Posts

চিন্তা

কোটার কুঠারে কাটা না পড়ুক সুন্দরবন!

July 8, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

111
View

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা একজন মেধাবী সন্তানকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে ৫৬% কোটার সাথে লড়তে হয়। রইল থাকে ৪৪ ভাগ। ওই চুয়াল্লিশ ভাগও খেয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি। দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী কারা? নিশ্চিতই কোনো না কোনোভাবে কোটায় না পড়ারাই। তাহলে ওই মেধাবী প্রান্তিক মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধাগারে কী রাখা আছে। বিগ জিরো?

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন তথা পিএসসি ইতোমধ্যে আস্থা হারিয়েছে। চ্যানেল টোয়েন্টিফোর রীতিমতো ১২ বছর অনুসন্ধান করে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় চাকুরিদাতা সংস্থা পিএসসি নীতি ও নৈতিকতা বজায় রেখে চাকরি প্রত্যাশীদের অধিকার নিশ্চিত করে না। সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, গেল ১২ বছরে ক্যাডার ও নন ক্যাডার পরীক্ষার অন্তত ৩০টি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি প্রশ্নও ফাঁস করা হয়েছে। রেলওয়ে বিভাগের এযাবৎ ৫১৬টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই পেয়ে গেছে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রত্যাশীরা।
এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে পিএসসির উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক লেভেলের অন্তত ১২ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের পিএস, গাড়িচালক, পিয়ন এইসব অবৈধ কাজের নিবিষ্ট সহযোগী।

তাহলে আমরা নিশ্চিত ধরে নিতে পারি গেল ১২ বছরে নিয়োগ পাওয়া অনেক বিসিএস ক্যাডারই আছেন যাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও শক্তিশালী মামা খালুর জোর ছিল -তারা অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন দপ্তর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক বাস্তবতায় যে মেধাবী শিক্ষার্থীটি কেবলমাত্র নিজের মেধা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম দিয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসবে তার জন্য এই রাষ্ট্র কে রেখেছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে তার পেছনেও সাবসিডি হিসেবে রাষ্ট্রের লগ্নি কম নয়।

কোটা আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের সরকার প্রধান তথা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বলেছেন, কোটা আন্দোলন কেন হচ্ছে, এটা আদালতের ব্যাপার, আদালত রায় দিয়েছে সেটার বিরুদ্ধে কথা বলা কেন? এটাতো সাবজুডিস। আদালতের মাধ্যমেই আসতে হবে। তবে ২০১৮ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় পরিপত্রের মাধ্যমে কোটা বাতিল করায় কোটা সুবিধা পাওয়া নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।

অপরদিকে আজকে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক বলেই কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত রহিত করে দেয়া আদালেতের রায়ের প্রতি সরকারের এটর্নী জেনারেল আপিল করেছেন।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, বিচারাধীন বিষয়ে আন্দোলন না করাই ভালো। আন্দোলনকারীদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
তিনি গণমাধ্যমকে জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।

স্পষ্টভাবে এর মানে দাঁড়ালো সরকারি চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটা বহাল থাকবে নাকি আগের মতো বাতিল হবে অথবা সংস্কার করা হবে -সেটি পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার বলে সরকার জানাতে চায়।

সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়।

এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯-এর ৩ (ক) অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ কোটা সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়। ২০১৮ সালে অন্দোলনের মুখে সরকারি পরিপত্রের মাধ্যমে সকল কোটা বাতিল করা হয়। কিন্তু এইসময়টায় পিএসসি যাদেরকে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়েছে সেটি কোটায় নিয়োগ পাওয়ার চেয়ে বেশি নাকি কম, সেই পরিসংখ্যান এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।

নারী, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসী কোটা নিয়ে কোথাও খুব বেশি প্রশ্ন নেই। বেশি কথা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কোটা নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় বীর, তাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা কী বীর?

চাকরি পাওয়ার উপযোগী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এখনও যারা ৩২ বছরের নিচে আছে কোটা সুবিধা নাহয় তাদের জন্য থাকল, সেটা সর্বোচ্চ ১০ ভাগ হতে পারে। নাতিপুতিরা কেন কোটা সুবিধা পাবে? যদি পায় তাহলে এভাবে কয় জেনারেশন?

অনেকেই বলে বুয়েট টোটালি শিবিরের দখলে। ফি বছর ওই বুয়েট থেকেই ক্যাডার আসছে বেশি। শিবিরের আগের প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে বিচারিক সাজা পেয়েছে।

তো স্বাধীনতা বিরোধীরা যদি উচ্চতর মেধার স্বাক্ষর রেখে বুয়েট দখলে নিতে পারে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের তো এটা আরো ভালো পারা উচিত।

মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত উত্তরাধিকার স্বাধীনতাবিরোধীদের চেয়ে মেধাহীন -এটা কেন বিশ্বাস করব?

