পোস্টস

প্রবন্ধ

জেনারেশন গ্যাপ

৭ জুলাই ২০২৪

ড. মো. আব্দুল হামিদ

মূল লেখক ড. মো. আব্দুল হামিদ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পরিবারের অমতে তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করে আকস্মিক বউ নিয়ে বাড়িতে হাজির হন। এতে তার পরিবার বিশেষ করে বাবা ভীষণ ব্যথিত হন। ঢাকায় ফিরে রুদ্র নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বাবাকে এক পত্র লেখেন। তাতে পিতার সঙ্গে তার মতপার্থক্যের বিষয়টি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন, একটি জেনারেশনের সঙ্গে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল ও দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার সঙ্গে আপনার আব্বার অমিল ছিল, আপনার সঙ্গে আমার এবং পরবর্তী সময়ে আমার সঙ্গে আমার সন্তানদের। এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়।

হয়তো সে কারণেই বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক পরিবারে নবীনদের সঙ্গে প্রবীণদের মতপার্থক্য প্রবল হচ্ছে। এক পক্ষের পছন্দ, রুচি, জীবনযাপনের ধরন, অগ্রাধিকার ইত্যাদি অন্যদের কাছে শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় মাঝেমধ্যে তা অসহ্য হয়ে উঠছে।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সংকটগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে তা নতুন রূপ ধারণ করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঠিক সেভাবে চিনতে ও বুঝতে পারছে না। একই ছাদের নিচে বাস করে, একই হাঁড়ির খাবার খেয়ে, ধর্ম-বর্ণ-জাতীয়তা সব একই থাকার পরও প্রজন্মগুলোর পার্থক্য সত্যিই বিস্ময়কর, তাই না?

সাধারণত দুই প্রজন্মের মাঝে ব্যবধান থাকে ২০-২৫ বছর। ওই সময়ের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষাপদ্ধতি, চিকিৎসার ধরন, পোশাক পরিচ্ছদ, বিনোদন উপকরণ, পরিবারের গঠন, ধর্মীয় চর্চা, সামাজিক রীতিনীতি, গণমাধ্যমের বৈশিষ্ট্য, অর্থ ব্যবস্থাপনাসহ অধিকাংশ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ফলে একই বিষয়কে ভিন্নভাবে গ্রহণ ও ব্যাখ্যা করার প্রবণতা দেখা যায়।

ভিন্ন প্রজন্মের লোকদের অধিকাংশ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পার্থক্য হয়। এক পক্ষ যেটাকে আইডল হিসেবে গ্রহণ করে অন্য পক্ষ তার মধ্যে ন্যূনতম কারণ খুঁজে পায় না। যেমন বর্তমান কিশোর-কিশোরীরা টিকটকে বুঁদ হচ্ছে, সারা দিন সেটা নিয়ে পড়ে থাকতে চেষ্টা করছে। অথচ তাদের অভিভাবকরা বহু চেষ্টা করে (ইতিবাচক মনোভাব নিয়েও) সেটার মধ্যে তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারছেন না!

আমরা জানি বয়সের গ্যাপ ভিন্ন মানসিক গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। হয়তো সে কারণেই পরিবারের বড় সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার চিন্তায় বেশ মিল দেখা যায়। ছোটদের ভাবনায় বিচ্যুতিগুলো প্রায়ই চোখে পড়ে।

বয়সের পার্থক্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোর-তরুণদের মনোজগতে ভিন্ন বোধের সৃষ্টি করে। সঙ্গে প্রযুক্তিপণ্যের কল্পনাতীত বিস্তার সেই পালে তীব্র হাওয়া দিচ্ছে। এখনকার শিশুদের ম্যাচুরিটি লেভেল দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু বাবা-মা কিংবা পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা বিষয়গুলোকে ঠিক সেভাবে গ্রহণ করতে আগ্রহী নন। ফলে দ্বন্দ্বের আওতা ও গভীরতা দুটোই বাড়ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষিত সমাজে ক্যারিয়ার ও বিয়ে সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন। বোঝার সুবিধার্থে ভাবুন, আমাদের দাদা ও বাবার বয়সের পার্থক্য ছিল ২০-২২ বছর। বাবার সঙ্গে বড় ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য ছিল ২০-২৫ বছর। অর্থাৎ মাত্র ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে দুই প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছিল।

