছি ক্যামেল সুইচ-এ। সামনের বছরেরটা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে ভেবেচিন্তে চেইঞ্জ করবো।


কি অর্ডার করবো তা মনেমনে ভাবছিলাম। বসার সাথেসাথেই ভাত এসে পড়ে এখানে। ভাবতে গিয়ে সামনের চেয়ারে চোখ গেলো। সেখানে বসে দ্রুতগতিতে অনেকটা আনমনেই খাবার না চিবিয়ে গিলে ফেলছিলো যেই মানুষটা, সেটা আমার স্কুল ফ্রেন্ড আরিফ।


- কীরে আরিফ? যুদ্ধে যাবি নাকি?
সে চোখ তোলে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো অবশ্য। হঠাৎ এভাবে দেখা হওয়ার কথা না। সবকিছু আগে থেকে প্ল্যান করা থাকে না যদিও। সে ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখেই বললো,
- যুদ্ধে তো অলরেডি আছিই।
- হাইলি ফিলোসফিক্যাল কথা। যাক। কিসে রে এখন?
- এস.আর. হিসেবে আছি। এইটা আমার এরিয়া। আপাতত খেয়ে নিই। তারপর আবার দোকানদারদের হাতেপায়ে ধরে আটা-ময়দা, বিস্কিট, চা-পাতা বিক্রির চেষ্টা চালাইতে হবে। 
দুজনেই হেসে উঠলাম। সত্যিই, জীবনটাই একটা যুদ্ধ। একদিন মরে যাবো জেনেও বেঁচে থাকার সে কি আকুতি! আচ্ছা, আমরা কি সবসময় নিজের জন্যই বাঁচি?


এই মানুষটা ছিলো ভবঘুরে টাইপ, আমার চেয়েও বেশি উড়নচণ্ডী। তার প্রেমিকাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরাঘুরি। এই শিল্পকলা তো এই সিআরবি, এই সী-বিচ তো এই নেভাল- সারাদিন তারা একসাথে খুব আনন্দে সময় কাটাতো। ফেসবুকে তাদের ভালোবাসা দেখেই হিংসা হতো। আমিও ভবঘুরে ছিলাম। কিন্তু এমন প্রেমিকা আমার জুটে নাই। আমার যা জুটেছিলো, সবগুলো বাবার ভয়ে মায়ের আঁচলে বন্দী ছিলো।


আরিফ তার ভালোবাসাকে বিয়েও করেছিলো। তারপর তাকে আর ফেসবুকে দেখা যায় নাই। আজ তিন বছর পর তাকে পেলাম। তাও ফেসবুকে না, সরাসরি। ভালোই হলো। এই সময়টা ভালোই কাটবে, স্মৃতিচারণ হবে। একটু না হয় টাইম ট্রাভেল করলাম অতীতে, মন্দ কি!


খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম,
- রীতা কেমন আছে?
- জানি না। হয়তো ভালো। 
- রাগ নাকি?
- আমি না। ও-ই রাগ করে চলে গেছে। 
- ওমা! কেন?
- আমার মাকে ওর সহ্য হয় না।
- তো আলাদা থাকতি, সমস্যা কি?
- অনেক সমস্যা। ওরে আমি যেমনটা ভাবছিলাম, ও তেমন না। ওর মা হচ্ছে বড় সমস্যা। আমাদের আলাদা হওয়ার মূল কারণ ওর মা। যেহেতু আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন এই টপিক বাদ।
- আচ্ছা।


ঠিক এই মুহুর্তে কি বলা যায়, সেটা আমি জানি না। যেই মানুষটাকে একসময় হিংসা করতাম, এখন তার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। জীবন কি এমন-ই?


খাওয়া শেষে বিলটা আমিই দিলাম। তাকে বললাম সিগারেট খাওয়াতে। একটা দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে পাশের বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে ধোঁয়া উড়াচ্ছি।


- তোর মনে আছে আমাদের স্কুলের সেই সুপারি গাছের সারির রোডটা কত্ত সুন্দর ছিলো?
- সায়েম, এইটা কি বললি? এইসব কি ভুলা যায় রে? আমি আর তুই যে রোডের পাশে ধানক্ষেতে সব কয়টারে ছুটির সময় ধাক্কায়া ফেলতাম, এইসব স্মৃতি কি এমনেই ভুইলা যামু? 
- বৃষ্টির সময় স্কুলের কদম গাছ থেকে ফুল নিয়ে সারা ক্লাস মাখাইলাম আমরা। 
- আর মাইর খাইলো সব কয়টায়।
দুইজনই এই স্মৃতি মনে করে হাসতে হাসতে শেষ। কি অসম্ভব সুন্দর দিনগুলো! নিমেষেই শেষ হয়ে গেলো যেন।


- এস.আর. হিসেবে যা পাছ, তাতে চলে?
- চালাইলে চলে। তোর জবের কি অবস্থা? আগের মতো তো ঘনঘন পাল্টাস না, নাকি?
- বিয়ের পর এইটা কি সম্ভব?
- কি জানি! আমার তো সাংসারিক বিষয় নিয়ে খুব একটা জ্ঞান হয় নাই। তার আগেই....
- দোয়া করিস আমাদের জন্য। বাচ্চা নিতাছি। এই দুর্মূল্যের বাজারে কিভাবে কি হবে জানি না। আল্লাহর ভরসায় চইলা যাইতেছি। 
- মানুষ ভরসাতেই বাঁচে রে চান্দু। না হয় সব লাশ-ই ঘুরতেছে কিন্তু আশেপাশে। 
- (খানিকটা অবাক হয়েই তার দিকে তাকালাম) তুই যে কথাবার্তা কইতাছিস! না জানি মরলে তোর কবর মাজার অইয়া যায়। 
- এইসব সত্যি কথারে সায়েম। সবাই এইসব থেইকা পালাইয়া থাকে। আমি পালাইতে পারি না দেইখা এইসব কথাই কই। 
- আসলেই। তুই কোনদিকে যাবি?
- Alice in Wonderland দেখছিস? 
- নারে। দেখা হয় নাই। যদিও লিস্টে আছে।
- অইখানে একটা সিন আছে এমন। একটা জায়গায় আইসা এলিস থাইমা যায়। কোনদিক দিয়া যাইবো দিশা পায় না। গাছের উপ্রে থাকা একটা বিড়ালরে জিগায়, কোনদিক দিয়া যামু? বিড়াল উল্টা জিগায়, তুমি কই যাইবা? এলিস কয়, সেইটা তো জানি না। বিড়াল কয়, তাইলে যেইদিক দিয়াই যাও না ক্যান, হিসাব একটাই।


তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টিতে তখন বিস্ময়, হতাশা, বেদনা কিছুই ছিলো না। একেবারেই শূন্য ছিলো। কোন ভাব প্রকাশ করবো বুঝি নাই আসলে। তার প্রতি করুণা হলো। সেটা প্রকাশ করা উচিত হবে না।


- আসি।
বলেই হাঁটা দিলাম। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকালাম পেছনে। সে চলে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। হয়তোবা গন্তব্যহীন ছিলো তার পথ।


তার সঙ্গী হওয়ার মতো সাহস আমার নাই। কিংবা আমি হয়তো আমার জীবনে ফিরে যেতে চাচ্ছি। তার মতো মুক্ত জীবন আমার না। আমার বউ আছে, অনাগত সন্তান আছে। তাদের জন্য কিছু করতে হবে।


এই ভেবে হাঁটতে হাঁটতে অনেক পথ এসে দেখলাম আমি ভুল পথে। যে পথে যাওয়া কথা, তার উল্টোপথে এখন। আবার গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম।