[এক]
ঈদের ঠিক আগের দিন। সূর্যের প্রখরতা এত বেশি যে মাথা সোজা করে হাঁটাটাই দায়! আমি জিরো পয়েন্ট থেকে হেঁটে হেঁটে প্রথমে গিয়েছি সিটি স্কুলে।আমার শৈশবের প্রথম বিদ্যাপীঠ। সেখানে যাওয়া মুলত স্কুলের প্রধান শিক্ষক আকবর হোসাইন সাহেবের সাথে দেখা করা। আমাদের সময়ে আরো অনেক স্যার ম্যাডামরা ছিলেন যারা এখন আর নেই। সময়ের ব্যবধানে গত হয়েছেন নিজ নিজ প্রয়োজনে। বিশেষ করে করোনার প্যন্ড্যামিক চলাকালীন সময়ে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কর্মস্থলে।
আমাদের সময়কার শিক্ষকদের মধ্যে শুধুমাত্র এখন হেডস্যার সহ একজন ম্যডাম আছে। উনার নাম নাজরিন ম্যাডাম। থ্রি- ফোরের বিজ্ঞান ক্লাসের পড়া পারার আনন্দ আর না পারার বেত্রঘাত সহ আরো কঠোর কঠোর শাস্তি গুলোর কথা মনে পড়ে।
স্যারের সাথে অনেক গুলা বিষয় নিয়ে আলাপ হলো। কিছু বিষয়ে পরামর্শ পেলাম। এখন অনেক কিছুই উন্নত হয়েছে। স্কুলের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। রয়েছে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা। আমাদের সময় এত কিছু ছিলো না।
স্কুল থেকে বের হয়ে আমার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে দেখা করে উপজেলার দিকে হাঁটা ধরি। জায়গা গুলো একটার সাথে একটা খুব কাছাকাছি, তাই হেঁটেই চললাম। রোদের তীব্রতা এমন যেন মাথা ঘুরে এখনই পড়ে যাবো। কোনো মতে গিয়ে পৌছালাম গন্তব্যে। গিয়ে দেখি যে কাজের জন্য আসছি তা এখন করা সম্ভব নয়।
পাশের দোকান থেকে একটি কেক আর একটা পানীয় নিলাম। আবার চলে যেতে হবে জিরো পয়েন্ট। এবার আর হেঁটে আসা সম্ভব না। রিকশার জন্য দাড়ালাম কিছুক্ষণ। মিনিট তিনেক দাড়িয়ে থাকাও দায়। রোদে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি দাড় করাতে চাইলাম কিন্তু দাড়ালো না! অবশেষ একটা রিকশা পেলাম। ছেলেটা দেখতে আমার বয়সি। চুল গুলো কেমন রং করা আর উসকো খুসকো। তার রিকশায় ব্রেক নেই। তাই আমর স্বস্থান থেকে আরো দশ বিশ হাত দূরে গিয়ে রিকশা থামালো।
আমার সাথে পথ মাঝে বাড়ির পাশের একজন বড় ভাইের দেখা। উনাকেও উঠিয়ে নিলাম রিকশায়। এরমাঝে ছেলেটার সাথে কিছু কথা হলো। বাজারের পশ্চিম মাথায় এসে নেমে গেলাম আমি ।
এখানকার নির্ধারিত ভাড়া হলো বিশ টাকা। আমি বিশটাকা দিতে চাইলে সে ঈদ উপলক্ষে আরো দশ টাকা বেশি চাইলো। আমি ত্রিশ টাকা দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম হবে?
—হুম।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝে আরো দশ টাকা দিলাম।
তার মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাঁসি। সে হাঁসি বড়ই মধুর। দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম হবে তো?