কিন্তু আমাদের সময়ে এসে হঠাৎ করেই বড় ব্যবধান সৃষ্টি হয়। পড়ালেখা শেষ করা, প্রত্যাশিত ক্যারিয়ারে যাওয়া, চাকরির প্রাথমিক ধকল কাটানো, বিয়ের আয়োজন, নিজেদের মতো সময় কাটানো ইত্যাদি করতে করতে কখন যে বয়স ৩৫ পার হয়ে যাচ্ছে খেয়ালই থাকছে না। এর পরে সন্তানের চেষ্টায় আরো কয়েক বছর কেটে যাচ্ছে।

ফলে ৩৫-৪০ বছর বয়সে গিয়ে প্রথম সন্তানের জন্ম হচ্ছে। অর্থাৎ আগের দিনে মানুষ যেই বয়সে নাতি-নাতনির মুখ দেখত এখন সেই বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম হচ্ছে!

এটা ঈঙ্গিত করে যে আমাদের অজান্তেই মাঝখানে একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আগের দিনে পিতা-পুত্রের বা মা-মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গির যে পার্থক্য হতো এখন তা দ্বিগুণ বা তারও বেশি হচ্ছে।

সঙ্গে পরিবারের গঠন বদলে যাওয়া ও প্রযুক্তিপণ্যের সীমাহীন বিস্তার বিষয়টাকে আরো গোলমেলে করে ফেলছে। যেমন আগের দিনে রেডিও-টেলিভিশন ও চিঠির প্রভাব ছিল বহু প্রজন্ম ধরে। কিন্তু এখন এক প্রজন্মের প্রিয় বস্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছে।

এতে আমাদের ঐতিহ্যেও চিড় ধরছে। যেমন সম্প্রতি যে কয়টা বড় পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি কোথাও খাদ্য তালিকায় মাছ ছিল না। আয়োজকদের সঙ্গে আলাপে জানলাম, কিশোর ও তরুণ অংশগ্রহণকারীরা মাছ পছন্দ করে না। তাই তালিকা থেকে সেটা বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ আমরা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ বলে কতই না গর্ব করি!

বিষয়টা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আড়ালে-আবডালে সবাই সমবয়সীদের সঙ্গে উদ্বেগ শেয়ার করছে। মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানে অবিশ্বাস্য ও কল্পনাতীত সব পার্থক্য ঘটে গেছে। আমরা পিতার সঙ্গে যেমন আচরণ করতাম, আমাদের সন্তানেরা তার ধারে-কাছেও থাকছে না। তাদের আচরণ মাঝেমধ্যে বড় অচেনা লাগে।

অনেকে ভাবছেন, পারিবারিক শিক্ষা সন্তানদের যেন কিছুই শেখাতে পারছে না। মা-বাবার প্রত্যাশা থেকে সন্তানরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের আগামী দিনগুলোতে আরো কী কী ঘটবে তা নিয়ে অনেকেই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। অভিভাবক হিসেবে নিজেদের ব্যর্থ ভাবা লোকের সংখ্যাও কম নয়।

তবে এটা শুধু আপনার বা আমার নয়, বরং চারপাশে অধিকাংশ পরিবারের বাস্তবতা। কেউ কেউ মুখ ফুটে বলেন। নানা কারণে অধিকাংশই সেটা করেন না। নিজ পরিবারের সমস্যা অন্যদের বলে কী লাভ—এমন ভেবে অনেকেই নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন।

এমন মনঃকষ্ট নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করাই কি আমাদের নিয়তি? 

