পোস্টস

গল্প

এ ইভিনিং ফুল অফ কোইন্সিডেন্স

১০ জুলাই ২০২৪

এমদাদুল

মূল লেখক এমদাদুল

গল্পের নাম বাংলাকলা অনন্য এমনটাই শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো; গত চল্লিশ মাসে আঠারোটি কবিতা আর এগারোটি ছোট গল্প লিখে বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত খরস্রোতা নদীতে স্বতস্ফূর্ত চর হয়ে জেগে থাকা অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাহিত্য পাতায় তিনটি গল্প আর সাতটি কবিতা প্রকাশ করে নিজের জায়গা দখল করে নেয় জসিম। দুই বার নাম পরিবর্তনের কথা উঠলেও বাংলাকলা অনন্য নামের পক্ষে জসিম দৃঢ় দাঁড়িয়ে রইলো। ‘আজকের খবর’ অনলাইন নিউজ পোর্টাল সাহিত্য সম্পাদক ইদ্রিস ভাই বলেন, আমরা সকলেই ভাত খাই, রুটি সবজি আর মাছ খাই, প্রতিদিন খাই, তাই বলে আমরা যেকোন গল্পের নাম পাবদা মাছ কিংবা আমনচাল রাখতে পারি না, তখনই আমনচাল নাম উপযুক্ত হয় যখন এ-নামের একটা সিগনিফিকেন্স থাকে, প্রতিদিনতো আমরা কতো কি খাই, প্রতিদিন দুটি করে বাংলাকলা খাই বলে গল্পের নাম বাংলাকলা অনন্য রাখতে হবে এমন যুক্তি অকাট্য, তাই গল্পের নাম পরিবর্তন বিবেচিত হোক। কিন্তু জসিম ঘাউরা লেখক তাই গল্পের নাম পরিবর্তন না করে বাংলাকলা অনন্য নামে স্থির থাকে আর বাংলাকলা অনন্য নামকরনের সিগনিফিকেন্স লিখে পাঠায় ইদ্রিস ভাইয়ের এডিটিং ডেস্কে। ইদ্রিস ভাই আর কথা বাড়ায় না, বাংলাকলা অনন্য প্রকাশ করে পরের সপ্তায় এবং সোস্যাল মিডিয়ায় জসিমকে ট্যাগ করে গল্পের লিঙ্ক শেয়ার করে দেন ইদ্রিস ভাই।

 

বাংলাকলা অনন্য ফ্লপ হয়, শুধু নামের জন্য নয়, গল্পের গুনগতমান আর ভাবনা দুটাই ভীষণ রুগ্ন। জসিমের গল্প অনবদ্য আর আনকোরা যা পরিপূর্ণ চর্চায় আরো পোক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যে নতুন পরিসর জন্ম দিবে, এমন ধারনা বিশ্বাসী যে দু-একজন জসিম শুভাকাঙ্খী আছে, ওরা সকলে হতাশ হলো, চরম প্রতারিত বোধ করলো। ওরা বলে বাংলাকলা অনন্য গল্পটা একদম কিছু হয় নাই। গল্প লেখার প্রাথমিক নিয়ম-কানুন সমূহের কোনটাই এই গল্পে হাজির নেই তাছাড়া অহেতুক শব্দ অপচয় করে রেখেছে পুরো গল্প জুড়ে, হতাশ না হয়ে আশ্চর্য হবার কথা জসিম কেমন করে এমন একটা গল্প লিখতে পারলো! একদম হযবরল।

 

সদ্য প্রকাশিত গল্পের মান আর নামকরন কেন্দ্র করে পার্লফিকশন প্রকাশনীর অজহার ভাইয়ের সাথে জসিমের কথা কাটাকাটি হয়। জসিমের প্রতি পার্লফিকশন প্রকাশনী পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে, ফলসূতিতে জসিমের সদ্য লেখা উপন্যাসের মেনুস্কিপ্ট ফেরত পাঠায় আজহার ভাই। সময়টা এলোমেলো করে দিলো সব, আগামি মাসেই এডভান্স পাওয়ার কথা ছিলো। যে সাইনিং মানির কথা ভেবে এতোদিন ককটেল খওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম সেটা মুহুর্তেই ধোয়া হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো; কলা-ও গেল, আজহার ভাই-ও গেল! মাথায় হাত অবস্থা; খুব দ্রুত নতুন কোনো প্রকাশনী নিশ্চিত করতে না পারলে বুক সেল্ফের বই বেঁচে কলা কিনে খেতে হবে প্রতিদিন, এমনকি হয়তো প্রতিদিন তখন আর কলা খাওয়া হবে না। 
 

