শতবর্ষ আগে
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই
রাজার রাজত্বে--
নইলে মোদের রাজার সনে
মিলব কী স্বত্বে?
গানটিতে আমার সবচেয়ে পছন্দের দুই লাইন হলো...
• আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার
ত্রাসের দাসত্বে--
• রাজা সবারে দেন মান, সে মান
আপনি ফিরে পান,
সারকথা হলো আপনি অন্যকে মান না দিলে
নিজে সম্মান পাওয়ার আশা করতে পারবেন না।
কলম্বিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে এসেছে ব্রাজিল। অপরদিকে আজকে ইকুয়েডরের সাথে ড্র এবং পরবর্তীতে ট্রাইবেকারে ৪-২ গোলে জিতে সেমিফাইনালে চলে এসেছে আর্জেন্টিনা। খেলায় লেজেণ্ড মেসি প্রথম কিকই মিস করেছেন।
ব্রাজিল ড্র করার দিনে আর্জেন্টাইন ফ্যানদের সেকি ভর্ৎসনা! ব্রাজিলের খেলা কোনো খেলা হলো? ওরা তো পাড়ার ফুটবলও খেলেনি। পাল্টা দিতে ব্রাজিল সাপোর্টারেরা মওকা পেয়ে গেছে আজ। উ! হারতে হারতে জিতছে আর্জেন্টিনা! তাও আবার ক্ষুদ্রদল ইকুয়েডরের সাথে। এরমধ্যে এক্সট্রিম পর্যায়ের কিছু ফ্যান আছে এমনভাবে কথা বলবে যে, তার ইনটেনশনই থাকবে গায়ে পড়ে ঝগড়া করা। অনেক প্রমাণ পেয়েছি, বাঙালি জাতিটাই এমন, অপোনেন্টের সাথে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া না করে থাকতে পারে না।
কেনরে ভাই, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর বা কানাডা ফুটবল খেলতে আসেনি? চেহারা দেখাতে মাঠে নামে তারা? তাই যদি মনে হয় আপনাদের তাহলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে রেখে বাকিদের নাম কেটে দেন। আমরাও দেখি কার সাথে খেলে ঠাটবাট দেখান, ফালতু বাগাড়ম্বর করেন। ওইপক্ষ ম্যারাডোনা, এইপক্ষ পেলে; অন্যের নিন্দা না করলে পেটের ভাত হজম হয় না আপনাদের?
আপনাদের প্রশংসা বা নিন্দা নিয়ে বসে আছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল? মাঠের খেলায় কতটা ঘাম ঝরাতে হয়, কিভাবে মাথা খাটাতে হয় তারাই জানে। আপনাদের মতো উদ্ভট ফ্যানরা কলম্বিয়া বা ইকুয়েডরের সাথে খেলে দিয়ে আসবে না।
আমাদের কথার সারবত্তা এটাই যে, পৃথিবী আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলই ভালো ফুটবল খেলে এই ধারণা ভুল। তাছাড়া অন্যদেশগুলো যদি ফুটবল দুনিয়ায় না থাকে কার সাথে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তাদের ভাব দেখাবে? ইউরোপের ক্লাবগুলোতে মেসি-নেইমাররা যদি খেলবার সুযোগ না পেতেন কোথায় এমন জাদুকরী ফুটবল প্লেয়িং শিখতেন? এই দুইটি দেশ অনেকবার অন্যদের কাছে হেরেছে, বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকা কাপ খুইয়েছে। তো যারা নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে হারায় তাদের প্রশংসা করবেন না? না করতে পারাটা মানুষ হিসেবে আপনারই মনস্তাত্ত্বিক দৈন্যতা।
যেদিন অন্যকে মর্যাদা দিতে শিখবেন। কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, কানাডা বা মরক্কোর নামও সসম্মানে মুখে নেবেন সেদিন দেখবেন ইকুয়েডরের সাথে হেরে গেলেও খারাপ বোধ হবে না। খুব সিম্পল, রণকৌশল, শক্তিমত্তা ও ভাগ্যের সহায়ে যারা জয়ী হবেন তাদের প্রশংসা করবেন। যারা বিজিত হবেন তাদের দুঃখবোধের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সহমর্মিতা জানাবেন। মানবিক সভ্যতা তো এটাই। আমি যার পক্ষ নিই সেই কেবল ভালো এমন চিন্তা তো টোটালি fascism বা authoritarian.
শত্রুর দুঃখেও যবে কাঁদবে আমার মন, তবেই না মানুষ নাম সার্থক হবে। কেন দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে থাকব আমরা? অতুল প্রসাদ সেন একান্তই আমাদের হোক না...
'সবারে বাস রে ভালো,
নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।
আছে তোর যাহা ভালো,
ফুলের মতো দে সবারে।'
বরাবর যারা দেখে নিতে চায়
তারা আর দেখা করতে আসে না। অথবা আসতে পারে না। তারাপদ রায়ের 'দেখো নেবো' কবিতাটা আরেকবার
পাঠ করুন না প্লিজ।
ভর সন্ধ্যেবেলা যারা গলির মোড়ে পথ আটকিয়ে
‘দেখে নেবো’ বলে চলে গিয়েছিল,
তারা আর দেখা করতে আসেনি-
কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর পরস্পর জানা গেল
কারা যেন তাদেরই দেখে নিয়েছে।
বছরের পর বছর চলে গেল।
সেই একই কাঠের চোয়াল,
সেই বুড়ো আঙুলের মতো মোটা তর্জনী,
‘দেখে নেবো', শাসাতে শাসাতে
দলের পর দল লোক নিকেশ হয়ে গেল।
দলের পর দল লোক দল বদলালো,
দলের নাম বদলালো
বারবার এসে শাসিয়ে গেল, ‘দেখে নেবো'।
তারা কেউ আর দেখা করতে এলো না।
লেখক: সাংবাদিক
৫ জুলাই ২০২৪