পোস্টস

চিন্তা

হিতবাদী মানুষের আশা জাগছে, পিছু হটছে দক্ষিণপন্থা

৮ জুলাই ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

উগ্রপন্থা পৃথিবীর কোথাও কোনোদিন একফোঁটা স্বস্তি দেয়নি। তারপরও বেশ কয়বছর উগ্র বা মধ্য ডানপন্থিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেখল বিশ্ববাসী। তাতে দুনিয়ার কিছুই বদলালো না। মাঝখান দিয়ে বেড়ে গেল হিংসা, হানাহানি ও যুদ্ধ। ধর্মের নামে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর বাড়ল দমনপীড়ন। ২০২৪ সালে এসে পূর্ব পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনে চরম ডানপন্থী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতা খর্ব করার মধ্য দিয়ে এই ধারা শুরু হয়েছে। মধ্যপন্থী কংগ্রেসের রাজনীতি প্রায় গিলে খেয়েছিল দক্ষিণপন্থী বিজেপি। এবার তাদের দর্পচূর্ণ করেছে ভোটারেরা। কংগ্রেসও শক্তিশালী বিরোধী দলরূপে আবির্ভূত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী মোদির মুসলিমবিদ্বেষ হালে পানি পেল না। প্রমাণ হলো রাষ্ট্র হবে সর্বমানুষের। তার ধর্ম একটাই তা হলো 'নিরপেক্ষতা'।

রক্ষণশীলতার চেয়ে ঔদার্য যে মানবসভ্যতার জন্য ভালো এটা ভোটারেরা আবার বুঝতে শুরু করেছে।

ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোটে বামপন্থী দলগুলোর সবচেয়ে বেশি আসন পেতে যাওয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে সমর্থকেরা।
৭ জুলাই এএফপি এমন খবরই দিয়েছে।

ওই সংবাদ সংস্থার বরাতে প্রথম আলো জানিয়েছে, ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‌্যালির (আরএন) জয় আটকানোর প্রচেষ্টায় সফলতা এসেছে বলেই আভাস পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাচ্ছে বামপন্থীদের জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিই)।

রোববার দেশটিতে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ শেষে বুথফেরত জরিপে এমনটাই বলা হচ্ছে। এরইমধ্যে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন নির্বাচনে অপর দুই প্রতিপক্ষ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জোট টুগেদার অ্যালায়েন্স এবং উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল র‌্যালির নেতারা। অপর দিকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাতে প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাম জোটের নেতারা।

৫৭৭ আসনের পার্লামেন্টে ১৭২ থেকে ২১৫টি আসন পেতে চলেছে বাম জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেতে যাচ্ছে মাখোঁর মধ্যপন্থী জোট টুগেদার অ্যালায়েন্স। তারা পেতে পারে ১৫০ থেকে ১৮০টি আসন। আর ১১৫ থেকে ১৫৫টি আসন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকতে পারে ন্যাশনাল র‌্যালি।

ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ইরানেও রক্ষণশীলরা পিছু হটেছে। রয়টার্স খবর দিয়েছে, কট্টর রক্ষণশীলদের থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংস্কারবাদী মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বেছে নিয়েছে ইরান। ধর্মীয় পোশাকবিধি লঙ্ঘন করার সাজানো অভিযোগে কুর্দি  তরুণী মাসা আমিনি কথিত নীতি পুলিশের হেফাজতে মারা যাওয়ার পর বছর দুয়েক আগে ইরানজুড়ে যে সংস্কারপন্থী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তারই যেন ছায়া দেখা গেল জনমতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর ওই জনগণকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করার প্রত্যাশা জানিয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হওয়া পেজেশকিয়ান।

একসময়ের সামরিক যোদ্ধা ও হৃদরোগবিশেষজ্ঞ পেজেশকিয়ান ২০০৮ সাল থেকে ইরানের পার্লামেন্ট মেম্বার। ইরানের কট্টরপন্থী সরকার ও ঘৃণ্য বিতর্কিত নীতি পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমালোচক তিনি।

সবাই আশা করছেন, পেজেশকিয়ানের আমলে ক্রমাগত চাপে থাকা ইরান হয়ত বিশ্ববাসীর সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে। পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কেরও উন্নতি হবে। তবে বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন কিংবা দেশের সংস্কারবাদীদের মুখরক্ষায় পেজেশকিয়ান ঠিক কতটা কাজ করতে পারবেন তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। কারণ ইরানের পররাষ্ট্রনীতি ও ইন্টারনাল স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলো সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পরামর্শে নেয়া হয়ে থাকে। তারপরও যে প্রত্যাশা নিয়ে সংস্কারবাদী ভোটারেরা মাসুদ পেজেশকিয়ানকে জয়ী করেছেন, সেই ভোটারদের মন হয়ত তিনি ভাঙবেন না। আমরা ফিলানথ্রোপিস্টরা সেই আশাই করি।

অপরদিকে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। এরমধ্য দিয়ে ১৪ বছরের কনজারভেটিভ দলের শাসনের অবসান ঘটল। কনজারভেটিভ দলের হয়ে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রক্ষণশীলতার ধারক ঋষি সুনাক। নাহ্, ক্ষমতা বদলালেই ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের রাজনৈতিক লিডাররা সহসাই আগের নীতি থেকে সরে আসেন না। তারপরও মানুষকে নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখাতে বদলটা জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রেও আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রিপাবলিকান পার্টির নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ভোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক দলের নেতা বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। বাইডেনের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প রক্ষণশীল ও ডানপন্থী। গণমাধ্যমেই খবর বেরিয়েছে, ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে স্টারমারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। এর আগে ট্রাম্প স্টারমারকে ততটা গুরুত্ব দেননি। দেশটির ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিলেন। যারা এবারের নির্বাচনে মাত্র ১৪ শতাংশ ভোট নিয়ে ৫টি আসনে জিতেছে।

বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে যারা বসবাস করছেন। অথবা অবৈধ অভিবাসী যারা তাদের কাছে ডানপন্থী ট্রাম্পের তুল্যমূল্যে জো বাইডেন অপেক্ষাকৃত ভালো।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হলে কিয়ের স্টারমার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে রাজি বলে জানিয়েছিল কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা। এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, লেবার পার্টি তাদের ইশতেহারে বলেছিল, আমরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যার ফলে একটি টেকসই ও সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরাইলসহ দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান হবে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিসহ সমস্ত জিম্মি মুক্তি ও গাজায় সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চায় লেবার পার্টি। এ সংঘাতের সমাধানের পক্ষে যুক্তরাজ্য। যদিও স্টারমার অতীতে ইসরাইলী আগ্রাসনকে সমর্থন করে এসেছেন। তারপরও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ব্যাপারে কনজারভেটিভ ঋষি সুনাক যেটা বলতে পারেননি লেবার পার্টির নেতা স্টারমার অন্তত ইশতেহারে ফিলিস্তিনিদের সেই অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন।

সৌদি আরবে শাসকগোষ্ঠী বদলের সুযোগ নেই। সেখানে গণতন্ত্র চর্চার পথ খোলা‌ রাখা হয়নি। তারপরও সৌদি শাসকরাও নানা পর্যায়ে রক্ষণশীলতা ছুড়ে ফেলে আধুনিক ও বাস্তবভিত্তিক নীতি গ্রহণ করছে। ধর্মীয় রিফরমেশনের কথা বলছে। নারীদের বাইরে যাওয়া, ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া হজ্বব্রত পালন করাসহ নানা অধিকার দিচ্ছে। এমনকি বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসক, উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তাসহ প্রতিভাধর বিদেশিরা সৌদি‌ নাগরিকত্বও পাচ্ছে এখন।

সবমিলিয়ে আমরা দেখছি বিশ্বজুড়েই এক ধরণের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ডানপন্থায় মুগ্ধ ভোটারেরা তাদের মতিগতি বদলে নিয়ে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীদের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করতে চাইছে।

বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা থাকলেও যে পৃথিবী সংঘাতে নিপতিত হয়নি এমন নয়। তবে তুল্যমূল্য বিচার করলে রক্ষণশীলদের চেয়ে সংস্কারবাদীরা ভালো। চিরায়ত বিধানে আটকে না থেকে আধুনিক ও যুগোপযোগী চিন্তা যদি রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকারিতা পায় সেটা জনকল্যাণে আরেকটু ভালো ভূমিকাই রাখতে পারে।

আমরা উদারনৈতিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পরিবর্তন, সংস্কার, প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার পক্ষে। ধর্মীয় বর্ম বা প্রাচীনপন্থার নামে মানবসভ্যতাকে জটিলতায় আটকে রাখবার কোনো মানে নেই। রক্ষণশীলতা ও ডানপন্থা মানেই প্রতিক্রিয়াশীলতা। প্রগতিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা এবার ছুটিতে যাক। আমাদের সমন্বিত আশারা জেগে থাকুক।

লেখক: সাংবাদিক
৮ জুলাই‌ ২০২৪