কল্পনা আর বাস্তবতার একটা বড় তফাত হলো ক্যালকুলেটারের উপস্থিতি, কল্পনায় ক্যালকুলেটার থাকে না তবে বাস্তবে থাকে, প্রত্যেকের বাসায় রয়েছে একটি কেসিও ক্যালকুলেটার আর সেখানে যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করা যায়, করা যায় মাসিক আয়-ব্যায় হিসেব তাছাড়া হিসেব করা যায়, মানি অন হ্যান্ড ডিভাইডেড বাই ডে টু সারভাইব। এই সংকটময় সময়ে সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য যে মানুষটি আমাকে সাহায্য করতে পারতো, সেই ইদ্রিস ভাই আমাকে ইগনোর করছে, বাংলাকলা অনন্য ফ্লপ হবার পর থেকে তিনি আর আমার কল রেসপন্ড করছে না তাতে করে নতুন যে সমস্যাটা হলো, গত দুমাসের সাতশত পঞ্চাশ টাকার কবিতা, এগারোশো নব্বই টাকার গল্প আর কুড়িখানেক অনুবাদের টাকা এখন অনিশ্চিত হয়ে গেলো। হাতে জমানো টাকা আর গ্রামের ভিটা থেকে প্রতিমাসে প্রাপ্ত আয় এই মুহুর্তের সম্বল। চিলেকোঠা সাহিত্য সভা নড়বড়ে হয়ে গেলো; নিয়মিত সপ্তাহিক সাহিত্য আয়োজনে পাঁচ-সাতজন সমসাময়িক সাহিত্য বিবেচক ককটেল গ্লাস হাতে আমার সাহিত্য বিশ্লেষণ শুনছেন, মাঝে মাঝে বলছেন আর বাকি সময়টা মোনালিসার ভ্রু-তে তাকিয়ে আছেন, সকলেই তাকিয়ে আছেন; এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ আসর অনিশ্চয়তায় পতিত হলো। বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সাহিত্যিক জড়ো হচ্ছে আমার আঙ্গিনায় এটা সৌভাগ্যের, সকলের হাতে তুলে দিচ্ছি ককটেল গ্লাস এটা আনন্দের আর বাংলা সাহিত্যের মহাস্রোত বইছে আমার চিলেকোঠার বুকে সেটা অধিক গর্বের কিন্তু ইদ্রিস ভাইয়ের ইগনোরেন্স আর আজহার ভাইয়ের রিজেকশনে আমার কেসিও ক্যালকুলেটা বলছে এখন সময় লালমাটিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার, এমনটা চলতে থাকলে আগামি চার মাসেই ভিখ মাগতে হবে শহুরে পথে পথে! তাই আমি লালমাটিয়া থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার পশ্চিমে শাক্তা ইউনিয়নস্থ আটি গ্রামে একটা রুম ভাড়া করলাম। এটি একটি গ্রাম, সাহিত্য স্রোত ম্রিয়মাণ যেখানে, ককটেল ধ্বনি নেই যেখানে আর মোনালিসা যখন অন্য কোন সাহিত্য সম্ভারে ব্লাডিমেরি হাতে তখন আটি গ্রামে কোথাও কোন সাহিত্য নেই। সতেরো দিন সাহিত্যহীন অতিক্রান্ত হলে এক ঝি ঝি ডাকা দুপুরে ইদ্রিস ভাই এস এম এস পাঠিয়ে কটুক্ষেত যেতে বললেন; আমি মরুভুমিতে জল পেলাম। ইদ্রিস ভাইকে আমি বিশেষ ভক্তি করি, প্রথমত ইদ্রিস ভাই নিজ গুনে সাহিত্য সম্পাদক হয়েছেন পত্রিকা ইনভেস্টর বা প্রধান সম্পাদক ইদ্রিস ভাইয়ের দুলাভাই নন, ইনফেক্ট ইদ্রিস ভাইয়ের কোন বোন নেই আর দ্বিতীয়ত ইদ্রিস ভাইয়ের সাহিত্য জ্ঞান বহুতল বিশিষ্ট আর গভীর তাই ইদ্রিস ভাইকে আমি বিশেষ মান্য করি। আমার এই দুঃসময়ে ইদ্রিস ভাইয়ে উপস্থিতি আমার জন্য বিশেষ তৎপর্যপূর্ণ, আমি জানি ইদ্রিস ভাই হয়তো আমাকে একটা পাবলিশার জোগার করে দিবেন খুব দ্রুত।

 

ইদ্রিস ভাইয়ের অফিস থেকে চার হাজার তিনশত চল্লিশ টাকা নগদ পেলাম, ইদ্রিস ভাইকে পেলাম না, তিনি অফিসে ছিলেন না; হেল্প ডেস্ক থেকে বললেন ইদ্রিস ভাইয়ের বাবা অসুস্থ তাই তিনি বারডেম হসপিটালে গেছেন। আমি বাসায় ফিরে আসলাম; বাজারে থেমে নিয়ে নিলাম মসুর ডাল, বাশঁফুল চাল, বাদাম, সরিষার তেল আর দুই হালি তিনটা বাংলাকলা। 

