কসবা উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের একটি শিক্ষাবান্ধব গ্রামের নাম জমশেরপুর। এখানে অবস্থিত জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয় শতবছর ধরে এলাকার বাতিঘর হিসেবে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯শ শতকের আগের কথা। তখনো স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়নি। বর্তমান হাইস্কুলের মসজিদের জায়গাটিতে একটি বিরাট বটবৃক্ষ ছিলো। আর এ বটবৃক্ষতলে বসতো পথের হাট। বর্তমান প্রজন্ম এ ইতিহাস হয়তো জানবেই না। কী করে জানবে? কে জানাবে অলিখিত সেই মজার কথা। সেই ইতিহাস জানাতে আজ আমি আছি আপনাদের সাথে।
🇧🇩 জমশেরপুর গ্রামের নামকরণ:
কবি ও গবেষক ড. এস এম শাহনূর প্রণীত "কসবা উপজেলার ইতিবৃত্তে" জমশেরপুর গ্রামের নামকরণ বিষয়ে চমৎকার দু'টো তথ্য পাওয়া যায়।
(১) জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী আব্দুর রউফ এর নাতি কবি ও লেখক শামীম পারভেজ (৭০) বলেন, "আমি যখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ১৯৬৩ সালের দিকে আনুমানিক ৭৫ থেকে ৮০ বছর বয়েসী প্রবীণের মুখে শুনেছি, মৌলভী আব্দুর রউফ সাহেরের পিতা তাজউদ্দিন আহমেদ নাজিরের কোনো এক নিকটাত্মীয় জনৈক জমশেদ এর নামানুসারে পাড়াটির নাম জমশেরপুর হয়েছে।"
(২) অন্য একটি জনশ্রুতি মতে, তাজউদ্দিন আহমেদ নাজিরের অঢেল জমিজমা ও তালুক ছিলো। জমিদারি বা জমিজমা থেকে 'জমশেদ' এর সাথে 'পুর' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে লোকালয়ের নাম জমশেরপুর হতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
একনজরে জমশেরপুর গ্রাম:
(১) উচ্চ বিদ্যালয়: ১টি
জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়।
(২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১টি
(৩) এবতেদায়ী (৮ম শ্রেণি পর্যন্ত) মাদরাসা: ১টি
আসাদ বিন এনায়েত উল্লাহ মাদরাসা।
(৪) জামে মসজিদ: ১টি
(৫) ওয়াক্তিয়া মসজিদ (স্কুলে): ১টি
(৬) কবরস্থান ছোটো বড়ো: ৫টি
(৭) শহিদ সমাধি : ১টি
(৮) খেলার মাঠ: ১টি
(৯) লোক সংখ্যা: প্রায় ২০০০ জন
(১০) পুরুষ ও মহিলার অনুপাত: ১ঃ২
(১১) মোট ভোটার:১২০০ জন
(১২) শিক্ষার হার: ৭৫%
(১৩) দারিদ্র্যতার হার: ৩%
🇧🇩 জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস:
জমশেরপুর গ্রামের ধনাঢ্য পরিবারের জনৈক তাজউদ্দিন আহমেদ নাজির ১৯০০ শতকের গোড়ার দিকে তাঁর নিজ বাড়িতে একটি টোল তৈরি করে এলাকার ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। পরে এটিকে ১৯১৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯২৩ সালে জুনিয়র মাদ্রাসায় উন্নীত করা হয়। তাজউদ্দিন নাজির আহমেদ ১৯২৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মৌলভী আবদুর রউফ বিএল দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তদানিন্তন বেঙ্গলে জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯২৪ সালে বর্ণীর মৌলভী মোতাহার মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯২৬ সালে রাইতলা গ্রামের হাফেজ আহম্মদ প্রথম স্থান অধিকার করে প্রতিষ্ঠানটির গৌরব ও সুনাম ছড়িয়ে দেন। মৌলভী আবদুর রউফ সাহেব জুনিয়র মাদ্রাসাটির এই খ্যাতি কাজে লাগিয়ে ১৯৩০-এর দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এন এম খান-কে দু'বার মাদ্রাসাটি পরিদর্শনে নিয়ে আসেন। তাঁর কঠোর কর্ম তৎপরতায় জুনিয়র মাদ্রাসাটি ১৯৪১ সালে হাই মাদ্রাসায় উন্নীত হয়ে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে হাই মাদ্রাসা স্কিমটি বন্ধ হয়ে গেলে এটি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৬০ সালে প্রথম ব্যাচ হিসাবে পরীক্ষার্থীরা মেট্রিক পরীক্ষা দেয়া শুরু করে। যারা হাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো তারা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বোর্ড পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায় ।
🇧🇩 জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও মুক্তিযুদ্ধ:
বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম আরো গতিফিরে পায়। নির্বিচারে
বাঙালি নিধন ও গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকবাহিনী।
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায় চলে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। হত্যা লুণ্ঠনে যোগ দেয় এ দেশীয় রাজাকারের দল। ১৪ এপ্রিল কসবার চৌমুহনীতে পাকিস্তান আর্মির একটি দল তাদের অবস্থান জানান দেয়। পাকবাহিনীর পক্ষে এলাকার কিছু লোক দালালি শুরু করে। তাদের ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডে এলাকার সাধারণ জনগণের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জেগে ওঠে তরুণ প্রজন্ম। জমশেরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ এলাকায় ফিরে আসেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা
হারুনূর রশিদ, ইপিআর সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হোসেন মেম্বার। প্রায় দেড় শতাধিক তরুণ এখানে যুদ্ধের প্রাথমিক দীক্ষা লাভ করেন। ছুটে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডক্টর শাহা আলম। শাণিত কথামালায় অনুপ্রাণিত করেন গ্রামের তরুণদের। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হুমায়ুন কবির, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শামসুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমান জাহাঙ্গীর সহ এলাকার বহু তরুণ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
🇧🇩 স্কুলচত্বরে স্মৃতিস্তম্ভ:
১৯৭০ সালর ২৮ এপ্রিল আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় বুকে বল ফিরাতে গিয়ে স্কুল মাঠে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অত্র বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র জমশেদ খন্দকার (মলাই )। এরপর থেকে প্রতি বৎসর ২৮ এপ্রিল অত্র স্কুল ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে মলাই দিবস পালন করা হয়। স্কুলের মসজিদে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন ও তার স্মৃতিচারণ সভার আয়োজন করা হয়। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্কুলের সামনে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।
🇧🇩 চারগাছ রণাঙ্গনের তিন শহিদের কবর জমশেরপুর গ্রামে:
আমাদের পাশের গ্রামে কিংবা আমাদের বাড়ির পাশে, কারো কারোর ঘরের পাশে, শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক আবু, শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাহিদ আবু ও শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম সাফু চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ক’জনা তাঁদের খবর রেখেছি। কতটুকুই বা জানি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির জন্য আত্ম উৎসর্গকারী এ শ্রেষ্ঠ শহিদদের সম্পর্কে।
কুমিল্লার গৌরব তিন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মোজাম্মেল হক আবু, আবু জাহিদ আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফু। এই তিন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার রণাঙ্গন ও মৃত্যুস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের চারগাছ বাজারের সন্নিকট এবং তাঁদের শেষ আশ্রয় স্থল বা কবর একই উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের জমশেরপুরে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর শহীদ মোজাম্মেল হক আবুর পরিবারের মাধ্যমে কবরগুলো পাকারণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।