এক.
সাড়ম্বরে যাও, অনাড়ম্বর খেলো, নিরবে দেশে ফিরো।
বৈশ্বিক আসরগুলোতে এ-ই যেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নিয়তি! মাঠে ভালো খেলা নয়, বরঞ্চ যাওয়া-আসার ‘খেলাতেই’ যেন সীমাবদ্ধ টাইগার-বাহিনীর পদচারণা। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টগুলোর দিকে তাকালে বাংলাদেশ দলের চিত্রে এরকম হতাশার গ্রাফই কেবল ফুটে ওঠে। সেই কবে একবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশের, বড় আসরে আর সাফল্য কোথায়! এবার যখন অংকের নানা সমীকরণে আরেকবার বড় আসরের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ দুয়ারে এসে দাঁড়ালো, সেই সুযোগ পায়ে ঠেলে দিলেন শান্ত-লিটনরা!
দুই.
আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেল। নেপাল, নেদারল্যান্ডসের মতো নবীন দেশগুলো প্রতিপক্ষ হওয়ায় গ্রুপ পর্বের বৈতরণী কোনোরকমে পার করেন তানজিদ হাসান তামিমরা, জায়গা করে নেন সুপার এইটে। কিন্তু দলের হতশ্রী চেহারা ফাঁস হতে দেরি হলো কই! সুপার এইটে স্বাদহীন, গন্ধহীন, বর্ণহীন বিরক্তিকর ক্রিকেট খেলে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। ক্রিকেট কিংবা খেলাধুলার সাথে ‘লজ্জা’ বিষয়টি যায় না, যেহেতু খেলাধুলা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই বেশি খ্যাত। আর না হয় খেলায় যে বাজে ‘ইনটেন্ট’ দেখিয়েছেন কথিত টাইগাররা, তা ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে অভিহিত করা যেতো।
সুপার এইটে টানা দুই হার। এরপর আঁচমকা অনেক অংকের মারপ্যাঁচে যখন সমীকরণটা এমন দাঁড়ালো, সুপার এইটে নিজেদের শেষ ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একটা ভালো ব্যবধানে জিতলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত, তখন এ কোন কাণ্ড সাকিবদের! ম্যাচে আগে ব্যাট করা আফগানদের ১১৫ রানে আটকে দেন রিশাদ হোসেনরা। পুরো আসরের মতো এই ম্যাচেও বাংলাদেশের বোলারদের পারফরম্যান্স ছিল আশা জাগানিয়া। কিন্তু আশায় জল ঢালদে তো আমাদের ব্যাটাররা আছেনই! আফগানদের লক্ষ্যকে ১২.১ ওভারে টপকাতে পারলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে সেমিফাইনাল। অর্থাৎ, ৭৩ বলে করতে হবে ১১৬ রান। টি-টোয়েন্টিতে এ মোটেই বড় কোনো লক্ষ্য নয়। আর লক্ষ্যটা যদি হয় প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার হাতছানি, তখন তো লড়াই হবে মরণপণ। কিন্তু কোথায় কী! স্বপ্নের সাতরঙ ছুঁতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকার কথা ছিল শুরুর পাওয়ার প্লের। এ সময়ে মাত্র দুজন ফিল্ডার বৃত্তের বাইরে ফিল্ডিং করেন, তাই তেড়েফুড়ে বল উড়িয়ে মাঠছাড়া করা বেশ সহজ। কিন্তু অন্য দলের জন্য যা সহজ, বাংলাদেশের জন্য তা তো কঠিন হবেই! আফগানদের বিপক্ষে পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে তাই রান এলো মাত্র ৪৩, সঙ্গে উইকেট নাই তিনটা।
শুরুর এই ধাক্কা খেয়েই নাকি পরে আর সেমিফাইনালের স্বপ্ন দেখেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক শান্ত! ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি অকপটে বলেন, “পরিকল্পনা (সেমিতে যেতে) এমন ছিল যে আমরা প্রথম ৬ ওভার চেষ্টা করবো। পরিকল্পনা ছিল, যদি আমরা ভালো শুরু করি, দ্রুত যদি উইকেট না পড়ে, তাহলে আমরা সুযোগটা (১২.১ ওভারে লক্ষ্য টপকানো) নেব। কিন্তু যখন আমাদের দ্রুত ৩ উইকেট পড়ে গেল, তখন আমাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল যেন আমরা ম্যাচটা জিততে পারি।” পাওয়ার প্লেতে ধাক্কা খেয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক সেমিফাইনালের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে শুধুই একটি সাদামাটা জয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। অথচ পাওয়ার প্লের ধাক্কার পরও পরের ৩৭ বলে যদি ৭৩ রান তোলার দিকে মনোযোগ দিতেন ব্যাটাররা, তাহলেও হয়তো শেষাবধি চূড়ান্ত হতাশার পরাজয়ে ন্যুব্জ হতে হতো না। দুর্ভাগ্য এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের, পশ্চাৎপদ, ঋণাত্মক মানসিকতায় বন্দি এখানকার ক্রিকেট।
তিন.
