পোস্টস

গল্প

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই

৪ জুলাই ২০২৪

উম্মে ফারহানা


ফয়সাল ঠিক করেছে আজ সারাদিন সে ফোন বন্ধ রাখবে। কারো সঙ্গে কথা বলবে না। লোকের অযাচিত সহানুভূতি আর করুণা এড়াবার জন্য এ ছাড়া আর কোন যুতসই উপায় সে দেখতে পাচ্ছে না।এমনিতে সে বন্ধুপ্রিয়, আড্ডাপ্রিয় মানুষ। ‘সবকিছু ভালো লাগে মানুষের সঙ্গ ছাড়া’ পর্যায়ের
অসামাজিক সে কখনো ছিল না, আর হতেও চায় না। কিন্তু আজ তার কারো সঙ্গেই কথা বলতে মন চাইছে না।
শুক্রবার সকালেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় তার। যদিও এলার্ম সেট করা আছে সানডে টু থার্সডে- বহুদিনের অভ্যাসবশত শুক্রশনিবারেও শরীরের বায়োলজিক্যাল এলার্ম তাকে জাগিয়ে তোলে, শুধু যদি বৃহস্পতিবার রাতে ছবি দেখে বা পার্টি করে ঘুমাতে অনেক বেশি দেরি হয়ে না যায়। ইদানিং সে বৃহস্পতি-শুক্রবার সন্ধ্যাগুলিও বাসায় বসেই কাটিয়ে দিচ্ছে, নেটফ্লিক্স দেখে কিংবা গান শুনে।
গত তিনমাসের রুটিন এটা। আজ সে ঠিক করেছে এখন থেকে শুক্রশনিবারে ফোনটাও বন্ধ রাখবে, অফিস থেকে কোন জরুরি ফোন আসবার সম্ভবনা যেহেতু নেই।


গত তিনমাসে এই কেয়ার আর কনসার্নমূলক ফোনগুলো এসেছে শুক্রবার আর শনিবারেই। আত্মীয়-বন্ধুদের সবাই উইকেন্ডে কিছু নষ্ট করবার মতন সময় পায়, তখন তারা ফয়সালকে ফোন করে নানা আলাপ চালাবার প্রয়াস পায়, অবধারিতভাবেই তিন মাস আগের ভেস্তে যাওয়া বিবাহ-
প্রস্তুতি সংক্রান্ত অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসে।
ঘটনাটা খুব বড় কিছু না। অন্যদের কাছে অমীমাংসিত মনে হলেও তার কাছে স্পষ্ট ব্যখ্যা রয়েছে,যদিও ব্যখ্যাটা সে কাউকে দিতে চায়নি। শুধু শোয়েবকে বলেছিল পুরো ঘটনাটা। শোয়েব শুনে হাসলো। এটা তার সারাজীবনের অভ্যাস, যত গুরুগম্ভীর আলাপই হোক, সে হাসে। হাসতে হাসতেই সে বলল, “ভালো হইছে তো, বাঁইচা গেলি। সারাজীবন ভুগতে হইত নাইলে”। ফয়সালের কাছেও তাই মনে হয়েছে।বিয়ে একটা সারাজীবনের সিদ্ধান্ত, খুব সাবধানে না নিলে বড় রকমের বিপদের সম্ভবনা আছে।


নিশা, মানে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেছিল- আম্মা আর বড় আপা স্বর্ণকারের দোকানে গয়না অর্ডার করতে দিয়েছিলেন, আব্বাও মেজোফুফুর বাসায় বসে ফুফার সঙ্গে বৌভাতের জন্য পার্টিসেন্টার ভাড়া করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিলেন, বৌভাত
ঢাকায় হবে নাকি নারায়ণগঞ্জে তা নিয়েও দুই পক্ষ তৈরি হয়ে তর্ক বিতর্ক শুরু হছে গেছিল- সেই মেয়েটি ফাইনাল ডেট ঠিক হবার আগে একদিন ফয়সালের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো। ফয়সাল তার সবচেয়ে ভালো চকলেট রঙের সেমি-ফর্মাল স্লিমফিটের শার্ট আর লাইট ব্লু ডেনিমের সঙ্গে বাংলাদেশের ধুলোকাদার আবহাওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাফেরা না করলে মেইনটেইন করা খুব
মুশকিল এমন এক জোড়া লোফার পরে বিকাল ঠিক পাঁচটায় নিশার বলা কফিশপে উপস্থিত হয়েছিল। বিলেত থেকে আনা মাইকেল কর্সের পারফিউমও মেখেছিল বেশ খানিকটা।
 