 

ইদ্রিস ভাইয়ের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরী, তেরো বছর ধরে সাহিত্য সম্পাদনা করছেন ইদ্রিস ভাই, ‘দৈনিক কাকডাকা ভোর’ থেকে তার সম্পাদনা জীবন শুরু, তারপর এদিক ওদিক আরো অনেক দিকে হেঁটেছেন; তিনি এই তেরো বছরে প্রচুর দেখেছেন, পড়েছেন, সম্পাদনা করেছেন, লিখেছেন আর মানুষের সাথে মিশেছেন। ইদ্রিস ভাইয়ের হাতে পটেনশিয়াল পাবলিশার আছে এটা আমি নিশ্চিত আর একটা যদি মিলে যায় তাহলে আমার অঙ্গিনায় আবার বইতে পারে সাহিত্যের অনাবিল স্রোত, সমস্যা হল ইদ্রিস ভাই কম কথা বলে তাই কখনই বুঝতে পারি না আমার সাহিত্য চর্চায় তার অভিমত কি তাছাড়া ইদ্রিস ভাই কখনো তার সাহিত্য ভাবনা আমার সাথে সরাসরি আলোচনা করেন নাই ফলে ইদ্রিস ভাইয়ের সাথে আমার কিছুটা ক্রিয়েটিভ দূরত্ব রয়ে গেছে, সবসময়। বাংলাকলা অনন্য ফ্লপ হবার পর বন্ধুমহল আমার বাসায় আর অসছে না, ফোন যোগাযোগও কম হচ্ছে ফলে সোস্যালাইজেশনের সময়টুকু বেঁচে যাচ্ছে প্রতিদিন হয়তো এই কারণেই আটিতে ব্যস্ততা কম, স্থির হয়ে আছে সময়, সারাদিন কোন কাজ নেই, হাতে প্রচুর সময়। গভীর নীরবতা আছে এখানে আর জীবনের খরচ নেহায়েত কম। অথচ এমন হয়েছে প্রায় প্রতিদিন আমার বাসায় নানান লোকজন আসছে, ওরা ঘুমাচ্ছে, আড্ডা মারছে, গান গাইছে আবার ডিনারের পর মারিজুয়ানা বানাচ্ছে, নিজে খাচ্ছে, আমাকেও দিচ্ছে। গাঁজা খেয়ে আমার মনে হতো লাইফ ইজ বিউটিফুল, মাথায় ঘনিভূত হতো একটা বিশেষ গল্পের পটভূমি, যেটা লিখে সহজেই খ্যাতি অর্জন করা যায় ‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ কিন্তু লিখা আর হয় না, শুয়ে শুয়ে গল্পের পটভূমি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরি সবসময়। 

 

‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ লিখতে শুরু করলাম, কিন্তু বিশেষ মানসিক পরিস্থিতিতে যে পটভূমি মাথায় হাজির ছিলো সেটা এখন আর স্মৃতিতে নাই ফলে সম্পূর্ণ নতুন একটা গল্প হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সমস্যা হলো নতুন যে গল্পটা হচ্ছে সেটা আমি চাই না, আমি সেটাই  চাই যেটা এতোদিন ভাবনা অধিকৃত ছিলো, যেটা লিখে খুব সহজেই খ্যাতি অর্জন করা যায়; আমি সেটাই লিখতে চাইছি যেটা এতোদিনেও লিখতে পারছিলাম না; নতুন করে লিখলেতো আর পুরানোটার মজা থাকে না। ইনফেক্ট পুরানো নামে নতুন গল্প লেখার প্রয়োজন নাই। স্মৃতি বিশ্বাস ঘাতক, আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রইলাম। বিকেলে ইদ্রিস ভাইকে ফোন দিলাম। ইদ্রিস ভাই বললো, আরো বেশি বেশি গল্প লিখো মিয়া, দিন রাত লিখো; আর যদি পারো, একটা উপন্যাস শুরু করো, বয়েসতো আর কম হয় নাই। হোয়াট এ কোইনসিডেন্স, একই কথা আমিও ভাবছিলাম, ভাবছিলাম একটা উপন্যাস লিখবো; আমি ইমোশনাল হয়ে গেলাম, আমার মনে হচ্ছিল এটাই সময়, এখন আমার একটা উপন্যাস লিখা দরকার। জীবনের এই সময়ে, জীবন বিষয়ক সার্বিক উপলব্ধি আর পরিবর্তীত বোধ নির্ভর করে লিখে ফেলা সম্ভব একটা পরিপূর্ণ উপন্যাস তাছাড়া ইদ্রিস ভাই আমাকে লিখতে বলছে মানে আমার লিখার কেপাবিলিটি আছে, তিনি বিশ্বাস করেন আমি লিখতে পারবো, একটা গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেশন পাওয়া গেলো! আমার ধারনা ইদ্রিস ভাই আমার জন্য একটা পাবলিশারও ঠিক করে রেখেছেন, হয়তো খুব শ্রিগ্রই আমাকে জানাবেন; এই সকল ভাবনা একজোট হয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয় আনন্দে। আমি ভীষণ আনন্দিত হয়ে প্রচণ্ড অনুপ্রেরণায় দৈনিক রুটিন করে ফেললাম, প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ব্রেনস্ট্রোমিং, নোভেল আউটলাইনিং আর দুই ঘণ্টা লিখার জন্য বরাদ্দ করলাম। লাইফ ইজ বিউটিফুল, হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স।