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুফতে পাওয়া সনদধারী মুক্তিযোদ্ধার ছেলে চলনে বলনে হয়েছে চোর, দুর্নীতিবাজ বা লুটেরা। মুখে আওয়ামী লীগ আর চলে স্বাধীনতাবিরোধী মাস্তান চক্রের সাথে। চিন্তায় টোটালি ফ্যানাটিক। আচারে বকধার্মিক। নানা ছুতোয় সহকর্মী‌ বা অধস্তনদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে যখন মন চায় তখন হজ্ব করে। মিথ্যায় মোড়ানো শরীর ও মন। ১০০টা কথা বললে তার ৯৯.৯৯ ভাগ কথা জঘন্য মিথ্যাচার। বাপের পরিচয়ে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। অবৈধ উপার্জনে সমাজে ঠাটবাট দেখিয়ে চলে। তাদের বিরুদ্ধে চারপাশের মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই।

আরেকজনের বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। বয়স কম ছিল। এই বাবার সন্তানেরা আপাদমস্তক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া আমাদের সংবিধানের Four fundamental principles: nationalism, socialism, democracy and secularism সজ্ঞানে ও সচেতনে মেনে চলে। এদের মধ্যে অসতা বা অসাধুতার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। তাদের নিয়ে স্বজন ও সতীর্থদের কোনো অভিযোগ নেই।

প্রশ্ন হলো দ্বিতীয় বর্ণনায় লেখা একজন সৎ সাধারণ বাঙালির সন্তানকে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে প্রথম বর্ণনার মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনির সাথে কেন ৩০% মাইনাস পয়েন্টে থেকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে? এটা তো মারাত্মক বৈষম্য!
বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের ভিআইপি পর্যাদা পাবে। এতে কোনো দ্বিমত নাই। যারা নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারেনি এবং স্বাধীনতাবিরোধী যারা; তাদেরকে রাষ্ট্র দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দিচ্ছে কি?
স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পেরিয়ে গেলেও সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কারা তা নিশ্চায়ন করবার তরিকা প্রতিষ্ঠা করা গেছে কি?

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই কোটার ভয়াবহতা এভাবে তুলে ধরছেন। বাংলাদেশ রেলওয়েতে ২৫ জন নিয়োগ দিবে। এই ২৫ জনের মধ্যে ২০ জন হবে পোষ্য কোটা, আর ২ জন মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মাত্র ৩ জন সাধারণ। এই ৩ জনের নামে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে আবেদন ফি'র নামে অর্থ  ইনকাম করবে।
১৮ কোটি জনগণের দেশে মাত্র ৩ জন সাধারণ মানুষ চাকুরি পাবে?

নিয়োগের এই বৈষম্য নিয়ে মোক্ষম কথাটি বলেছেন, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।
তিনি তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'জেদাজেদির বিষয় নয়.. কোটার বিষয়টি সমাধান করতে হবে বাস্তবতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক পরিবার একাত্তরের আঘাত হতে বের হতে পারেনি। অর্থনৈতিকভাবে সেই যে তারা বিদ্ধস্ত হয়েছিল সেখান থেকে আর উঠতে পারেনি। অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারও কষ্টের ভিতর দিয়ে গেছে, এখনও যাচ্ছে। আমরা যে কিছু স্বচ্ছল নাগরিক মুক্তিযোদ্ধা দেখি তারা ক্ষমতা কাঠামোর ভিতরকার মানুষ। তাদের দেখে সব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বিচার করা যাবে না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু সবার আগে সুবিধা নিতে পারদর্শী। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে গিয়েও কম কেলেংকারি হয়নি। তেমনিভাবে প্রতিবন্ধী, পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য অবশ্যই কোটা লাগবে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা অনেক বেশি। একটা ন্যায্য স্তরে নিয়ে আসাটাই হবে বিবেচনার কাজ। এমন একটা সমাধান দরকার যেন কোটাও থাকে আবার কোটার বিরোধিতা তৈরি না হয়। এটা কোন কঠিন কাজ নয়।'

শেষে আমরা এটাই বলতে চাই, 
যেসব শিক্ষার্থী কোটা পদ্ধতি বাতিলের জন্য আন্দোলন করছে তাদের অনুভূতির সাথে আমাদের সংহতি রয়েছে। তবে কোটা পদ্ধতি ঢালাওভাবে বাতিলের সুযোগ নেই এটা মেনে নিয়েই তাদের ন্যায্য দাবি জানাতে হবে। সেইসাথে তাদের আন্দোলনটা যদি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও সরকারে কর্মরত ব্যক্তির দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় সেটি হয় আমাদের আপামর জনতার গণদাবি। এতটুকু দুর্নীতি রেখে দিয়ে কোটা বাতিলে কারো কোনো ফায়দা নেই। কোটায় তবু আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা সমাজের অনগ্রসর গোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সমাজের মূলস্রোতে জায়গা করে দেয়া যায়। কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে পুঁজিবাদি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ছাড়া আর কারো সুযোগ থাকে না।

সুতরাং আমরা সরকার, আদালত ও আন্দোলনকারীদের সকলপক্ষকে বলব, আপনারা খেয়াল করবেন কোটার কুঠারে যেন কাটা না পড়ে বাংলাদেশ নামে আমাদের প্রিয় সুন্দরবন। সম্ভব সবখানে যেন ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হয়।

লেখক: সাংবাদিক
৮ জুলাই‌ ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login