নিশা এলো মিনিট পাঁচেক পরে। ক্লাসে যাবার মতন সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরা, চুলগুলো পেছনে পনিটেল করে বাঁধা, কাঁধে একটা বড় ব্যাগ ঝোলানো নিশাকে দেখে তার উৎসাহে সামান্য ভাটা পড়ল। আশাভঙ্গের চেয়ে বড় কথা নিজের প্রচুর ‘মাঞ্জা মেরে’ আসাটাকে তুচ্ছ আর নিজেকে অকিঞ্চিৎকর মনে হল। কিন্তু ফয়সাল পজিটিভ ধরনের মানুষ, কোনকিছু না জেনেই নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে ফেলেনা সে। পরক্ষণেই ভাবতে চেষ্টা করলো সে, হয়তো কোন কাজে আসাযাওয়ার পথে সে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, যত্ন নিয়ে সাজপোশাক ঠিক করবার মতন যথেষ্ট সময়কিংবা অবকাশ পায়নি।


তার সামনের সোফাতে বসে নিশা বলল, “আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে”। সামান্য হেসে ফয়সাল বলল, “শুনবো, আগে বলেন কী খাবেন”। নিশা বলল, “আমার জন্য ক্যাপাচিনো, আর...” বাকিটা শেষ না করে ফয়সালের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে গেল। ফয়সালের মনে হল, কোথাও কোন সমস্যা আছে- সামথিং ইজ রং, ডালমে কুছ কালা হ্যাঁয়। ডালের কালা প্রকাশিত
হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই । নিশা জানালো তার এক সহপাঠীর সঙ্গে তার বেশ কয়েক বছরের সম্পর্ক, লেখাপড়া প্রায় শেষ পর্যায়ের হলেও বাসায় বলতে পারছেনা যেহেতু ছেলেটি এখনো উপার্জনক্ষম নয়। ফয়সাল যেন কিছু একটা বলে বিয়ের আলাপ ক্যানসেল করে দেয়। প্রথমত বিস্ময়, দ্বিতীয়ত ক্রোধ এবং তৃতীয়ত বিরক্তি তাকে আচ্ছন্ন করে যখন নিশার সেই সহপাঠী প্রেমিক আবির্ভূত হয়, সে আশেপাশেই কোন টেবিলে বসে ছিল হয়তো, নিশা ফোন থেকে টেক্সট পাঠালে সে সামনে এসে দাঁড়ায়। ফয়সাল ধৈর্য ধরে রেখে উঠে দাঁড়ায়, হ্যান্ডশেইক করে আবার বসে বলে, “আপনি কী খাবেন? আই গেস ইউ ডোন্ট লাইক ক্যাপাচিনো”। ফয়সালের সহৃদয় হাসিতেও পরিস্থিতি খুব একটা হালকা হয় না। ছেলেটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “ক্যাপাচিনো ইজ ফাইন”। তার বলবার ভঙ্গিতে মনে হল কফির ধরন ঠিক করবার মতন সামান্য ব্যাপার নিয়ে কথা বলারই কিছু নেই। তার এই ঔদ্ধত্য চোখে লাগলেও ফয়সাল তা ইগনোর করে। বাগদত্তার প্রেমিকের
সঙ্গে অভদ্রতা করে পুরো ব্যাপারটাকে আরও বেশি সিনেমাটিক করে তোলার কোনই মানে হয় না।