 

একটি সহজ জীবন চর্চা আর কঠোর অনুশীলন আমাকে পৌঁছে দিবে অনন্ত লক্ষে; সেইলক্ষে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মগজ আর শরীর সজীব রাখতে লেবু-আদা খেয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছি নতুন একটা উপন্যাস লিখবো বলে। প্রত্যহ প্রত্যুষে দশ মিনিট ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ ক্রিয়েটিভ আইডিয়া ইনহেন্স করে এমন একটা ইন্টারনেট টিউটোরিয়াল দেখে আমি ওয়ার্ক আউট শুরু করলাম। হিসেব করে দেখেছি, যে পরিমান টাকা জমানো আছে তাতে করে প্রায় তেরো মাস বাসা ভাড়া দিয়ে দুবেলা খেতে পারবো, ফলে অর্থনৈতিক চাপ থেকে আপাতত মুক্ত রয়েছে আমার মাথা তাই এটাই উপযুক্ত সময় একটা নতুন উপন্যাস লিখার কিন্তু রুটিন মাফিক জীবনধারা পালনের প্রথম সপ্তাহেই একটা গণ্ডগোল শুরু হলো, প্রতিদিন ব্রেনস্টোর্মিং আর লেখার কাজে যে চার ঘণ্টা বরাদ্দ রেখেছি সেই সময়টায় কি করবো সেটা বুঝতে পারছি না, ব্রেনস্টোর্ম বিষয়ে বিপাকে পড়ে গেলাম। ব্রেনস্টোর্ম কি, কোথা থেকে শুরু করবো, কেমন করে করবো এই বিষয়গুলা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আমার মগজের প্রধান ফটকে ফলে এটা সমাধান না করে আমি আর সামনে আগাতে পারছি না। ব্রেনস্টোর্ম হচ্ছে না তাই লিখাও হচ্ছে না ফলে প্রতিদিন চার ঘণ্টা আমি আসলে কিছুই করছি না, করতে পারছি না। আমি বসে থাকি। প্রচণ্ড অসহায়ত্ব নিয়ে বসে থাকি। প্রতিদিন চার ঘণ্টা রুটিন করে আমি বসে আছি।

 

শারীর পেশীবহুল করতে নিয়মিত শরীর চর্চা প্রয়োজন আর ব্রেনস্টোর্মিংয়ের জন্য প্রয়োজন নিয়মিত ব্রেনস্টোর্ম করা তাই একদিন, দুইদিন, তিনদিন এবং প্রতিদিন ব্রেনস্টোর্মের চেষ্টা করে করে অনেকগুলো সপ্তাহ চলে গেলো কিন্তু কিছুই হলো না। প্রতিদিন বড় একটা ভাবনা আসবে ভেবে বসে থাকি কিন্তু আসে না, প্রায় তিন মাস কিছুই লিখছি না। ইদ্রিস ভাই প্রতি সপ্তাহে তার সাহিত্য পাতায় নতুন-পুরাতন বিভিন্ন গল্পকারের গল্প প্রকাশ করে যাচ্ছেন, আমি জানি তিনি আমার গল্পের অপেক্ষায় আছেন কিন্তু আমি নিরুপায়; নিরুপায় বসে আছি গল্পহীন মোহাম্মদ জসিম। তিন মাসের জিরো প্রগ্রেশনের পর ঠিক করলাম আগে বেশ কিছু ছোট গল্প লিখে হাত পাকাবো আর এর মধ্যেই নিশ্চই ব্রেনস্টোর্মিং বিষয়টাও বুঝে যাবো আর তখন উপন্যাস লিখা যাবে। আমি নতুন লক্ষ ঠিক করলাম প্রতি সপ্তাহে একটি করে গল্প লিখবো, তা না হলে প্রতি মাসে কমপক্ষে দুইটি। গল্প লেখা আসলে কঠিন ব্যাপার না, আমি আগেও লিখেছি আর নিয়মিত লেখা চালিয়ে গেলে ছমাসেই প্রকাশ করা যাবে ‘জসিমের একগুচ্ছ গল্প সমাহার’। আমি নতুন একটা রুটিন করলাম।

