কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। উপমহাদেশের এক কালজয়ী পুরুষ দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস ও জন্মগ্রাম নবীনগরের বিটঘর সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রণী ছিল। বিশিষ্ট লোকদের বসবাস ছিল। ছিলো উচু বিটি, ছিলো বড় বড় ঘর।
🇧🇩 বিটঘরের জমিদার দেওয়ান ভৈরব চন্দ্রের নামানুসারে ভৈরবাজারের নামকরণ করা হয়েছে। কৈলাস চন্দ্রের রাজমালা গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
🇧🇩 মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর জীবদ্দশায় বিটঘর গ্রামে মা বাবা ও নিজের নামে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। দারিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশী দূর অগ্রসর হতে না পারলেও বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে জ্ঞান চর্চার উন্নতিকেই তিনি মানুষের মুক্তির প্রকৃত উপায় হিসাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই নিজের আয়ের অর্ধেক নিয়মিত ভাবে তিনি দান করে গেছেন প্রজন্মের শিক্ষাবিস্তারের পিছনে। তিনি জনকল্যাণে দান করে গেছেন অত্যন্ত নিরবে নিভৃতে। যা আজকের দিনের মানুষেরা কল্পনা ও করতে পারবে না। অথচ এমন মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম, বিটঘরের সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না।
জানা যায়, বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সকল ব্যয়ভার মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বহন করলেও স্কুলটির নামকরণে জমিদারের ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের এক নিকটাত্মীয় রাধানাথের নামে নামকরণ করা হয়। এলাকার নারী শিক্ষার প্রসারেমহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর নিজ বাড়ির পাশে ১৯১৫-১৬ সালের দিকে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।প্রভাবশালীদের অসহযোগিতার কারণে সেটিও অকালেই বিলুপ্ত হয়। এই বালিকা বিদ্যালয়ের সকল আসবাবপত্র ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কাইতলা ইংলিশ মাইনর স্কুলে(কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়) স্থানান্তর করা হয়। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে 'গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না'। দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বেলাও তাই ঘটেছে। তবে এমন প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি দমে যাননি।
কাইতলা থেকে কুড়িঘর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ কিঃ মিঃ মহেশ রোড। মহেশ রোড থেকে বিটঘর বাজার পর্যন্ত সংযোগ রাস্তা। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা সংসদ।
বিটঘর গ্রামের সাধারণ মানুষের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য নিজ বাড়ির পাশে একটি পুকুর খনন করেন এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এখান থেকে পানীয় জল নেওয়ার অনুমতি ছিল। পাকিস্তান আমলে বিটঘর ছিল নূরনগর পরগনার একমাত্র গ্রাম যেখানে বর্ষাকালে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য তিনটি লোহার ব্রিজ ছিল। এছাড়াও প্রকাশ্যে গোপনে বহু গরীব অসহায় ও কন্যা দায়গ্রস্থ পিতার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন মহর্ষি মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য।
🇧🇩 বিটঘর নামকরণ:
আন্তর্জাতিক কবি ও গবেষক ড. এস এম শাহনূর "বিটঘর নামকরণের ইতিকথা"য় বিটঘর গ্রামের নামকরণের বিষয়ে দুটি মতামত জানিয়েছেন,
১। বিশিষ্টজনদের বসবাস ও জন্ম হয়েছে বলে গ্রামটি বিটঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যেমন, ‘বিশিষ্ট’ শব্দের বানান লিখতে গিয়ে যদি ‘শিষ’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় তাহলে উচ্চারণ হয়’বিট’। বিশিষ্ট বানানের ‘বিট’ ও ‘ঘর’ এর সমন্বয়ে বিটঘর নামকরণ করা হয়।