বিনিময়ে তার রোদ্রে জ্বলজ্বলে মুখে আবারো ফিরিয়ে দিলো এক রাশ মুগ্ধতা। আমার দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেঁসে দিলো।
—ঠিক আছে ভাই, দেখা হবে এই বলে চলে আসলাম। সেও আমার কথায় সায় দিলো।
আমার মনে হয়েছে সে দশ টাকা বেশি পেয়ে যে পারিমান খুশি হয়েছে কাউকে হাজার টাকা দিয়েও এমন খুশি করানো যাবে না।
বিশেষ করে ঈদের মতো উৎসব মুখর মুহূর্ত গুলোতে তাদের নিজের জন্য, পরিবারের, আপন মানুষের জন্য চোখ মুখ ভরা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্ন গুলো পুরনের জন্য থাকে কয়টা টাকা বেশি কামানোর আকাঙ্খা।
[দুই]
আজকে সকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি। সেখান থেকে আসতে আসতে প্রায় দুপুর একটা বেজে গেছে। তাই আজকে ইংরেজি ক্লাসে যাবো কিনা চিন্তা করছিলাম। ততক্ষণে মনে পড়লো আজকে নদীর পানিতে গোসল করে এসেছি। নাদীর স্বচ্ছ পানি। এই গরমে এক টুকরো স্বস্তির জায়গা। গরম বেশি পড়লেও শরীর ও মন দুটোই ফ্রেশ লাগছে।
তাই ভাবলাম আজকে ইংরেজি ক্লাসে যাবো।খেতে বসে দেখি একুশ মিনিট আগে এক বড় ভাই কল দিয়েছে। তাকে কল ব্যাক করলাম। তিনি জানালেন তার সাথে মিট করতে হবে ঠিক বিশ মিনিট পর। ইমার্জেন্সি।
উনার সাথে কথা শেষ করতে প্রায় দুইটা বারো মিনিট বেজে গেলো। এদিকে আমাকে দুইটা বিশ'র বাস টা ধরতে হবে। না হয় অনেক দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই আমার দেরি হয়ে যায় বেশিরভাগ সময়। স্যার গত ক্লাসে ওয়ার্নিং দিয়েছিলো! আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
হঠাৎ দেখি সেদিনের সেই রিকশাওয়ালা ভাই টা। খুবই ধীর গতিতে চালিয়ে আসছে। রিকশা থামিয়ে বলে, কই যাইবেন?
বললাম, সোনাগাজী। উঠে তার সাথে একটু কথা বলতেই চিনে ফেললো আমাকে।
আমি বললাম ভাই গাড়িতে কি চার্জ নেই? একটু জোরে চালানো যাবেনা? সে বললো চালানো যাবে আমি এমনিতেই গাড়ি একটু আস্তে চালাই। পরে বুঝলাম রিকশা আস্তে চালায় না, আসলে তার রিকশায় ব্রেক নেই! আমার কথায় সে গাড়ির সমস্ত শক্তি দিয়ে চালাচ্ছে। আমি আরেকটু উৎসাহ দিলাম, বললাম ভাই আমাকে দু'টা বিশের বাসটা ধরতে হবে, এখন বাজে দুইটা আঠারো । ঐদিন মাত্র ১০-১৫ সেকেন্ডের জন্য একটা বাস মিস করেছি। সেই ভয় এখনো আছো। ছেলেটা আরো জোরে চালাতে লাগলো। বিশের বাস টা ধরার জন্য রীতিমতো সেও কম্পিটিশনে পড়ে গেলো।
স্বাভাবিককত আমি রিকশায় চলাচল করি না। আর আজকে সকালে ঘুরতে গিয়ে প্রায় সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাই কোনো মতে আব্বার থেকে গাড়ি ভাড়া গুলা নিয়ে আসছি।
অবশেষে দুই টা বিশের বাসটা পেলাম। আমি বিশ টাকার একটা নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম ভাই আজকে টাকা নেই। অন্য সময় দেবো। সে একটু হাসলো। বললো সমস্যা নাই ভাই। মনে হয় আপন হাসি।চিরোচেনা ভালোবাসার বন্ধন।
আপনার নাম কি ভাই?
মুখে হাসির রেশ নিয়ে বললো- পারভেজ
আমি পারভেজের পিঠের উপর হাত রেখে বললাম ঠিক আছে ভাই দেখা হবে। সেও হাসলো।
ওদিকে বাসের কন্টাক্টর ডাক দেয়াতে উঠে গেলাম বাসে। বাস চালু দিতেই দেখি পারভেজ রিকশা ঘুরিয়ে দাড়িয়ে আছে বাসের দিকে চেয়ে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সেও আমাকে দেখলো। মুখ ভর্তি মুগ্ধতা নিয়ে হাত নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানলো। সেই হাসির আড়ালে যেন অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আমিও হাত নাড়ালাম। আর অবাক হলাম।
তার এমন ভালোবাসায় আমি কলম ধরতে বাধ্য হলাম তাকে নিয়ে লেখার জন্য। ভালোবাসা সবাই দিতে এবং নিতে জানে হোক সে ধনী অথবা গরীব। আমরা মানুষের ভালোবাসা ততক্ষণ পর্যন্ত অনুভব করতে পারিনা যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে ভালোবাসতে পারিনা।
~বাদশা ফাহাদ
চার | সাত | তেইশ