 

গল্প কি লিখবো, কেনো লিখবো, কখন লিখবো, কিভাবে লিখবো এই সকল গুরুত্বপূর্ণ-ভাবনা-দ্বন্ধে আমি আমার স্কুল বন্ধুর দ্বারস্থ হলাম। আক্কাস সমসাময়িক বাংলাব্লগে ছোট গল্প দুনিয়ায় বড় নাম; নায়িকা হিমিকা আর নায়ক কাঞ্চনের প্রণয় বিষয়ক গল্প ‘অনুকম্পা’ লিখে বিদ্যানদী এওয়ার্ড জিতে নিয়েছে গত মাসে আর তাই আমি মধুসিটি হাউজিং সোসাইটিতে যেয়ে স্মোক্ড ফ্লেভার ল্যাপসং ব্ল্যাক-টি খেতে খেতে আমার লেখালিখি বিষয়ক সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধান আলোচনা করি আরো আলোচনা করি আমাদের গণিত শিক্ষকের ক্লাসে ঘুমানোর সর্বশেষ ঘটনাটা এবং মোস্ট সিনিয়র ছাত্রীদের সাথে হেড স্যারের অশ্লীল আচরনসমূহের কার্যকারণ। যথাযথ স্কুলজীবন স্মৃতিচারণেন পর আমি বাসায় ফিরে এসেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লাম। প্রথম কাজ আইডিয়া নোট করা, পরের ধাপ আইডিয়া বাছাই, পরে আউটলাইন আর টানা লিখে ফেলা। আক্কাসের পরামর্শ অনুযায়ী মাথায় যা আসে সবই লিখে ফেললাম আইডিয়া খাতায়। প্রায় আঠারোটি আইডিয়া লিখে রিভিশনের সময় টের পেলাম সবগুলোই বালক সময়ের অনুভূতি প্রধান, তাই যুবক বয়স মাথায় রেখে আরো নয়টি আইডিয়া লিখে ফেললাম। মোট সাতাশটি আইডিয়া জড়ো করে মনে হল, গল্প লেখার প্রথম ধাপটি সফলাতার সাথে সম্পন্ন করতে পেরেছি। ইনফেক্ট গল্প লেখা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। ‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ আইডিয়াটাও খাতায় লিখে রাখলাম। কয়েকদিন ঘুমিয়ে থাকলাম। আটি বাজার থেকে বেবিটেক্সি চড়ে খোলামোড়া গেলাম, কদমতলী গেলাম, সেয়ারি ঘাট এক্সপ্লোর করলাম আর পাপর ভাজা খেলাম। এইসব নিজেকে রিওয়ার্ড করার পদ্ধতি, তাতে করে ইন্সপিরেশন পাওয়া যায়। পরিপূর্ণ ইন্সপিরেশন নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আইডিয়া নির্বাচন ধাপে এসে দেখলাম আইডিয়াগুলো আর কাজ করছে না। অনেক জায়গায় কিছু শব্দ লিখে রাখা, কোথাও আবার শুধু অনুভূতি, কোথাও কোথাও একলাইন-দুলাইন বাক্য আবার অনেক গুলোতে শুধু ক্যারেক্টারের নাম লেখা, এইসব ক্যারেক্টারের সিগনিফিকেন্স এই মুহুর্তে আর মনে পরছে না। যতগুলো শব্দ আর লাইন আইডিয়া হিসেবে লিখেছি সেগুলো আর কমিউনিকেট করছে না, কি কারণে এমন একটা শব্দ লিখেছিলাম, এই বাক্যের মানে কি সেটা এখন আর বুঝতে পারছি না। আমি দিশাহারা হয়ে পড়লাম, সাথে সাথে আক্কাসকে ফোন দিলাম; আক্কাসের সাথে কয়েক দফা মিটিংয়ে বসলাম। আক্কাস কোন ভাবেই এই পর্যায়ে আমাকে আর সাহায্য করতে পারলো না উপরন্তু আমাকে একটা ছোট কাঁচ বয়ামে ল্যাপসং ব্ল্যাক-টি দিয়ে দিলো; বললো গুড লাক দোস্ত। আমি বাসায় এসে আইডিয়া খাতা খুলে এক মগ ল্যাপসং টি হাতে বসে রইলাম। 

 

আইডিয়া খাতা আর ল্যাপসং টি হাতে বসে থেকে পাঁচ দিন পার হয়ে গেল, আমি বুঝতে পারলাম সময়ের পরিবর্তন হলেও আমার অবস্থা পরিবর্তন হয় নি। সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়া সমূহ প্রয়োগ করে বুঝলাম আমার পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই, আগের মতই আছে। না হচ্ছে আইডিয়া, না হচ্ছে আউটলাইন আর না হচ্ছে লেখা। যেকোন কাজে সফল হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন ফলে আমি কিছুক্ষণ বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। মাথায় একটা গল্প পটভূমি আসছে। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম খাতা-কলম নিয়ে।