সুপার এইটে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচের আগে নানা সমীকরণে যখন টাইগারদের সেমিফাইনালের স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু ক্রীড়াপ্রেমী উল্টোটা চেয়ে পোস্ট করেছেন। অর্থাৎ, যোগ্য দল হিসেবে আফগানিস্তানই যাতে সেমিতে খেলে, সেটার কথাই বলেছিলেন অনেকেই। এবারের আসরে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলগুলোকে হারিয়ে দেওয়া আফগানিস্তান যে সেমিফাইনালে খেলার মতো যোগ্য দল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা নিজ দলের হতশ্রী পারফরম্যান্সে রাগে-ক্ষোভে আফগানদের হয়ে কথা বলছিলেন, এ তো বলাই বাহুল্য। ম্যাচ যখন শুরু হয়, তখন যে মনে-প্রাণে সবাই সেমিফাইনালের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, এও বলে দেওয়া যায় ঝুঁকি ছাড়াই। কিন্তু কোটি জনতার স্বপ্নের ফানুস ফুটো হয়ে বিধ্বস্ত হলো বাজেভাবে। কারা ফুটো করলেন ফানুস?
সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই অধিনায়কের কাজ। অথচ অধিনায়ক শান্ত গোটা আসরজুড়েই ব্যর্থ। ওই ‘বাঁচা-মরার’ ম্যাচেও তিনি ৫ বলে ৫ রান করে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। আরেক ব্যর্থ ব্যাটার তানজিদ হাসান তামিম। তিনিও ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে যেন মরিয়া ছিলেন! দল যখন তার কাছ থেকে মহামূল্যবান একটা ঝড়ো সূচনা চেয়েছিল, তিনি সেদিন ৩ বলে ‘আন্ডা’ মারেন! এই আসরে সাত ইনিংসে এটি ছিল তার তৃতীয় শূন্য! সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ হতে পারতেন নির্ভরতার অন্য নাম। প্রায় বছর সাতেক আগে যেবার বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেললো, সেবার এ দুজনের অবিশ্বাস্য ২২৪ রানের এক হিরন্ময় জুটির সুবাদে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমি নিশ্চিত করেছিল টাইগার-বাহিনী।
কিন্তু এবার?
সাকিব আর মাহমুদউল্লাহকে ঘিরে শুধুই দুয়োধ্বনি! আফগানদের বিপক্ষে সেদিন মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই কট বিহাইন্ড সাকিব! মাহমুদউল্লাহ ‘ফিনিশ’ করে ফিরবেন, প্রত্যাশা তো এমনই ছিল। সেমিতে যেতে একপর্যায়ে যখন ১৮ বলে ৪৩ রান করার কঠিন সমীকরণ, তখন নুর
আহমেদের করা ওভারে ৫টি ডট বল দিলেন মাহমুদউল্লাহ! অভিজ্ঞ এই
ব্যাটার ৯ বলে ৬ রান করে নিজেই ‘ফিনিশ’ হয়ে গেলেন। এই আসরে বাংলাদেশের সবচেয়ে স
ফল ব্যাটার তৌহিদ হৃদয়। রানে, স্ট্রাইক রেটে সবার উপরে এই তরুণ। অথচ আফগানদের বিপক্ষে অতি আশ্চর্যজনকভাবে হৃদয়কে নামানো হয় ছয় নম্বরে! লিটন দাস ম্যাচে ফি
ফটি করেন। কিন্তু তার ৪৯ বলে ৫৪ রানের অপরাজিত ইনিংস কী কাজে এলো বাংলাদেশের? সেমির স্বপ্ন যখন সমাধি, তখন জয়ের জন্য ৩০ বলে লাগতো ২২ রান। লিটনের রান তখন ৩৯ বলে ৪৬। এরপর আরও ১০ বল খেলা লিটন একটিমাত্র চার হাঁকাতে সক্ষম হন। এমনকি ১২ বলে যখন ১৪ রান দরকার, পিচে তখন তাসকিনের মতো আনাড়ি। তখনো নিজে দায়িত্ব না নিয়ে সিঙ্গেল নিয়ে তাসকিনকে স্ট্রাইক দেন লিটন! নাভিন উল হকের বলে তাসকিন বোল্ড আর পরের বলে মোস্তাফিজুর এলবিডব্লিউ হওয়ার পর আফগান শিবিরে যখন ভূকম্পের উল্লাস, নন স্ট্রাইকে থাকা লিটনের মনে কী দায়িত্বহীনতার কোনোও অনুশোচনা কাজ করছিল?
চার.
