পোস্টস

গল্প

নীরব উপন্যাস

৭ জুলাই ২০২৪

ভোঁতা পেন্সিল

শাহেদ ঘরের কোনায় বসে কান্না করছে । ঘরের বাতি , দরজা বন্ধ । বক্সে গান বাজছে , সে আওয়াজে শাহেদের কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে । শাহেদ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে এখন কি করবে । মাথায় কোনো আইডিয়া আসছে না । শাহেদ কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে অন্ধকার ঘরের কোনায় ই ঘুমিয়ে পড়েছে । 
শাহেদ সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা দিয়েছে । বিশ বছর বয়সের চুপচাপ , শান্ত ও অত্যন্ত ভীতু স্বভাবের ছেলে শাহেদ । মানুষের সাথে খুব একটা মিশে না । বন্ধু বান্ধব হাতেগোনা কয়েকজন । গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে  ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরেছে । কয়েকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠবে । শাহেদের সেই ছোটবেলার অভ্যাস হলো সে প্রতিদিন বিকালে একা একা  পুঁকর পাড়ের রাস্তায় বসে থাকে , সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফিরে যায় । ঐ সময়ে তার পুকুর পাড়ে বসে থাকা নিয়ে কতজন কত কথা বলে , কিন্তু শাহেদ কারো কথা গায়ে মাখে না । গতকাল বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে তাই পুকুর পাড়ে বসে একাকী আড্ডা দেয়া হয়নি তার । আজ বিকালে গিয়েছিল সেই পুকুর পাড়ে ,কিন্তু আজ বাড়ি ফিরতে কিছুটা দেরি হয়েছে । এখন শাহেদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । কয়েক দিন বাড়িতে থাকার কথা থাকলেও পরদিন সকালেই সে রওয়ানা দেয় শহরে ।
মাস হতে চলল শাহেদ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে । বাবা মা বাড়ি আসতে বললেও শাহেদ বাড়িতে আসতে চায় না । শাহেদ কে যেদিন তার বাবা মা বাড়িতে আসতে বলে ঠিক তার পরের রাতে শাহেদদের পাশের গ্রামের এক ছেলে খুন হয়েছে । খুব নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে তাকে । চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে , লজ্জাস্থান কেটে ফেলা হয়েছে । হাত পা ভেঙে ফেলা হয়েছে । মৃত ছেলেটি এলাকার চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে । চেয়ারম্যানের ছেলে বলে একটু অন্যরকম চলাফেরা তার । কিছুটা উগ্র স্বভাবের । কিন্তু , সে অতটাও উগ্র স্বভাবের নয় , যার ফলস্বরূপ তাকে কেউ এত নৃশংস ভাবে খুন করবে । তার এ উগ্র স্বভাব কারো কাছে খুব একটা সমস্যা মনে হয় নি কখনও । শাহেদ তার বাবার মুখে খুনের বর্ণনা শুনে ভয় পেয়েছে । সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে ফোনের এপাশে থাকা শাহেদের বাবা । এই মুহূর্তে শাহেদ কে বাড়িতে আসতে নিষেধ করছে শাহেদের বাবা । শাহেদকে নিজের খেয়াল রাখতে বলে , ফোন কেটে দিলো । সে মাসেই চেয়ারম্যানের ছেলে ও তার বন্ধু বান্ধব মিলে পাঁচ জন খুন হয় । সবাইকে একইভাবে খুন করা হয়েছে । এলাকায় সবাই এখন খুব ভীত হয়ে পড়ছে । পুলিশ ও এর কোনো সুরাহা করতে পারছে না । খুনি কে এখনও খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়নি তারা । এলাকায় পুলিশের টহল বেড়েছে কয়েকগুণ । ভয়ে কেউ কেউ অন্য এলাকায় গা ঢাকা দিচ্ছে । ঠিক এমন সময়ে বাড়িতে আসে শাহেদ । আর সে রাতেই খুন হয় চেয়ারম্যানের ছেলের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু । তার খুনও একইভাবে হয়েছে । 
পরদিন সকালে এলাকায় আবার পুলিশ আসলো । পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লাশ তদন্তের জন্য থানায় নিয়ে গেল । পুলিশ থানায় যাওয়ার কিছুক্ষন পর একটা নাম্বার থেকে ফোন আসলো ওসি সাহেবের নাম্বারে । ছেলেটি ওসি সাহেব কে বলছে ," আমার কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনুন । আপনি সবার থেকে একটু দুরে বসে , শান্ত হয়ে আমার কথা গুলো শুনুন । আপনার মেয়ে আর বেঁচে নেই । সে গত দুই মাস আগেই মারা গেছে । তার লাশ গুম করা হয়েছ । আমি যা বলছি শুনুন আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না । আপনার মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে । সে কোথাও পালিয়ে যায় নি বা হারিয়ে যায় নি । তাকে খুঁজে আর কোনো লাভ নেই । খুশির খবর হলো , আপনার মেয়ের ধর্ষণকারী ও হত্যাকারী সবাই এখন মৃত । তাদের খুন করা হয়েছে । সবাই তাদের শাস্তি পেয়েছে । আরো একটা খুশির খবর হলো , আপনি গত এক মাসে খুন হওয়া যে কেস গুলো নিয়ে তদন্ত করছেন তার খুনি কে ধরতে চাইলে আমার বলা ঠিকানায় চলে আসুন । কিন্তু , কষ্টের কথা হলো , আপনি নিজের মেয়ের ধর্ষণকারী এবং হত্যাকারীদের খুনের তদন্ত করছেন । ফোন কেটে দেয়ার আগে ছেলেটি একটি ঠিকানা বলে ওসি সাহেবের কাছে । "  ওসি সাহেব ছেলেটির বলা ঠিকানায় একাই চলে যায় ।