 

‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ লিখতে শুরু করলাম। গল্পটা আমার বর্তমান অভিজ্ঞতা কেন্দ্র করে, আমার সামগ্রিক পরিস্থিতি আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে গল্পের পটভূমি তৈরি আর বাকিটুক ফিকশন। একজন গল্পকার, জসিম গল্প লিখার আইডিয়া খুঁজে পাচ্ছে না অথচ বালক বয়সেই জসিম গল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে শুধু তাই নয় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা মিশ্রিত একাধিক গল্প লিখে ফেলে এরই ধারাবাহিকতায় স্কুলের বাংলা শিক্ষককে পড়তে দেয় ’কোরালমাছ’ গল্প, আজিম মোহাম্মদ স্যার ‘কোরালমাছ’ গল্পের বহুল প্রসংশা করেন, সেই থেকে স্কুল দেয়ালিকায় গল্প প্রকাশ করেত শুরু করে জসিম আর বাসায় ব্যক্তিগত ডায়রিতে মুন্নি বিষয়ক বেশ কিছু ছোট গল্প লিখে রাখে। স্কুল- কলেজ কোন রকম পাশ করলেও তৎকালিন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচণ্ড মেধা প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি জসিম, ছাত্র-ছাত্রীদের অপরিমিত জ্ঞান কারণেই সেই বছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র ভীষণ কঠিন এবং আনকোরা হয়, নীলক্ষেত থেকে কিনে নেয়া ভর্তি গাইড থেকে কোন প্রশ্ন কমন পড়ে নাই ফলে এক এক করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে জসিম। তিন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিফিউজ হবার পর জসিম বুঝতে পারে, এই জীবনে ইউনিভার্সিটিতে পড়া হবে না এবং এটা মেনে নেয়। পরবর্তীতে চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাহাঙ্গীরের পিছে ঘুরে ঘুরে ফরিদ দস্তগিরের টেলিফিল্মে তিন নম্বার এসিস্ট্যান্ড হিসাবে জায়গা করে নেয় জসিম। আর এই পথ ধরেই জসিমের ক্রিয়েটিভ আন্ডারস্টেন্ডিং শুরু হয়, আট বছর টেলিফিল্ম লাইনে কাজ করার পর ডেইলি পেমেন্ট নিয়ে দস্তগির ভাইয়ের সাথে ঝামেলা হলে জসিম টেলিফিল্ম লাইন ছেড়ে দেয়। ততদিনে বন্ধু-পরিজন চাকুরি করে বিয়ে করতে শুরু করলে জসিম বুঝতে পারে গত আট বছর বিপথে সময় নষ্ট করেছে তাই সেদিনই কয়েকটা রুল টানা খাতা কিনে রেডলিফ কলম দিয়ে ‘বিষন্ন জীবনের অবশিষ্ট’ শিরোনামে কবিতা লিখতে শুরু করে কিন্তু বাসায় বসে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য চর্চা হল না বাবা প্যারালাইজড হয়ে যাবার কারণে শুধু তাই নয় বন্ধী জীবনের গ্লানি সইতে না পেরে প্রায় সাত মাস পর বাবা মরে যায়, বাবার শোকে মা-ও মরে যায় এগারো মাস পরে আর বাবা-মা দুজনেই মরে যাবার পর স্বাধীন জসিম আরো দুইটি বাংলা খাতা কিনে গল্প লিখতে বসে; কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, খাতা-কলম নিয়ে চেয়ারে বসে দেখা গেলো কোন গল্প আইডিয়া আসছে না মাথায়, শুধু আইডিয়া নয় গল্প কাঠামো, চরিত্র, পটভূমি কোন কিছুই আসছে না, মিলছে না এবং হচ্ছে না। জসিম বুঝতে পারে না সমস্যাটা কি। এমন চলতে থাকলো অনেক দিন। এইসব গল্পহীনতার নয় মাস পরে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পেসাব করার সময় জসিম টের পেলো তার শিশ্ন ব্যাথা হচ্ছে, পেশাব শেষ হয়ে আবার ফোটা ফোটা পেশাব ঝরছে লিঙ্গ থেকে। সময়ের সাথে অকেজো হয় কলকব্জা, অকেজো হয় শিশ্ন, ক্লান্ত হয় ভাবনা, স্লোথ হয় মস্তিষ্ক। জসিম বুঝতে পারলো, জসিম মেনে নিল। উপযুক্ত পরিচর্চার অভাব অথবা কোন এক শরীরবৃত্তীয় অসারতায় মগজে আর কাজ করছে না, ক্রিয়েটিভ ভাবনা হচ্ছে না, গল্প তৈরি হচ্ছে না; সেটাও মেনে নিল। জসিম সব মেনে নিল। সময়ে সব মেনে নিতে হয়। পর দিন, অন এ বিউটিফুল ইভিনিং জসিম ঝুলে রইলো নির্জন পাকুর গাছ কাণ্ডে। জসিম আত্মহত্যা করলো। হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স।

