পোস্টস

গল্প

মিসক্যারেজ

২৫ এপ্রিল ২০২৪

সর্দার ইমাম

মূল লেখক সর্দার ইমাম

ছেলে চড়ুইটা মেয়ে চড়ুইটার পালকের নিচে ঠোঁট ঢুকিয়ে এক রকম চুলকানোর মত করে সঙ্গিনীর পশমের বিলি কেটে দিচ্ছে। মেয়ে চড়ুইটা চোখ বন্ধ করে গলা সমেত মাথা উঁচু করে দিয়ে এতে সুখের জানান দিচ্ছিলো।
ছেলে চড়ুইটা হঠাৎ করেই মেয়ে চড়ুইটার মাথায় ঠোকর দিয়ে দেয় এক ভোঁ দৌড়। পেছন পেছন ছোটে মেয়ে চড়ুইটা। ছেলে চড়ুইটা মাটি ছুঁই ছুঁই করে ওড়ে আর মেয়েটা তার পিছু পিছু। অনেক দৌড়ানোর পরেও মেয়ে চড়ুইটা যদি ছেলেটাকে ধরতে না পারে তবে ছেলে চড়ুইটা আনন্দে পা দুটো আকাশের দিকে তুলে দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায়।

মেয়ে চড়ুইটা তখন ডালিমের ডালে মাথা নিচু করে, মাথা, পা, পালক সব একত্রিত করে ঘাপটি মেরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে। গোস্বায় সে মুখ ফুলিয়ে রাখে।
গড়াগড়ি শেষে ছেলেটা এসে পাশের ডালে বসে।মেয়েটাকে শিষ দেয়, চোখে ইশারা করে। এতে করে মেয়ে চড়ুইটার গোস্বা আরো বেড়ে যায়। চোখাচোখি হতেই মেয়েটা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখ তার জলে ছলছল করছে এই বুঝি তা খসে পড়বে। ছেলেটা তখন ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে পাশে বসে।
ছেলেটা এবার ডানে সরে এসে আস্তে করে মেয়েটার গায়ে ঘষা দেয়। ছেলেটা যতই গা ঘেষে আসে মেয়েটা ততই ডানে সরে যায়। এমন করতে করতে যখন একেবারেই ডালের কিনারায় চলে আসে, তখন মেয়েটা দেয় এক ভোঁ দৌড়। ছেলেটা ছোটে পিছন পিছন। আবার সেই হাসি, গান আর খুঁনসুটি।

বেশকিছু দিন হল মেয়ে চড়ুইটা সর্বোক্ষণ বাসায় বসে থাকে আর ছেলেটা বাহিরে। একটুখানি আওয়াজ হলেই গলা উঁচিয়ে চোখ বড় বড় করে ছেলে চড়ুইটা চারপাশে তাকায়। বুঝা গেল, সম্ভাব্য মা চড়ুইটা ডিম পেড়েছে।
সারাদিন আকাশের মন খারাপ ছিল। পড়ন্ত বিকেলে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে আর তার সাথে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি। আচমকা একটা ঝড়ো হাওয়া বইলো উত্তরে-দক্ষিণে।
চড়ুইয়ের বাসাটা মাটিতে পড়ে আছে। সাদা সাদা ছোট দুটো ডিম প্রচণ্ড আঘাতের সামাল দিতে গিয়ে ফেটে কয়েক খণ্ড হয়ে গেছে। ডিমের তেলচে কুসুম বাসার খড় ভিজিয়ে মাটি স্পর্শ করেছে। আর সর্বনাশা মাটি তা পরম আদরে শুষে নিচ্ছে নিজের তৃষ্ণা মেটাবে বলে।
ভাঙা বাসার দু'পাশ থেকে দুটো চড়ুই খুব জোরে জোরে চিল্লাছে আর বাতাসের বেগে পাখা ঝাপটাচ্ছে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি তারাও মারা যাবে।চারপাশটাকে ভীষণ ধোঁয়াশে মনে হচ্ছে। সব শব্দই যেন কান্নায় মিশে যাচ্ছিল। চড়ুই দুটোর বুক ধাপড়ানো হাহাকারের একটাই অভিযোগ-এমনটা না হলে কার কী এমন ক্ষতি হত কিংবা আধ্যাত্বিকতায় সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে?
গগনবিদারী এই আহাজারিতে বুঝা গেল না, কে মা চড়ুই আর কে বাবা চড়ুই। আসন্ন সন্তানের প্রতি কার মায়া বেশি ছিল? মা চড়ুইয়ের নাকি বাবা চড়ুইয়ের?
পরদিন চড়ুই যুগলকে আবার সেই ডালিমের ডালে দেখা গেল। তবে আজ আর আগেকার সেই উচ্ছ্বাস নেই, খুঁনসুটি নেই। আছে কেবল এক সমুদ্রবুক জল আর তার সাথে দিগন্তছোঁয়া হাহাকার।
আজ চড়ুই দুটো অনেক বেশিই লেপ্টেসেপ্টে বসে আছে। আজ তারা যতটা না উদাস তার চেয়েও বেশি বিষণ্ণ। মা চড়ুইটা মাথা নুইয়ে পাশের ডালে রাখলো। মাথাটার ওজন যেন কয়েকশত মণ। যার ভার মা চড়ুইটা সইতে পারছেনা।
বাবা চড়ুইটা মা চড়ুইটার মাথা চুলকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। হয়তো বলছে,
~চিন্তা করোনা। তুমি দেখো আমাদের আবার ডিম হবে। আমরা অনেকগুলো বাচ্চা ফুটাবো। তারা দলবেঁধে নাচবে, গাইবে আর খেলবে। তুমি আর আমি ডালে বসে বসে তা দেখবো।
বাবা চড়ুইটা কান্না লুকিয়ে হাসার মত করে বলছে,
~কিগো! কি হল তোমার? কিছু বলছো না যে?
মা চড়ুইয়ের দেহটাকে অসাড় মনে হচ্ছে। তার যেন সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। সে অনন্তকালের পথ ধরে হাঁটছে। যার সীমানায় কেবলই মরীচিকা। কোথাও একফোঁটা জল নেই। তার কী তৃষ্ণা! কী তৃষ্ণা!
বাবা চড়ুইয়ের দেয়া সান্ত্বনা মা চড়ুইয়ের কাছে কেবলই ভোঁ ভোঁ শব্দ মনে হচ্ছে। যা তাকে আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে। বাবা চড়ুইয়ের এ সান্ত্বনা মা চড়ুইয়ের বুকফাটা মরুভুমিতে কেবল ক'মুঠো উত্তপ্ত বালু ঢেলে দিচ্ছে। তার বাহিরে আর কিছুই নয়।
এদিকে চাপা কান্নার কষ্টে বাবা চড়ুইয়ের পুরো শরীর কাঁপছিল। চোখ দুটো জলে ডুবে আছে। নিজেকে সামলাবার কোন ক্ষমতাই তার ছিলনা। তবু সে ক্রমশঃ মা চড়ুইকে সামলাবার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাহ্,কি চমৎকার খেলা চলছে। প্রকৃতির এ খেলায় কোন বিরতি নেই। এ খেলার শুরুটা কেউ দেখেনি, না শেষটা দেখবে। প্রকৃতি নিজে কখনো থামে না।থামিয়ে দেয় কারো কারো পথ  চলা। শুরু হয় নতুন কোন উপাখ্যান। তারই ধারাবাহিকতায় এতটা বৈচিত্র্যময় আজকের জীব ও জীবনের ছুটে চলা।