অর্ডার দেওয়া হলে পরে অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে ফয়সাল জিজ্ঞেস করে, “সো, হোয়াট অ্যাম আই সাপোজড টু সে টু মাই প্যারেন্টস?” ইচ্ছা করেই সে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, বাংলায় বললে ন্যাকামি, শোয়েবের ভাষায় ‘আবাল মার্কা’ শোনাত, “আমি আমার আম্মুআব্বুকে কী বলবো?” হাইস্যকর!
“যে কোন একটা কিছু, বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি”
“কিন্তু আমি শুরু থেকেই বলেছি আপনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে” বলেই আফসোস হয় ফয়সালের, বলা উচিৎ ছিল, “দারুণ পছন্দ হয়েছে” কিংবা “খুব পছন্দ হয়েছে”। কথাটা সত্যিও- গত এক বছর ধরে আম্মা, বড়আপা, মেজোফুফুসহ যে যত মেয়ের ছবি তাকে ফেইসবুকে বা হার্ডকপিতে দেখিয়েছে, তাদের মধ্যে নিশাই বেস্ট ছিল।
“এখন উল্টো কথা বললে ব্যাপারটা কেমন হবে?”
দুটো ক্যাপাচিনো একটা লাতে রেখে যায় ওয়েটার, আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে ফয়সাল বলে, “এক বোতল পানি, প্লিজ”। নিশা তার বড় ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে গিয়ে থেমে যায়, সম্ভবত তার ব্যাগে একটা পানির বোতল আছে। কিন্তু সেটা অফার করা উচিৎ কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না।
“তাহলে বলবেন আমার অ্যাজমা আছে, আপনি চান না অ্যাজমা রোগী কারো সঙ্গে সম্পর্কিত হতে, এটা একটা জিনেটিক্যালি ইনহেরিটেড ডিজিজ”
ফয়সাল বুঝতে পারে এই ব্যাপারে নিশার সঙ্গে বেশি কথা বলে তাকে আরও বিব্রত করার কোন অর্থ হয় না। তার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা বাসায় জানাবে না, নিজে নিরাপদে থেকে সম্বন্ধ বাতিল করতে চাইছে সে। কিন্তু সেটা এত পরে কেন? সে নিজে কি বাসায় বলতে পারছে না যে ফয়সালকে
তার পছন্দ হয়নি?
“আপনিই বরং বলে দিন না যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি”
“আমার কথার তোয়াক্কা তারা করলে তো ভালই ছিল, স্টুডেন্ট লাইফে বিয়ে করা যে একটা ব্যাকডেটেড ব্যাপার সেটাই তো তারা বোঝে না”
ফয়সাল সামান্য বিব্রত বোধ করে। তার বড় বোনেদের বিয়ে যখন হয়েছে তখন সে সবে হাইস্কুলে।বিয়ের সম্বন্ধ তাঁদের জিজ্ঞেস করে করা হয়েছিল কিনা, দুলাভাইদের সঙ্গে তাঁদের দেখা করিয়ে মতামত নেওয়া হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে সে একেবারেই অবগত নয়।

ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার থেকে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল মিমির সঙ্গে। তারা একই সাথে লাইব্রেরিতে যেতো, ল্যাংগুয়েজ কোর্স করেছিল, ক্লাসে অধিকাংশ সময় এক সঙ্গেই বসতো। কেউ কখনো প্রেমের কথা একে অন্যকে বলেনি কিন্তু ঝগড়াবিহীন সেই কোমল বন্ধুত্বকে বাইরে থেকে প্রেম বলে মনে হতো। থার্ড ইয়ারে ওঠার পড় মিমির বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করা হলো। তার বাবার বেশ বয়স হয়েছে, হজ্বে যাবেন। বিবাহযোগ্যা মেয়ের বিয়ে না দিয়ে নাকি হজ্ব করা যায় না। উনার আবার শরীরও বেশি ভালো না, ডায়বেটিস আর কিডনি সংক্রান্ত নানা জটিলতা আছে। থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি মিমির বিয়ে হয়ে গেলো। মিমির সঙ্গে তার বন্ধুত্বে ভাটা পড়েনি সেটা ঠিক।