পুকুর পাড়ের সেই রাস্তা থেকে একটু দূরে একটি নির্জন ভিটে বাড়িতে ভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে ওসি সাহেব দেখে একটি ছেলে সিগারেট খাচ্ছে । ওসি সাহেব কে দেখে শাহেদ বলল , আমি সেই খুনি যাকে আপনি ধরতে এসেছেন । ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন কেন তুমি ওদের খুন করেছো ? শাহেদ হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দিল , " এই পুকুর পাড়ে বসে থাকা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল । এই রাস্তা দিয়ে আপনার মেয়ে ও তার বন্ধু বান্ধবরা মিলে যাওয়া আসা করত । ওদেরকে কে সেই ক্লাস এইট থেকে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি । ওদের কারো প্রতি আমার কোনো ভালোলাগা বা ভালোবাসা ছিল না । সেদিন আমি ওখানে বসে ছিলাম । আপনার মেয়ে একা একা বাড়ি ফিরছিল । তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে । রাস্তা একেবারে নির্জন ছিল । আমার থেকে কিছুটা সামনে আগ বেরোতেই আপনার মেয়েকে চেয়ারম্যানের ছেলে ও তার বন্ধুরা মিলে হাত মুখ বেধে এই বাড়িতে এনে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে । আমি ওদের অনুসরণ করে এখানে এসেছিলাম । আড়ালে লুকিয়ে সব দেখা স্বত্বেও আমি সেদিন কিছু করতে পারিনি । কারণ , আমি তখন খুব ভীতু ছিলাম । কিন্তু , তার মৃত্যুর পর আমি উপলব্ধি করলাম আমার খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলেছি আমি । আমি তাকে কখনও ভালবাসি বলিনি , আমাদের কোনো সম্পর্কও ছিল না । কিন্তু , আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল সে আমার খুব আপন । সেই শোক সামলাতে আমি পরদিন ই এলাকা ছেড়ে শহরে চলে যাই । কিন্তু , তার ধর্ষণকারী এবং হত্যাকারীদের কে শাস্তি দিতে না পারার অপরাধবোধ আমাকে ধীরে ধীরে হিংস্র করে তুলেছিল । তাই , রাতের আধারে শহর থেকে এলাকায় এসে ওদের হত্যা করে আবার রাতেই ফিরে যেতাম শহরে । কিন্তু , শেষ খুন টা করার আগে মনে হলো সবার চেয়ে ওর একটু বেশি শাস্তি হওয়া প্রয়োজন । কারণ , আপনার মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার পেছনে ওর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল । তাই বাড়িতে এসে ওর খুন টা করলাম । একটু সময় নিয়ে ওর মৃত্যুটা কার্যকর করলাম । আমার গল্প শেষ , এখন আপনি আপনার কাজ করুন । " 
ওসি সাহেব শাহেদ কে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো , আর বলল তুমি শহরে ফিরে যাও , ভালো করে পড়ালেখা করে বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করো । শাহেদের কপালে একটি চুমু দিয়ে ওসি সাহেব থানায় ফিরে গেলেন ।