দলের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় দায় অবশ্যই খেলোয়াড়দের। কোচ, মেন্টররা উৎসাহ দেন, ভুল ধরিয়ে দেন, স্বপ্নের ফানুস ওড়াতে প্রেরণা যোগান; কিন্তু মাঠে খেলতে হয় বোলার-ব্যাটারদেরই। কিন্তু তারপরও কথা থাকে যদি কোনো দলের প্রধান কোচই নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে চলেন। যদি তিনি বাস্তব দৃশ্যপট থেকে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগানোর বদলে ‘বোনাসের’ পেছনে দৌড়ান। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বড় কোনো দলকে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকলেও দ্বিতীয়বার তিনি আছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়ে। লঙ্কান এই কোচের অধীনে বাংলাদেশের সাফল্য কী, প্রাপ্তির খাতায় কী যোগ হয়েছে বা হচ্ছে, সেটা না হয় এখানে না-ই বলা হলো। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে যে ঋণাত্মক মানসিকতা দেখালেন হাথুরুসিংহে, তা সম্ভবত যেকোনো লেভেলের কোচের কাছ থেকেই অপ্রত্যাশিত। সুপার এইটে ওঠার পর সংবাদ সম্মেলনে হাথুরুসিংহে বলেন, ‘এখানে আসতে পেরে আমরা খুবই খুশি। এখান থেকে যেকোনো প্রাপ্তিই হবে বোনাস।’
সুপার এইটে ওঠেছেন, আপনি সেমিফাইনালকে লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করবেন, সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাবেন, দলকে উৎসাহ দেবেন। অথচ আপনি বাস্তবতা পায়ে ঠেলে কল্পলোকে বাস করছেন! আপনার কাছ থেকে শিষ্যরা স্পষ্ট বার্তা পাবেন, সেমিফাইনাল খেলার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ার। আপনি সেদিকে না গিয়ে, সে চিন্তা না করে বোনাস নিয়ে ব্যস্ত! আগে তো আপনাকে ‘মূল পুঁজি’ যোগাড় করতে হবে, এরপর না বোনাস! সুপার এইটে ওঠেছেন বলেই দায়িত্ব শেষ? মূল কাজ শেষ? দেশের খ্যাতিমান ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদিন ফাহিম সংবাদমাধ্যমকে বলছিলেন, “আসলে সুপার এইটে ওঠে আমরা কেমন যেন গা ঢিলেমি করলাম। হেড কোচ বলে বসলেন, আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, এখন যা হবে তা বোনাস। সেটা (হেড কোচের মন্তব্য) আমাদেরকে অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। আমার মনে হয়, সুপার এইটে খেলার যে দুর্নিবার আকাক্সক্ষা, সদিচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প থাকার কথা ছিল, তা তখনই (হেড কোচের মন্তব্যের পর) বিনষ্ট হয়েছে।”
জাতীয় দলের আরেক কোচ ডেভিড হ্যাম্প, যিনি মূলত ব্যাটিংয়ের দেখাশোনার দায়িত্বে। বারমুডার সাবেক এই ক্রিকেটার কী কোচিং করালেন শান্তদের? গোটা আসরেই তো দলের ব্যাটিং বিধ্বস্ত হলো একেবারে উদ্যমহীনভাবে। ভুলের পর ভুল করে গেলেন তানজিদ-লিটনরা। টি-টোয়েন্টিতে করলেন টেস্টে ব্যাটিং। দেখালেন ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা। দলের ব্যাটারদের ভুলই যদি না শোধরায়, তারা যদি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পারফর্মই না করেন, তাহলে কী লাভ মোটা অংকের ডলার খরচ করে এমন কোচ রাখার?
পাঁচ.
বস্তুত ভুলের দুর্বিপাকে পড়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। হ্যাঁ, প্রশ্ন ওঠতে পারে, এই ভুল শুধুই কী ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত। গোটা ক্রিকেটাঙ্গনের চিত্র এক পলকে দেখে এলে ভুলগুলো আসলে স্বাভাবিকতায় আর আবদ্ধ থাকে বলে মনে হয় না; এগুলো ইচ্ছাকৃত কিংবা খামখেয়ালিপনার ভুল বলেই ধরা পড়ে। এই ভুল বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের ভুল, সংগঠকদের ভুল, ক্রিকেটারদের ভুল, কোচদের ভুল। বাদ পড়বে না সংবাদমাধ্যমও। হঠাৎ পাওয়া সাফল্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মহাসাফল্য হিসেবে প্রচার করে, মিডিওকার দল আর ক্রিকেটারদের মহাশক্তিধর হিসেবে শো অফ করে এ দেশের ক্রিকেটের ভুলগুলোকে, ভুল পথকে, ভুল সিদ্ধান্তকে আড়াল করে রাখার দায় তো সংবাদমাধ্যমকে নিতেই হবে!
(লেখাটি সর্বপ্রথম দেশের একমাত্র সরকারি ক্রীড়া পত্রিকা পাক্ষিক ক্রীড়াজগতে ১ জুলাই ২০২৪ ইং তারিখে প্রকাশিত)