কিন্তু ক্যাম্পাসে সারাক্ষণ জোড়া ধরে ঘোরাঘুরিটা কমে গেল নিজে থেকেই। ক্লাস শেষে মিমি চলে যেতো তার বেইলি রোডের শ্বশুরবাড়িতে। সহপাঠীরা দুইএকজন কানাঘুষা করলেও ফয়সাল বা মিমির সামনে এ নিয়ে কেউ কখনো কিছু বলেনি। বলার কথাও নয়, তারা ট্র্যাডিশনাল প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল না, জন্মদিন বা ভ্যালেন্টাইন্সডে জাতীয় বিশেষ দিন উদযাপন করতেও কেউ কখনো দেখেনি তাদের। তারা সবার সঙ্গেই মিশত, কিন্তু দুজনেরই মনে পরস্পরের জন্য বিশেষ জায়গা রাখা ছিল।ফয়সালের তখন প্রেম বা বিয়ের মতন ব্যাপার মাথায় না আসলেও মিমির বিয়ে ঠিক হবার পর তার খুব বিষণ্ণ লেগেছে কিছুদিন। মিমির মতন বন্ধু সারাজীবন পাশে থাকলে, জীবনের সকল সুখ-দুঃখ তার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারলে ব্যাপারটা কী চমৎকার হতে পারতো। কিন্তু ব্যাপারটা হার্টব্রেকের পর্যায়ে যায়নি, আর দূরবর্তী কানাঘুষা বা অন্য বিভাগের সহপাঠীদের বিস্ময়সূচক অভিব্যক্তি ইগনোর করাটাও কঠিন কিছু ছিল না।
সেই কফিশপে বসে নিশা আর তার প্রেমিকের জন্য মায়াই হয়েছিল তার, ওদের জায়গায় মিমিকে আর নিজেকে যেন দেখতে পাচ্ছিল। বাসায় ফিরে সে বড় ফুফুকে ফোন করে জানালো এখুনি দিনতারিখ ঠিক করার দরকার নেই, তার অফিসে কিছু জটিলতা চলছে, সে ছয়মাস সময় চায়। কথা এগিয়ে যাবার পর দিনক্ষণ ঠিক করার বদলে সময় চাওয়ার মানে ভদ্রভাবে ক্যান্সেল করে দেওয়াই ধরে নেওয়া হয়। ঘটকালির কাজটা যেহেতু ফুফুই করেছেন মূলত, এতদূর এগিয়ে মানা করে দেওয়াতে তিনি বেশ নাখোশ হলেন,খুব স্বাভাবিকভাবেই। আম্মা আর আব্বাকেও সে একই ধরনের উছিলা দিলো। বলল অফিস থেকে একটা ট্রেইনিং অফার করেছে, এর সঙ্গে প্রমোশন জড়িত। মেয়ের পরিবার চাইলে
অপেক্ষা করতে পারে, কিংবা না-ও করতে পারে। তার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই।


তিনমাস ধরে সে লোকজনকে এড়িয়ে যাচ্ছে এমন নয়, আত্মীয়স্বজন যে তাকে খুঁচিয়ে ছুটির দিনের বিনোদন নেবার জন্য ফোন করছে না সেটাও সে জানে। কিন্তু কুশলাদি বিনিময় হবার পরে ‘বিয়ের কথাবার্তা কতদূর’ এই প্রশ্নটি এলেই সে অপ্রস্তুত বোধ করছিল। মিমির বিয়ের পর একবার তাদের শিক্ষক ডক্টর ইমতিয়াজের কাছে যেতে হল, মিমি সঙ্গে ছিল না বলে স্যার বললেন, “কী ব্যাপার, আজকে তুমি একা যে?” সেদিন সে এমন অপ্রস্তুত হয়েছিল। সেই সময়ে সে এই ধরনের বিচ্ছিন্ন বিনা ইঙ্গিতের প্রশ্ন কিংবা শ্লেষপূর্ণ কৌতূহলী প্রশ্নগুলি দিয়ে মোটেও প্রভাবিত হয়নি, তার আলাদা করে মন খারাপ হয়নি, মিমির উপর রাগও হয়নি। মিমির সঙ্গে তার সাধারণের চেয়ে অনেকটা বেশি পর্যায়ের বন্ধুত্ব তার মধ্যে বাড়তি কোন প্রত্যাশা তৈরি করেনি, বিয়ের পর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াতে মিমির প্রতি সামান্য অভিমান তৈরি হয়েছিল, এইটুকুই। পরে সে নিজেই বুঝেছে, অন্য একটা পরিবারে জীবন প্রতিস্থাপিত হয়ে গেলে পরে জীবনযাত্রায় এটুকু পরিবর্তন আসবেই। মাস্টার্সে ভর্তি হবার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি নিয়ে সে নিজেও অনেকই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, ক্যাম্পাসে অত সময় সেও আর কাটাত না। মিমির অভাব বোধ করার অবকাশ তার তখনি শেষ হয়ে গেছিল।


