Posts

গল্প

ময়নাতদন্ত দ্য অটোপ্সি

July 3, 2024

Tanzim Bari

166
View

রিলেশন নিয়ে আমি কখনোই সিরিয়াস ছিলাম না। তাই বলে আমি কাউকে ঠকিয়েছি- এটা কেউ বলতে পারবেনা। সারাজীবন আমি একজনের সাথেই প্রেম করেছি, একজনকেই ভালবেসেছি। শুধু টাইম পাস করা বা কিছুকাল পরে ছেড়ে দেওয়া- এমন কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। তাহলে সিরিয়াস ছিলামনা বলছি কেন? কারণ প্রেমের আগে ক্যারিয়ার-ই আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। প্রেমের জন্য ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে পারবনা। 

একসময় আমার পোস্টিং দেওয়া হল দেশের এক স্বনামধন্য মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে। সরকারি চাকুরিতে ঢোকার পর এত তাড়াতাড়ি একটু অস্বাভাবিকই বটে। তবুও কি আর করা। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক ডাক্তারদের জীবনে কষ্ট অনেক বেশি। কাজের ভীষণ চাপ। ফাঁকি যে দেব তাও হয়না। একটা দায়িত্ব, একটা নীতিবোধের প্রশ্ন এসে যায়। কাজের চাপের পাশাপাশি পড়াশোনা। লাইফ বলে কিছু আছে নাকি? ফরেনসিকে পোস্টিং হওয়ার পর কষ্টটা যেন বেড়ে গেল। প্রতিদিনই এক বা একাধিক লাশ আসত। সকাল-বিকেল যখন তখন ছুটতে হত। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়/সাইক্লোন - যাই হোক না কেন, কোন মাফ নেই। সাপ্তাহিক ছুটি তো বাদই দিলাম, ঈদের ছুটিও ঠিক করে পেতাম না। এমনও হয়েছে অটোপ্সি করার জন্য ঈদের নামাজ পড়েই ছুটে আসতে হয়েছে। অনেকদিন গেছে দাওয়াত নিয়েও দাওয়াত রক্ষা করতে পারিনি। এনিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের অভিযোগের সীমা ছিলনা। স্নেহার অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। ওর অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন ছিল- তাও না। আগের মত সময় দিতে পারতামনা যে। প্রত্যেক গার্লফ্রেন্ড তাদের বয়ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে ভালোবাসা চায়, কেয়ারিং চায়, সময় চায়। আমি দিতে পারতামনা। কতদিন গেছে ও আমার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে, আমি দেরি করে পৌঁছেছি। কখনো বা যেতেই পারিনি, ডেটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছি। ও রাগ করেছে, রাগ করাই স্বাভাবিক। 

প্রতিদিন লাশের সাথে কারবার। বেশীরভাগই অল্পবয়সীদের। অস্বাভাবিক মৃত্যু। এসব দেখতে দেখতে মনটা শক্ত হয়ে ওঠে। শুধু লাশ না, অপরাধ জগতটাও যেন খুব কাছ থেকে দেখতে পাই। মাঝে মাঝে ভুল রিপোর্ট দেবার জন্য অনুরোধ পাই। অনুরোধ না বলে হুমকি বলাই ভালো। ভয় পেলে চলেনা, শক্ত থাকতে হয়। ফলে আমার ব্যবহারটা হয়ে ওঠে রুক্ষ থেকে রুক্ষতর। স্নেহার সাথে দেখা করতে পারিনা, ফোনে কথা বলে যে সেটা পুষিয়ে দেব তাও হয়না। রাতে একটু ভালবেসে কথা বলার মুড থাকেনা। 

এভাবেই দিন কেটে যেতে থাকে। এমন সময় শুনলাম স্নেহার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম আমার জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা ওর পক্ষে সম্ভবনা। তার পরিবারকে কী বলে ঠেকিয়ে রাখবে? আবার এও জানতাম আমাকে ছাড়া অন্য কাউকেই সে বিয়ে করতে পারবেনা। উভয় সঙ্কট। আমি আগেই বলেছি প্রেম কখনোই আমার ফ্রার্স্ট প্রায়োরিটি ছিল না। তাছাড়া এখনো নিজেকে ঠিকমত গুছিয়ে নিতে পারিনি। তাই এখনই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভবও না। স্নেহাকে সরাসরি বলে দিলাম, ‘এখন আমি বিয়ে করতে পারবনা। আমার জন্য অপেক্ষা করতে না পারলে বিয়ে করে ফেল।’ কঠিন মুহুর্তে কঠিন ডিসিশানটা পুরোপুরি ওর ওপর চাপিয়ে দিলাম। অনেক রুক্ষ ছিল কথাগুলো। আমিও বুঝি। ঐ যে আগেই বলেছি আমি রুক্ষ থেকে রুক্ষতর হয়ে উঠছি। 

ও আমার উদাসীনতা দেখে খুব রাগ করল। অভিমান করল তার চেয়ে বেশি। যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। কোনভাবেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলামনা। একদিন খবর পেলাম ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়র। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। স্ট্যাবলিশড। ওকে সুখে রাখবে। আমার যে খারাপ লাগেনি তা কিন্তু না। খারাপ লেগেছিল। ভীষণ খারাপ লেগেছিল। ও সুখে থাকবে এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজে নিতাম। ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বাদ দিয়ে দিলাম। রাতে ঠিকমত ঘুম হয়না। দিনেও ঠিক মত কাজে মন দিতে পারিনা। ভীষণ অন্যমনস্ক থাকি। বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে আমার অন্যমনস্কতা তত বাড়তে থাকে। 

একদিন সকালে অফিসের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। একটা সুইসাইড কেস। সুইসাইড নোটে নাকি লেখা তার অটোপ্সি যেন আমাদের মেডিকেল কলেজে করানো হয়। এমন আজব সুইসাইড নোটের কথা আগে কখনো শুনিনি। 

লাশকাটা ঘরে ঢুকে যা দেখলাম তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলামনা। স্নেহা স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। তার চোখ অল্প খোলা। যেন একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখছে। তার বাহুতে লেখা “আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে চাইনা। কাউকে না। ভালো থেকো... ” এই ছোট্ট দুটো লাইন কার জন্য লেখা কেউ জানেনা, আমি জানি। ডোম চাচার মডিফাইড ওয়াই শেপ ইনসিশন দেওয়ার সময় আমি কান্না চেপে রাখতে পারিনা। চাচা কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। তার চোখে জিজ্ঞাসা বুঝতে পারি, কিছু বলিনা। আগামীকাল সে যখন আমার ডেডবডিটা কাটবে, তখন সে নিশ্চয় উত্তরটা পেয়ে যাবে।

Comments

    Please login to post comment. Login