২। অপর আরেক মতে , এই অঞ্চলে ভিটি ঘর ছিল প্রচুর। এই গ্রামে ভিটি ঘরের বসতি গড়ে ওঠায় নামকরণ করা হয় ‘বিটঘর’। অর্থাৎ ‘ভিটি’ শব্দের পরিবর্তিত রুপ ‘বিট’ এবং ‘ঘর’ এর সমন্বয়ে ‘বিটঘর’ নামের উৎপত্তি।
একনজরে বিটঘর গ্রামঃ
২ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
১ হাই স্কুল।
১ টি কলেজ
৩ টি কিন্ডার গার্টেন
৪ টি হাফেজখানা
৩ টি ব্যাংক
১ টি কমিউনিটি ক্লিনিক
২ টি ঈদগাহ মাঠ
২ টি বাজার
৪ টি মাজার
৩ টি খেলার মাঠ
১ টি আলেম মাদ্রাসা
১ টি মহিলা মাদ্রাসা
১ টি ঐতিহ্যবাহী অতিথি ভবন
১৩ টি মসজিদ
২ টি কবরস্থান(১টি বড় কবরস্থান)
২ টি শ্মশান
৪ টি মন্দির
৩ টি মঠ
৪ টি ঐতিহ্যবাহী বটগাছ
অসংখ্য পুকুর ও ডুবা।
মোট জনসংখ্যা =১১০০০জন (প্রায়)
মোট ভোটার=৩১০০জন
গ্রামের আয়তন =৩.৫ বর্গ কিলোমিটার(প্রায়)
পুরুষ ও মহিলার অনুপাত =৫৩ঃ৪৭
শিক্ষার হার=৪৮%
দারিদ্র্যতার হার=৬%
প্রবাসীর হার
পেশাঃ
কৃষিজীবি=২০%
প্রবাসী =৩৫%
চাকুরীজীবি =১৫%
ব্যবসায়ী =৩৫%
অন্যান্য =৫%
★বিশেষ ব্যক্তিত্বঃ
যুগে যুগে এখানে অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে।
🇧🇩 বিটঘর দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ:
শিক্ষা বিষয়ে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের দর্শন ছিল, ‘একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, করে তুলতে পারে আত্মনির্ভর।’ আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বিত হলেও এই কিংবদন্তীর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন এই গ্রামেরই আরেক কৃতিসন্তান ও সমাজ সেবক মোঃ মুন্তাসির মহিউদ্দিন অপু। তাঁর প্রয়াণের প্রায় ছয় যুগ পর ২০২০ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীর্তিমান এ মনীষীর জন্মভূমিতে নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশে তারই নামানুসারে ‘বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
🇧🇩 নবীনগর এলাকার ঐতিহ্য বিটঘর দেওয়ানবাড়ি:
অনেকের কাছে আবার এটি জমিদারবাড়ি নামেও সুপরিচিত,যতটুকু জানা যায় বৃটিশ আমলে বিটঘর জমিদারবাড়ি'টি ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত,তখন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি ছিল রাজা মানিক্য বাহাদুর। বৃটিশ সরকার জমিদারী প্রথা চালু করলে তখন বিটঘরের দেওয়ান ভৈরব নাথ রায় স্বল্প মূল্যে রাজা মানিক্যের কাছ থেকে দেওয়ানী তথা জমিদারী কিনে নেয়। বিটঘর জমিদারবাড়ীিটি বৃটিশ আমলে নির্মিত বিধায় তার সুনিপুন কারুকার্যে রয়েছে বিলাতের আভিজাত্যের ছাপ,মূলত ভৈরব নাথ রায়ের নাম অনুসারে ভৈরবের নাম করন করা হয়,ভৈরব সহ কিশোরগন্জের অধিকাংশ জায়গা জমির মালিক ছিল বিটঘরের দেওয়ান ভৈরব নাথ রায়।
কথিত আছে ভৈরবের আধিপত্য নিয়ে একবার ভৈরব নাথ রায়ের সাথে কিশোরগন্জের কিছু জমিদারের সাথে বিরোধ হয়,ভৈরব নাথ জানতেন সমষ্টিগত জমিদারের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা সম্ভব নয়,তাঁর ছিল রঙের দোকান,ফলে ভৈরব নাথ চালাকী করে রাতের আধাঁরে সব লাল রঙ পানিতে ভাসিয়ে দিলেন,তখন চারদিকে গুজব ছড়িয়ে গেল ভৈরব নাথ হাজার হাজার মানুষ খুন করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন,ফলে অনায়াসে ভৈরব নাথ যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেল,আর এই লাল রঙ পানিতে মিশে ভাসতে ভাসতে যে জায়গায় এসে শেষ হয়েছিল,সেটাই মূলত আজকের বাইশমৌজা লালপুর গ্রাম,এক সময় দেওয়ানবাড়ি'তে নূপুরের নিক্কন ধ্বনী আর কোলাহলে মুখরীত হয়ে থাকত,এখন আর পালোয়ান আর নৌকা বোঝায় পণ্য চোখে পড়েনা,আজ অনেকটাই শুনশান নিরবতা।
🇧🇩 মিষ্টি :
তবে বিটঘরের মিষ্টি এখনো দেওয়ানী আভিজাত্যের স্বাদ রয়েছে।