 

‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ সুপার ফ্লপ হলো। ইদ্রিস ভাই প্রায় সাড়ে তিন মাস অপেক্ষা করে এমন একটা ক্লিশে সুইসাইড স্টোরি পাবে এটা ভাবতে পারেন নি, এরপরও স্ট্রাকচার অদল-বদল করে, কিছু জায়গায় উপযুক্ত টুইস্ট যোগ করে গল্প প্রকাশ করলেন ‘আজকের খবর’ সাহিত্য পাতায় কিন্তু কোন কিছু হল না। পাঠক মহলে কোন রকম গুঞ্জন তৈরি হলো না। ‘এ ইভিনিং ফুল অব কোইন্সিডেন্স’ সাহিত্য মহলেও কোন প্রভাব ফেললো না। আক্কাস চিঠি লিখে বললো, এখনো গাধা রয়ে গেলি, একটা জুতসই আইডিয়া হ্যাক করতে পারলি না, আঠারোশতকে রয়ে গেলি! পরের সাপ্তাহে সাহিত্য রিভিউ ব্লগে পর পর দুইটা ঋনাত্বক পর্যালোচনা প্রকাশিত হয় জসিমের সদ্য প্রকাশিত ছোট গল্প কেন্দ্র করে যার এক পর্যায়ে জসিমকে গল্প-লেখা শেখার পরামর্শ দেয়া হয় এবং কিছু দিন না লেখার পরামর্শ দেয়া হয়।

 

ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্বে পরে গেলাম। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। লিখার সময় মনে হল বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, সময়োপযোগী আর আমার সাথে সরাসরি সম্পর্ক যুক্ত তাছাড়া লেখনী কৌশল ছিলো আনকোরা, স্বকীয় গল্প কাঠামোয় নির্মিত কিন্তু শেষ পর্যন্ত গল্পটা কোন ভাবেই দাঁড়াতে পারলো না। চমৎকার গল্প এই ভাবনাটা কি তাহলে শুধুই আমার কল্পনা, প্রকৃতপক্ষে যেটা কুৎসিত, ক্লিশে আর দুর্বল। ভেবেছি এই গল্পটি আমার সাহিত্য ভাবনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কিন্তু এখন দেখছি আমার ভাবনা মোটেও বাস্তবধর্মী নয়, ফলাফল যা হল তাতে নিজেকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, প্রতিনিয়ত বিশ্বাস ঘাতক মনে হচ্ছে। ক্ষমা অযোগ্য অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এই নির্বুদ্ধিতার শেষ কোথায়। ভীষণ একা আর নিস্তেজ অনুভূতি হচ্ছে। নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছে না আর। উপন্যাস লেখার চেষ্টায় চার মাস কাটিয়ে দিলাম কিছুই হলো না, গল্প লেখার চেষ্টায় তিন মাস কেটে গেল কিছুই হল না, গত সাত মাস কিছুই হল না। এই সময়টা পরবর্তী উপার্জন নিশ্চিত করার জন্য বরাদ্দ ছিলো, খুব সহজেই একটা সাইনিং মানি দিয়ে চলে যেতে পারতো আরো কয়েক বছর, কিন্তু এখনো হলো না। কিছুই হলো না। এসকল ভাবনা অনবরত কুৎসিত অনুভূতি তৈরি করছে। গত সাত মাসের ব্যর্থতা ভীড় করে; পর্যায়ক্রমে গত এক বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর এবং এগারো বছরের সকল ব্যর্থতা একত্র হয়ে গা ভারি করে দিচ্ছে, ঘনীভূত হচ্ছে ব্যর্থ অনুভূতি সমূহ। বুঝতে পারছি আমার সীমাবদ্ধতা, আমার অক্ষমতা, আমার না-পারা সব; আবার মাঝে মাঝে বুঝি না কিছুই, বুঝি না সমাজ, বুঝি না সম্পর্ক, বুঝি না অর্থনীতি আর বুঝি না নিজেকে। এতোগুলো বছর নিজের কাছাকাছি থেকেও কি করে অজানা থেকে যাই নিজের কাছে, কেনো বুঝতে পারছি না নিজেকে, নিজেকে না বোঝার এই ব্যর্থতাটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন, এই সময়। 

 

ভরদুপুর। গনগনে সূর্য মাথার উপর, সময়ের সাথে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে। আমি অপেক্ষায় আছি, অপেক্ষায় আছি একটি সুন্দর বিকেলের। আমি ইদ্রিস ভাইকে টেক্সট পাঠালাম, গুড বাই ইদ্রিস ভাই!