না, আপনার ভাবনায় উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ থাকলেও বিষয়টাকে ভিন্নভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। বিশেষত মার্কেটিংয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এমন পরিবর্তনের মধ্যে অনেকগুলো ইঙ্গিত লক্ষ করছি। সেগুলো সংক্ষেপে শেয়ার করতে চেষ্টা করছি।

পণ্যের ব্যবহার প্রবণতা মানুষের আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আগের দিনে একটা চিঠি লিখে মাসের পর মাস অপেক্ষা করা যেত। কিন্তু এখন মেসেজ পাঠানোর পর দশ মিনিট অপেক্ষা করা কঠিন হয়। আগে দুই দিনের বাসি সংবাদপত্রও তৃপ্তি নিয়ে পড়া যেত। এখন ফ্রেশ সংবাদপত্রেরও সব খবর বাসি মনে হয়।

আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে, ক্ষুধা-পিপাসা নিয়ে গন্তব্যে যাওয়া যেত। এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও সামনে পানির বোতল সাজানো থাকতে হয়। আমাদের শৈশবে দর্জির কাছে জামার মাপ দিয়ে পনেরো দিন মতো অপেক্ষা করতে হতো। এখনকার তরুণেরা শোরুমে গিয়ে পছন্দের টি-শার্ট গায়ে দিয়ে চলে আসে।

আগে সাপ্তাহিক নাটক দেখার জন্য সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করা যেত। অথচ এখন দিনে কয়েকটা নাটক দেখা যায়। এভাবে আমরা নিজেরাও ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’-এর মতো তাৎক্ষণিক সেবা পেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমরা পরবর্তী প্রজন্মের বদলে যাওয়া গভীরভাবে খেয়াল করলেও নিজেদেরগুলো সেভাবে লক্ষ করছি না।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের এমন কালচারের মধ্যেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ফলে তাদের স্থিরতা বা ধৈর্য কম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সবকিছু রেডিমেড পেতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমরা কয়েক সপ্তাহ ধরে একটা উপন্যাস পড়ে বা ৩ ঘণ্টার সিনেমা দেখে একটা বিষয়ে মজা পেতাম। এখন তারা এক মিনিটের কম সময়ের ইউটিউব শর্টস বা ফেসবুক রিল দেখে সেটা করে থাকে।

আবার ভাবুন, আমাদের প্রজন্মে দেশ-বিদেশের কিছু কমন হিরো ছিল। এখনকার শিশুরা সহপাঠী বা বন্ধু হওয়ার পরও পরস্পরের হিরোকে সেভাবে চেনে না। তাদের এত বিচিত্র বিনোদন উপকরণে প্রবেশাধিকার রয়েছে যে একজন যার ক্রেজি ফ্যান অন্যজন হয়তো তার নামই শোনেনি!

এভাবে তারা প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের চিন্তা ও তার প্রকাশের ধরন ভিন্ন হবে সেটা অস্বাভাবিক নয়।

অনেকে সন্তানদের কল্যাণ কামনায় সেগুলো থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে একেবারে নিজেদের মতো করে তাদের বড় করতে চান। এটা নিজের কাছে উত্তম বা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে সন্তানের জন্য কল্যাণকর হবে কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে তেমন মানুষদেরই পাবে যারা বর্তমান অস্থির ধারায় বড় হচ্ছে।

ফলে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, লেনদেন করতে হবে, বিয়েশাদিও করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু আপনার সন্তানকে ধরে রাখার মধ্যে খুব একটা সমাধান হবে বলে আশা করা যায় না। পরিবর্তনের গতি ও ধারার সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না শিখলে বরং বড় হওয়ার পরে প্রতি ধাপে তারা সমস্যায় পড়বে।

এক্ষেত্রে বলতে পারেন, তাহলে কি হাল ছেড়ে দেব কিংবা হাত গুটিয়ে বসে থাকব? আসলে এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় অনেক কিন্তু সামর্থ্য সীমিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সামগ্রিক পরিবেশ সুন্দর করা দরকার।

কাজটি এককভাবে করা প্রায় অসম্ভব। আবার চারপাশে সবাইকে নিয়ে করার মতো পরিবেশও খুব একটা অনুকূল নয়। কারণ আপনি যেভাবে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবছেন আপনার প্রতিবেশী অনেকেই হয়তো সেটা করছেন না। ফলে আপনার একার তেমন চেষ্টা খুব বেশিদিন চালু রাখা কঠিন হবে।

এক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর হয়। শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠাকে সুন্দর ও যুগোপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

উন্নত দেশগুলো প্রতিনিয়ত সেই জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মসৃণ অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দেয়। আমাদেরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, নইলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।