কিন্তু নিশার প্রতি তার রাগ ক্ষোভ বিরক্তি, এমনকি অভিমান পর্যন্ত যা কিছুই তৈরি হয়েছে, সেগুলো আসলে সঙ্গত নয়, সে নিজেই বোঝে এ কথা। মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে তার আগে কেবল দুবার। প্রথমে মেজোফুফুর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে, সেদিন প্রথম তাকে মেয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় এই মেয়েটির বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে সে আগ্রহী কিনা। দ্বিতীয়দিন ফুফুর বাসায় তারাও গেলো আর নিশার বাবামাসহ নিশা গেলো। সেদিন সামনাসামনি ভালোভাবে দেখা হয়েছে। কোন সম্পর্কই যার সঙ্গে স্থাপিত হয়নি তার প্রতি অভিমান করবার অধিকার থাকেনা। এই যে এখন
কারো প্রশ্নের জবাবে নিশার তাকে প্রত্যাখ্যান করার সত্যিকারের কারণটা জানানো যাচ্ছে না, দায়সারা কোন একটা আবছা জবাব দিয়ে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে, প্রসঙ্গটা সামনে এলেই নিজেকে খানিক বোকা বোকা মনে হচ্ছে- এজন্য রাগ বিরক্তি অপমানের চেয়ে বেশি এক রকম অযৌক্তিক অভিমান তাকে আচ্ছন্ন করছিল। আগে কখনওই কোন মেয়ের পাণিপ্রার্থনা করে তার বাড়ি পর্যন্ত প্রস্তাব পাঠায়নি সে। এরেঞ্জড ম্যারেজের আইডিয়াটাই আসলে বাজে।

 

তবে ফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দেওয়ার চিন্তা সে হয়তো কখনওই করতো না যদি গতরাতে রুমানা তাকে নিশার বিয়ের ছবি না পাঠাতো। তার সদ্য বিয়ে হওয়া এই ফুফাতো বোন তার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্মানজনক দূরত্বের বড়ভাই-ছোটবোন লেভেলের। বিয়ের পর সে সম্ভবত নিজেকে মুরুব্বি গোছের, মাখালা পর্যায়ের গিন্নিবান্নি ধরনের
মানুষ বলে ভাবা শুরু করেছে। প্রথমে সে ফোন করে হড়বড় করে নিশার প্রতি কিছু রাগ বিরক্তি প্রকাশ করলো। সময় চাইবার পর তারা কেন অপেক্ষা না করে নিশার বিয়ে দিয়ে দিলো, যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে দেখতে শুনতে মোটেও ফয়সালের মতন নয়, মেয়ে মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ে,
এখুনি বিয়ে দেওয়ার কী এমন তাড়া ছিল, ইত্যাদি প্রভৃতি অভিযোগ সে করতে থাকলো- ফয়সাল বিরক্তি চেপে বলল সে ভীষণ ক্লান্ত, পরে কখনো কথা বলবে।