 

প্রতিটি মানুষ উৎসব কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে তার জীবনরেখার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, তিনটি ভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে; জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে। জসিমকে কেন্দ্র করে যে জন্মোৎসব হয়েছিলো সেটা এইমুহুর্তে তাৎপর্যপূর্ণ নয় কারণ জন্মোৎসবের কোন স্মৃতি জসিমের মগজে নাই এবং জসিম যেহেতু বিয়ে করবে না তাই বিয়েকেন্দ্রিক উৎসবের সম্ভাবনাও নেই; বাকি থাকে মৃত্যু কিন্তু মৃত্যু বিষয়টা এমন যে, যে ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে মৃত্যু-আয়োজন হয় সে ব্যক্তি মৃত বলে সেটা আর উপভোগ করতে পারে না। যেহেতু পুনরায় জন্মানো সম্ভব না এবং বিয়ে করাও সম্ভব না ফলে মৃত্যু হতে পারে নিজেকে উৎসব কেন্দ্রে রাখার একমাত্র উপায় কিন্তু সত্যি সত্যি মরে গেলে আয়োজনটাই আর উপভোগ করা হবে না। তাছাড়া মৃত্যু সংবাদে বন্ধু-পরিজনের উপস্থিতি, ভালোবাসার মানুষজনের কান্নাকাটি এইসব আমাকে উজ্জীবিত করবে খুব, আমার প্রতি অপরের ভালোবাসা আমাকে বাঁচতে সাহায্য করবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, নিজের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এইসব ভালোবাসায় তাই আমি ‘গুড বাই পৃথিবী’ লিখে পাবলিক স্ট্যাটাস দিলাম। 

 

মোনালিসার একটি এনড্রোয়েড ফোন আছে; আমি জানি আমার সুইসাইড নোট মোনালিসা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সবখানে, প্রথম মিনিটে নয় জনে, সেখান থেকে পরের দুই মিনিটে আঠারো জনে, আর পরবর্তী মিনিটে সাইত্রিশ জন এবং অন্যান্য। আমার ভক্তকুল, পাঠককুল আর বন্ধ-পরিজন স্মৃতিচারণ করবে, হায় হায় বলবে, ছুটে আসবে অনেকে, নোট লিখবে আমাকে নিয়ে, স্ট্যাটাস দিবে। স্মারক গ্রন্থ হবে একটা, আনন্দ হচ্ছে খুব, আনন্দে চোখে জল টলমল। আমার প্রতি অগনিত মানুষের ভালোবাসা আজ প্রকাশ হবে; সেই ভালোবাসার উত্তাপে বাকি জীবন আমার কেটে যাবে যে কোন স্থানে, যে কোন অবস্থায়। 

 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। দখিনা বাতাসে লুহাওয়া ঝাপটা দিচ্ছে শরীরে। উত্তেজনায় গা কেঁপে উঠছে কখনো কখনো। পরন্ত দুপুরে জরি-পটি বিক্রেতা হেঁটে যায় ধুলো পথে, খুব টেনে ক্লান্ত স্বরে লেইসফিতা ডেকে যায়, একটা ঝিমুনি ভাব তাতে, অবসন্ন স্বরে খরিদ্দারকে জানান দেয় উপস্থিতি। এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ হবার কথা, তাতে করে এতোক্ষনে কমপক্ষে পচাশি জনে খবর পৌঁছে গেছে। হাউ বিউটিফুল ইট ইজ।

 

দুই ঘন্টা পচাত্তর মিনিট বসে রইলাম ফোন হাতে, বিকেল হল। প্রতিদিনের মতো আজও কাকগুলো ক্ষণে ক্ষণে কর্কশ ডেকে উঠছে বাদাম গাছ ডালে। সূর্য তাপে পোড়া মাটির গন্ধ আসে নাকে। প্রতিদিনের নিয়মিত নির্জনতা। ইদ্রিস ভাই ফিরতি এস এম এস পাঠালেন: গুড বাই জসিম! আমার কান্না পেয়ে গেল। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ঝাপসা হয়ে গেছে এসএম এস স্ক্রিন। একটা মেঘ অনুভূতি শক্ত হয়ে গলায় দলা পাকিয়ে রইলো। একটা উচ্ছন্ন প্রশ্বাস থেকে থেকে চোখে ভর করে, আরো কিছু অবনত অনুভূতি ঘনীভূত হয়ে অশ্রু ফোঁটা তৈরি করে। অশ্রু গড়ায় চোখে। এমনকি আমার মৃত্যুতে কেউ নেই পাশে। বেঁচে আছি এটুকু উপলব্ধি প্রয়োজনে।



অক্টোবর, ২০২০
আটিগ্রাম