আজ শুক্রবারে আবার সেই ফোন আসবার আগেই সে ফোন বন্ধ করে রাক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। সকালে উঠে হোয়াটসঅ্যাপে সে রুমানার নম্বর থেকে পাঠানো ছবিটি দেখে। খুব আগ্রহ নিয়ে যে দেখেছে এমন নয়, কোন কৌতূহলও সে বোধ করছিল না। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার জাতীয় জিনিসগুলো সে ব্যবহার করে নিতান্ত জরুরি যোগাযোগের জন্য। এমনকি তার ফেইসবুকেও সে অফিসের বিভিন্ন গেট টুগেদার আর ইভেন্ট ছাড়া তেমন কিছুই আপলোড দেয় না। অত সময় তার নেই। নিশার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময়ে সে নিশার প্রোফাইল এক দফা ঘুরে
এসেছিল। সেখানে নিশার পাবলিকপোস্টে বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ ছবি, পিকনিক প্রেজেন্টেশন ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পায়নি বলে খুশি হয়ে গিয়েছিল। ফেইসবুকে অযথা সময় কাটানো সে নিজে পছন্দ করেনা, খামোকা ঢং করে সেলফি যদি সে দিয়েও থাকে, অন্তত আমজনতার দেখবার জন্য উন্মুক্ত করে রাখেনি বলে মেয়েটির প্রতি তার ভালোলাগা বেড়ে গিয়েছিল। রুমানার পাঠানো ছবি দেখে সে নিজের অজান্তেই বরের ছবির দিকে তাকায়। কফিশপে খাকি প্যান্ট আর কালো শার্ট পরা এলোমেলো চুলের ছেলেটিকে বরবেশে দেখতে না পেরে খুব বেশি অবাক বা বিস্মিত হয় না কেন জানি। ছবিতে বরটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ফয়সালের চেয়ে বয়সে বড় হবে। পাশাপাশি দাঁড়ালে যে কেউ ফয়সালকেই বেশি সুদর্শন বলে রায় দেবে হয়তো। যদিও সুদর্শন হওয়া নিয়ে ফয়সালের কোন আত্মম্ভরিতা কিংবা গরিমা নেই। শুধু তার তিন ফুফুর কাছ থেকে সে আশৈশব শুনে এসেছে তাদের কিশোরীকালের গল্প। তাঁরা নাকি সিনেমাহলে ববিতা আর ফয়সাল অভিনীত মিস লংকা ছবিটি দেখেছিলেন ফয়সালের জন্মের আগে। ভাইপো দেখতে নায়কের মতন হবে জেনেই নাকি তাঁরা তিনজন মিলে জেদ ধরেছিলেন যে এই ছেলের নাম ফয়সালই রাখতে হবে। তাঁদের এই গল্প ফয়সালকে
বিব্রতই করতো কৈশোরে। খালা আর ফুফুরা বোনপো ভাইপোদের নিয়ে অবসেসড থাকে। বিশেষত নিজেরা মা হবার আগে ভাইবোনদের সন্তানদের নিয়ে তারা নানা আদিখ্যেতা করে। নিজের লুক নিয়ে সে কখনওই সচেতনভাবে ভাবেনি। রুমানার করা মন্তব্যের কারণেই হয়তো, এই তুলনাটা এসে গেলো, সে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো তুলনাটা করে। পরক্ষণেই তার মনে হল, এই লোকটিকেও কি নিশা সহপাঠী প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে বিয়ে ক্যানসেল করার চেষ্টা করেছিল, নাকি
করেনি? একবার ইচ্ছা করে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করবে। সে বলেছিল তার পছন্দের তোয়াক্কা
করেনা তার পরিবার, কিন্তু একবারও বলেনি “আপনাকে পছন্দ হয়নি একথা বললে তাঁরা বিশ্বাস করবেন না” কিংবা “আপনাকে পছন্দ না হওয়ার কিছু নেই- আমার এফেয়ার আছে বলে আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না”। যে উপায়ে ফয়সালকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই একই উপায়ে একে মানা করতে পারলো না কেন? বা করলো না কেন? তাহলে কি পুরো ব্যাপারটাই একটা সাজানো
নাটক ছিল? আসলে ফয়সালকেই তার পছন্দ হয়নি? 

 

ফেইসবুকে লগ ইন করে সে দেখে আরও কয়েক
সপ্তাহ আগেই নিশা তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রেখেছে। হয়তো আদার বক্সে গেলে তার পাঠানো মেসেজও পাওয়া যাবে। ফয়সালের কোন আগ্রহ তৈরি হয়না, ব্যখ্যা চাইবার ইচ্ছাটুকুও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সে নিশার প্রোফাইলে ঢুকে তাকে ব্লক করে দেয়। প্রোফাইল পিকচারে তার নববধূর বেশে সালংকারা ছবি।